রাখাইনে চলমান সংঘাতে দুর্বিষহ জীবন টেকনাফের ৩ হাজার জেলের

কাজ নেই, তাই অলস সময় পার করছেন তাঁরা। শনিবার দুপুরে কক্সবাজারের টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের জেলেপল্লি জালিয়াপাড়ায়ছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজারের টেকনাফ সদর থেকে ১৮ কিলোমিটার দক্ষিণে সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপের জেলেপল্লি জালিয়াপাড়া। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান সংঘাত, গুলি, মর্টার শেল বিস্ফোরণের ঘটনায় টেকনাফের তিন হাজারের বেশি জেলে নাফ নদীতে মাছ শিকারে নামতে পারছেন না। ফলে আয়রোজগার বন্ধ হয়ে তাঁরা দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন। সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে তাঁরা পাননি কোনো সহায়তাও।

গতকাল শনিবার বিকেলে সরেজমিনে দেখা যায়, নাফ নদীর তীরের গ্রাম জালিয়াপাড়ায় শত-শত নারী-পুরুষ গাছের ছায়া কিংবা ঘরের অঙিনায় বসে অলস সময় পার করছেন। জালিয়াপাড়ার পূর্ব পাশে নাফ নদী, তারপর রাখাইন রাজ্যের জেলা শহর মংডু। এ পারের বেড়িবাঁধে দাঁড়িয়ে ওপারের দৃশ্য খালি চোখে দেখা যায়।

গত দেড় মাস ধরে এপারের লোকজন মংডু টাউনশিপের আশপাশের গ্রামগুলোতে গোলাগুলি ও মর্টার শেলের বিস্ফোরণের শব্দ শুনে আসছেন। আগে দিন ও রাতে বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসত। ছয় দিন ধরে শুধু রাতের বেলায় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। মূলত সীমান্ত চৌকি দখল ও পুনরুদ্ধারের ঘটনায় সরকারি বাহিনীর সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছে দেশটির সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ)।

রোজার মাসেও রাতে বিস্ফোরণের ঘটনা এপারের লোকজনের দুর্ভোগ ও শঙ্কা বাড়িয়ে তুলছে। শক্তিশালী গ্রেনেড, বোমা ও মর্টার শেলের বিস্ফোরণে কাঁপছে জালিয়াপাড়া, চৌধুরীপাড়া, কুলালপাড়া, ডেইলপাড়াসহ টেকনাফ সীমান্তেরর অন্তত ১২টি গ্রাম।
মুজিবুর রহমান, প্যানেল মেয়র, টেকনাফ পৌরসভা

সীমান্তের একাধিক সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি উত্তর রাখাইনের তুমব্রু এলাকায় সাতটির বেশি সীমান্ত চৌকি এবং মংডুর দক্ষিণে রাচিডং, বুচিডং টাউনশিপের কয়েকটি চৌকিও দখলের নিয়েছে আরাকান আর্মি। সংঘাতে টিকতে না পেরে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) ১৭৯ জন সদস্য কয়েক দিন আগে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁরা বর্তমানে বিজিবির তত্ত্বাবধানে আছেন। এর আগেও ৩৩০ জন পালিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের ফেরত পাঠানো হয়েছে।

টেকনাফ পৌরসভার প্যানেল মেয়র মুজিবুর রহমান বলেন, রোজার মাসেও রাতে বিস্ফোরণের ঘটনা এপারের লোকজনের দুর্ভোগ ও শঙ্কা বাড়িয়ে তুলছে। শক্তিশালী গ্রেনেড, বোমা ও মর্টার শেলের বিস্ফোরণে কাঁপছে জালিয়াপাড়া, চৌধুরীপাড়া, কুলালপাড়া, ডেইলপাড়াসহ টেকনাফ সীমান্তেরর অন্তত ১২টি গ্রাম। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাতটা থেকে শুরু হয় গোলাগুলি ও মর্টার শেল নিক্ষেপ। শুক্রবার ভোর পাঁচটা পর্যন্ত থেমে থেমে গুলি ও মর্টার শেলের বিস্ফোরণের শব্দ এপারের লোকজন শুনতে পান।

আরও পড়ুন

ঘরে ঘরে অভাব

শাহপরীর দ্বীপ জেটিঘাট থেকে উত্তর দিকে এক কিলোমিটার দূরে জালিয়াপাড়া। বেড়িবাঁধের পূর্বপাশে নাফ নদীর তীরে আগে তিন শতাধিক ঘরবাড়ি ছিল, গাছপালা ছিল কয়েক হাজার। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে কয়েকটি গাছ ছাড়া কিছুই নেই। গৃহহীন লোকজন মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছেন বেড়িবাঁধের ঢালুতে এবং পাশের ক্যাম্পপাড়াতে।

গ্রামে ঢুকতে সামনে পড়ে জালিয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ে আগে শিক্ষার্থী ছিল ছয় শতাধিক, এখন ১৬৩ জন। দুটি কক্ষে শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছিলেন দুই শিক্ষক। বিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হালিমা আক্তার বলেন, শিক্ষার্থীর সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। কারণ, ঘরে ঘরে অভাব।

