মৌসুমের ১৫ দিন আগেই কক্সবাজারে লবণ উৎপাদন শুরু, ন্যায্যমূল্যে খুশি চাষিরা

কক্সবাজারের কুতুবদিয়া উপজেলার লেমশিখালী উপকূলের মাঠে কালো পলিথিন বিছিয়ে সমুদ্রের লোনা পানি শুকিয়ে উৎপাদিত হচ্ছে লবণছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজারের সাগরদ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ায় এবার মৌসুম শুরুর ১৫ দিন আগেই শুরু হয়েছে লবণ উৎপাদন। উৎপাদিত লবণের ন্যায্যমূল্য পেয়ে খুশি স্থানীয় চাষিরা। গত বছর প্রতি মণ লবণ বিক্রি হয়েছিল সর্বোচ্চ ৩০০ টাকায়। নতুন মৌসুমের শুরুতে এখন মাঠে উৎপাদিত লবণ বিক্রি হচ্ছে মণপ্রতি ৫০০ টাকা পর্যন্ত।

চাষিরা বলেন, লবণের এই মূল্য অব্যাহত থাকলে জেলায় এবার লক্ষ্যমাত্রার অতিরিক্ত লবণ উৎপাদিত হবে। তখন দেশের লবণে জাতীয় চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও রপ্তানি সম্ভব। দেশে লবণের বার্ষিক চাহিদা ২৩ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) তথ্য অনুযায়ী, কুতুবদিয়ার পাশাপাশি টেকনাফ, পেকুয়া ও কক্সবাজার সদর উপজেলার অন্তত ১৩ হাজার একর জমিতে লবণ চাষে নেমেছেন ১২ হাজারের বেশি চাষি। ২ নভেম্বর থেকে এসব মাঠে লবণ উৎপাদন শুরু হয়েছে। ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত ১৭ দিনে উৎপাদিত হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৭৫৫ মেট্রিক টন লবণ। গত মৌসুমে লবণ উৎপাদন শুরু হয়েছিল ২০ নভেম্বর থেকে।

আরও পড়ুন

বিসিকের তথ্য বলছে, চলতি মৌসুমে (১৫ নভেম্বর থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত পাঁচ মাস) জেলার টেকনাফ, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, কক্সবাজার সদর, ঈদগাঁও, মহেশখালী, চকরিয়া ও বাঁশখালী উপজেলায় ৬৬ হাজার ২৯১ জমিতে ২৩ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। গত মৌসুমে কক্সবাজারের ৬৩ হাজার ২৯১ একর জমিতে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২৩ লাখ ৫৭ হাজার মেট্রিক টন। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। তখন লবণ উৎপাদন হয়েছিল ১৮ লাখ ৩১ হাজার ৯৩১ মেট্রিক টন। এবার তিন হাজার একর জমিতে লবণ উৎপাদন বাড়ছে, এ কারণে উৎপাদনও বাড়বে।

কুতুবদিয়ার লেমশিখালী ও টেকনাফের জাদিমুরা এলাকার চাষি আবদুল করিম বলেন, আবহাওয়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে, বিদেশ থেকে লবণ আমদানি বন্ধ থাকলে এবং লবণের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হলে চলতি মৌসুমে ২৫ লাখ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদিত হতে পারে। কারণ, লাভের আশায় এবার চাষিরা সনাতন পদ্ধতি বাদ দিয়ে শতভাগ মাঠে পলিথিন প্রযুক্তিতে লবণ উৎপাদন করছেন। এই প্রযুক্তিতে দ্বিগুণের বেশি লবণ উৎপাদিত হচ্ছে।

প্রায় ৪০ হাজার প্রান্তিক চাষি, ১ লাখ শ্রমিকসহ জেলার অন্তত ১০ লাখ মানুষ লবণ উৎপাদন, পরিবহন ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

আরও পড়ুন

বিসিক কক্সবাজার লবণশিল্প উন্নয়ন প্রকল্পের উপমহাব্যবস্থাপক মো. জাফর ইকবাল ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার মৌসুম শুরুর ১০ থেকে ১৫ দিন আগেই চাষিরা মাঠে নেমেছেন। গত ১৭ দিনে ১ হাজার ৭৫৫ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদিত হয়েছে। আগামী ডিসেম্বরের শুরু থেকে পুরোদমে এবং শতভাগ মাঠে (জমিতে) লবণ উৎপাদিত হবে।

জাফর ইকবাল ভূঁইয়া বলেন, গত মৌসুমে ঘাটতি মেটাতে পাঁচ লাখ মেট্রিক টন লবণ আমদানির সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এর মধ্যে গত সেপ্টেম্বর মাসে দেড় লাখ মেট্রিক টন লবণ আমদানি হয়েছিল। এখন আর আমদানির প্রয়োজন হচ্ছে না। কারণ, ইতিমধ্যে মাঠে উৎপাদিত লবণ বাজারজাত হচ্ছে। তা ছাড়া কক্সবাজারে শতভাগ মাঠে পলিথিন প্রযুক্তিতে লবণ উৎপাদিত হচ্ছে বিধায় লবণের গুণমানও ভালো। দামও বেশি পাওয়ায় চাষিরা লাভবান হচ্ছেন। এতে লবণ চাষে উৎসাহ বাড়ছে জানিয়ে বিসিকের এই কর্মকর্তা বলেন, এবার কক্সবাজারের লবণ দিয়েই দেশের জাতীয় চাহিদা পূরণের চেষ্টা চলছে।

