পঞ্চগড়ে রাতের উত্তেজনার পর স্বাভাবিক সকাল, গুজব ছড়ানোর অভিযোগে আটক ১৮
পঞ্চগড়ে আহমদিয়া জামাতের ‘সালানা জলসা’কে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনা নিয়ে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে ১৮ জনকে আটক করেছে পুলিশ। গতকাল শনিবার দিবাগত রাতে শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়।
‘আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মানুষেরা দুজনকে গলা কেটে হত্যা করেছে’—এই গুজবকে কেন্দ্র করে গত রাতে শহরে উত্তেজনা দেখা দেয়। ভাঙচুর হয় একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।
আজ রোববার সকাল থেকে শহরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। খুলতে শুরু করেছে দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। দুই দিন ছুটির পর আজ সরকারি বেসরকারি দপ্তর খোলা থাকায় বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শহরে ভিড় বাড়তে শুরু করেছে। তবে শহরে মানুষজনের উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে অন্যান্য দিনের চেয়ে কিছুটা কম।
এদিকে গতকাল রাত থেকে মুঠোফোনে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবহারকারী ব্যক্তিরা। তবে মুঠোফোনে একে অন্যের সঙ্গে কথা বলা যাচ্ছে।
গত শুক্রবার দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত মুসল্লিদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের পর গতকাল রাত আটটা পর্যন্ত পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় শহরের পরিবেশ শান্ত ছিল। পুলিশ ও শহরের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গতকাল রাত পৌনে ৯টায় তিনটি মোটরসাইকেলে ছয়জন আরোহী দ্রুতগতিতে মোটরসাইকেল চালিয়ে শহরের বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে অবস্থানরত মানুষদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেন। তাঁরা বলছিলেন, শহরের তুলারডাঙ্গা এলাকায় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মানুষেরা দুজনকে গলা কেটে হত্যা করেছে’।
এরপরে মুহূর্তেই শহরের রাস্তায় নেমে আসে মানুষ। হাতে লাঠিসোঁটা নিয়ে ‘নারায়ে তাকবির’ ধ্বনি তুলে তাঁরা দুইভাগ হয়ে আহম্মদনগর ও তুলারডাঙ্গা এলাকার দিকে ছুটতে থাকেন। এ সময় পঞ্চগড় বাজারের কদমতলা এলাকার ওয়াকার শোরুম নামে একটি জুতার দোকানের সাটার ভেঙে মালামাল লুটপাট করে নিয়ে যায় একদল মানুষ।
শোরুমটির ব্যবস্থাপক সুমন কুমার আজ সকালে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের ৭০ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া ২০ হাজার টাকা চুরি হয়েছে।
কিছু সময় পরে পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পরে বিভিন্ন মসজিদে মাইকের মাধ্যমে ও জেলা প্রশাসন থেকে সড়কে মাইকে প্রচার করা হয়, শহরের কোথাও কোনো হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেনি। স্বার্থান্বেষী একটি মহল গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করছে। মানুষকে নিজ নিজ বাড়িতে অবস্থান করার আহ্বান জানানো হয়। রাত ১০টার দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে টিয়ারশেলের শব্দ শোনা গেছে।
এর মধ্যে রাত সাড়ে ১০টার দিকে পঞ্চগড় পৌরসভার ট্রাক টার্মিনাল এলাকায় একটি মাইক্রোবাস পুড়িয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা।
এরপর রাত ১২টায় জেলা আওয়ামী লীগ দলীয় কার্যালয় থেকে একটি শান্তি মিছিল বের করা হয়। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার সাদাতের নেতৃত্বে এই মিছিল হয়। মিছিল থেকে ‘সন্ত্রাসীদের কালোহাত ভেঙে দাও’ স্লোগান দেওয়া হয়।
গত রাত থেকে সংশ্লিষ্ট আহম্মদনগর এলাকায় পর্যাপ্ত পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। জেলা প্রশাসন থেকে পুরো আহম্মদিয়া সম্প্রদায়ের মানুষের বাড়িঘরে কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল লতিফ মিঞা প্রথম আলোকে বলেন, গুজব ছড়ানোর দায়ে মোট ১৮ জনকে আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে পৌর যুবদলের কর্মী ফজলে রাব্বী (২৬) রয়েছেন। আটক অন্যদের বয়স ১৯ থেকে ৩০–এর মধ্যে। এ ধরনের কাজে যেই যুক্ত থাকুক না কেন, তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে আটক ব্যক্তিদের বিষয়ে পরবর্তী আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান ওসি।
উল্লেখ্য, পঞ্চগড় শহরের উপকণ্ঠে আহম্মদনগর এলাকায় আহমদিয়া জামাতের শুরু হওয়া তিন দিনব্যাপী জলসা বন্ধের দাবিতে শুক্রবার দুপুরে জুমার নামাজের পর পঞ্চগড় শহরের বিভিন্ন মসজিদ থেকে মিছিল বের করা হয়। মিছিল নিয়ে বিক্ষোভকারীরা শহরের চৌরঙ্গী মোড়ে সমবেত হন। সেখান থেকে তাঁরা মিছিল নিয়ে করতোয়া সেতুর দিকে যেতে চাইলে পুলিশ তাঁদের থামিয়ে দেয়। একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা ছড়িয়ে–ছিটিয়ে শহরের বিভিন্ন অলিগলিতে ঢুকে পড়েন।
কিছুক্ষণ পর চৌরঙ্গী মোড়সংলগ্ন সিনেমা হল সড়ক থেকে একদল বিক্ষোভকারী মিছিল নিয়ে এসে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। তখন পুলিশ ধাওয়া দিলে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বাধে। একদল বিক্ষোভকারী আহম্মদনগর এলাকায় গিয়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের অন্তত শতাধিক বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত দফায় দফায় এ পাল্টাপাল্টি হামলা চলে। সংঘর্ষের একপর্যায়ে পুলিশ, বিজিবি ও র্যাবের সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট ছোড়েন। এ ঘটনায় দুজন নিহত ও পুলিশসহ অন্তত শতাধিক মানুষ আহত হন। পরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে আহমদিয়াদের জলসা বন্ধ ঘোষণা করা হয়।