রোদে মাছ শুকিয়ে কোনোমতে চলছে কয়েকটি পরিবার। শনিবার দুপুরে কক্সবাজারের টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের জেলেপল্লি জালিয়াপাড়ায়
ছবি: প্রথম আলো

বিদ্যালয়ের সামনের মাঠে বসে আছেন কয়েকজন জেলে। সবার দৃষ্টি নাফ নদীর ওপারে রাখাইন রাজ্যের দিকে। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে সীমান্ত পাহারা দিচ্ছেন কয়েকজন বিজিবি সদস্য। ইমাম হোসেন, নজির আহমদ, আবদু শুক্কুর, অলি আহম্মদসহ কয়েকজন জেলে বলেন, ওপারের গোলোগুলি ও বিকট শব্দে বিস্ফোরণ তাঁদের জীবন-জীবিকা হুমকিতে ফেলেছে। নিরাপত্তার অজুহাতে বাংলাদেশি জেলেদের নাফ নদীতে মাছ ধরতে নামতে দেওয়া হচ্ছে না। এখানে আয়রোজগারের বিকল্প ব্যবস্থাও নেই। অথচ মিয়ানমারের জেলেরা নাফ নদীতে নেমে মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছেন।

নদীর তীরে পড়ে আছে তিন শতাধিক নৌকা, শাহপরীর দ্বীপ ঘাটেও পড়ে আছে আরও ৩০০ নৌকা। কোনোটিই সাগর কিংবা নাফ নদীতে নামতে পারছে না। জালিয়াপাড়া মৎস্য সমবায় সমিতির সভাপতি আবদুল গনি বলেন, আগে জালিয়াপাড়া, শাহপরীর দ্বীপ ছিল মৎস্য আহরণের অন্যতম এলাকা। এখানকার মাছ সরবরাহ হতো টেকনাফ, কক্সবাজার, চট্টগ্রামসহ ঢাকার বিভিন্ন বাজারে। এখন জীবন ধারণের জন্য টেকনাফ সদর থেকে কাঁচা মাছ কিনে এনে শুঁটকি করতে হচ্ছে। রাখাইনে সংঘাতের কারণে দেড় মাস ধরে জেলেরা বেকার হয়ে পড়লেও এ পর্যন্ত কোনো ঘরে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে সহায়তা পৌঁছায়নি।

নদীর তীরে পড়ে আছে তিন শতাধিক নৌকা, শাহপরীর দ্বীপ ঘাটেও পড়ে আছে আরও ৩০০ নৌকা। কোনোটিই সাগর কিংবা নাফ নদীতে নামতে পারছে না।
নদীর তীরে পড়ে নষ্ট হচ্ছে নৌকা
ছবি: প্রথম আলো

জেলেপল্লির উত্তরাংশে বাঁশের মাচাতে শুঁটকি তৈরির কাজে ব্যস্ত কয়েকজন নারী। তাঁদের মধ্যে আয়েশা বেগম, মরিয়ম খাতুন ও সানজিদা বেগম জানালেন, দৈনিক ২৫০ টাকা মজুরিতে তাঁরা অন্যের শুঁটকি তৈরি করে দিচ্ছেন। কাজ নেই বলে মজুরিও কম।

১৭ বছর ধরে নাফ নদীতে মাছ শিকার করে ছয় সদস্যের সংসার চালাতেন জেলেপল্লির আবদুল করিম (৪৫)। এখন তিনি বেকার। বালচুরে তাঁর নৌকাটি পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে। ক্ষোভ প্রকাশ করে আবদুল করিম বলেন, নাফ নদীতে মাছ আহরণ বন্ধ রাখলে তাঁদের কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু জেলেপল্লির মানুষগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্যোগ তো সরকারকে নিতে হবে। এখন রোজার মাসে অর্থ সংকটে পড়ে বহু পরিবারকে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। দুর্গম পল্লি হওয়ায় সেখানে কারও নজরও পড়ছে না।

আরও পড়ুন
সংঘাত শেষ হলে নদীতে মাছ শিকারের অনুমতি পাবেন, সেই অপেক্ষায় আছেন তাঁরা
ছবি: প্রথম আলো

আরেক জেলে আবদুল হক বলেন, নদীর তীরে প্যারাবনে তিনি মাছ ও কাঁকড়া শিকার করে সংসার চালাতেন। দেড় মাস ধরে বেকার। রাখাইনের সংঘাত তাঁদের জীবন–জীবিকা ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

জেলেপল্লির দুই দিকে বিজিবির কড়া পাহারা। নাফ নদীতেও কোস্টগার্ড ও বিজিবির টহল দেখা গেল। বালুচরে বসে বসে এসব দৃশ্য দেখছেন জেলেপল্লির নারী, পুরুষ ও শিশু। সংঘাত শেষ হলে নদীতে মাছ শিকারের অনুমতি পাবেন, এই আশায় তাঁরা।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
আরও পড়ুন