ন্যায্যমূল্যে খুশি চাষিরা

কুতুবদিয়ার লেমশিখালীর এলাকায় চার একর জমিতে লবণ উৎপাদন করছেন স্থানীয় চাষি সৈয়দ আহমদ। গত ২৬ সেপ্টেম্বর মাঠ সমান করে লবণ চাষের উপযোগী করে তোলেন তিনি। ছোট ছোট বাঁধ দিয়ে তৈরি করেন বিশেষ কক্ষ। কক্ষে বিছানো হয় কালো পলিথিন। এরপর সমুদ্রের লোনা পানি ঢোকানো হয়। তারপর পলিথিনের ওপর জমানো লোনা পানি সূর্যতাপে শুকিয়ে জমাট বাঁধে সাদা লবণের আস্তর। বিকেলে পলিথিনের ওপর থেকে সেই লবণ কুড়িয়ে মজুত করা হয় মাঠের এক কোণে।

সৈয়দ আহমদ (৫৫) বলেন, ৩ নভেম্বর থেকে তিনি মাঠে লবণ উৎপাদন করছেন। ইতিমধ্যে ৪৫ মণের বেশি লবণ বিক্রি করেছেন। আরও ৫০ মনের বেশি লবণ মজুত আছে। গত বছর তিনি প্রতি মণ লবণ বিক্রি করেছেন সর্বোচ্চ ৩১০ টাকায়। এবার বিক্রি করছেন ৪৮০ টাকায় জানিয়ে সৈয়দ আহমদ বলেন, প্রতি মণ লবণ উৎপাদনের বিপরীতে তাঁর খরচ হচ্ছে ২১০ টাকার মতো। লবণ উৎপাদন লাভজনক হওয়ায় স্থানীয় আরও কয়েকশ চাষি উৎসাহিত হয়ে মাঠ সংস্কারে নেমেছেন।

টেকনাফের হ্নীলা, রঙিখালী, জাদিমুরা, সাবরাং এলাকাতেও কয়েক হাজার একর জমিতে লবণ উৎপাদন শুরু হয়েছে।

লবণ আমদানির গুজবে চাষিদের আতঙ্ক কাটছে না

রঙিখালী এলাকার চাষি আবুল কালাম ও সিরাজুল ইসলাম বলেন, এখন প্রতি মণ লবণ তাঁরা সর্বোচ্চ ৫০০ টাকায় বিক্রি করছেন। কিন্তু লবণ আমদানি হলে তাঁদের লোকসান গুনতে হবে—এই শঙ্কায় অনেকে লবণ চাষে নামতে সাহস পাচ্ছেন না।

কয়েকজন লবণচাষি বলেন, বিদেশি লবণে বাজায় সয়লাব হওয়ায় গত মৌসুমে প্রতি মণ লবণ বিক্রি করতে হয়েছে ২৫০ থেকে ২৮০ টাকায়। এ ক্ষেত্রে প্রতি কেজি লবণের দাম পড়েছিল সাড়ে ৬ টাকা থেকে ৭ টাকা। যদিও বাজারে প্যাকেটজাত লবণের খুচরা মূল্য ছিল ২৫ থেকে ৪৫ টাকা। এবারও যদি সেই পরিস্থিতি দেখা দেয়, তাহলে লবণ উৎপাদনে চাষিরা নিরুৎসাহিত হবেন।

কক্সবাজারে এবার  ১৩ হাজার একর জমিতে লবণ চাষে নেমেছেন ১২ হাজারের বেশি চাষি
ছবি: প্রথম আলো

টেকনাফ উপজেলা লবণ চাষি কল্যাণ সমিতির সভাপতি মো. শফিক মিয়া বলেন, এবার উৎপাদিত লবণের ন্যায্যমূল্য পাওয়া গেলেও লবণ আমদানির গুজবে চাষিদের আতঙ্ক কাটছে না। চাষিরা চায় না, বিদেশ থেকে লবণ আমদানি করে দেশের লবণ শিল্প ধ্বংস হোক। এ ক্ষেত্রে চাষিদের প্রশিক্ষণ, নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার ও লবণ উৎপাদন বাড়াতে সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।

আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় বেশি উৎপাদনের আশা

সরেজমিন উপকূল ঘুরে এসে বিসিক লবণ শিল্প উন্নয়ন প্রকল্পের মাঠ পরিদর্শক মো. ইদ্রিস আলী প্রথম আলোকে বলেন, গত মৌসুমে লবণ উৎপাদন শুরু হয়েছিল ২০ নভেম্বর থেকে। এবার উৎপাদন শুরু হয়েছে ২ নভেম্বর থেকে। মাঠে গত শনিবার প্রতি কেজি লবণ বিক্রি হয়েছে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকায়, যা গত মৌসুমে বিক্রি হয়েছিল ২৮০ থেকে ৩০০ টাকায়। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার লবণের বাম্পার উৎপাদনের আশা করছেন চাষিরা।

মহেশখালীর লবণচাষি ও কক্সবাজার-২ (মহেশখালী-কুতুবদিয়া) আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, এখন মাঠে উৎপাদিত প্রতি মণ লবণ সর্বোচ্চ ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এতে চাষিরা খুশি। চাষিরা যেন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা আছে। যদিও গত কয়েক বছর ধরে মধ্যস্বত্বভোগীদের চক্রান্তে প্রান্তিক চাষিরা লবণের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত এবং উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার লবণ আমদানি বন্ধ রেখেছে। পাশাপাশি উৎপাদন দ্বিগুণ করতে পলিথিন প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে।