নিষেধাজ্ঞা শেষে নদী–সাগরে ইলিশের দেখা নেই, মলিন মুখে ঘাটে ফিরছেন জেলেরা

পর্যাপ্ত ইলিশ না পাওয়া যাওয়ায় মৎস্যঘাটে চিরচেনা ব্যবস্ততা নেই। আজ রোববার বরিশালের পোর্ট রোডের মৎস্য বন্দরে
ছবি: সাইয়ান

দক্ষিণের জেলেদের আশা ছিল বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে প্রচুর ইলিশ পাওয়া যাবে। কিন্তু ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা এক সপ্তাহ আগে শেষ হলেও নদ-নদী ও সাগরে তেমন ইলিশ ধরা পড়ছে না। শ্রাবণের মাঝামাঝি এসেও কাঙ্ক্ষিত ইলিশের দেখা না পেয়ে মৎস্যজীবীরা হতাশ। সাগর থেকে ট্রলারগুলো ঘাটে ফিরছে জেলেদের মলিন মুখ নিয়ে। মাছঘাটগুলোতে অলস সময় কাটাচ্ছেন শ্রমিকেরা।

মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইলিশ ধরা পড়বে। তবে এ জন্য জেলেদের একটু ধৈর্য ধরতে হবে। আগস্টের প্রথম সপ্তাহে পরবর্তী যে পূর্ণিমা হবে, তখন থেকে ইলিশের আধিক্য বাড়বে। হতাশ হওয়ার কিছু নেই।

ভোলার মনপুরার ট্রলারমালিক নাসির উদ্দীনের দুটি ট্রলার রয়েছে। মাছ না ধরা পড়ায় লোকসানের ভয়ে সেগুলো সাগর-নদীতে যাচ্ছে না। ইলিশ ধরা পড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আজ রোববার দুপুরে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘শ্রাবণের এই সময়ে ঘাটে সারি সারি নৌকা, ট্রলার ভিড়ত ইলিশ নিয়ে। কিন্তু এবার পুরো ঘাট বিরান। জীবনে ইলিশের এমন আকাল দেখি নাই। মনে হয় নদীগুলো মরে গেছে। মাছের আকালে এ অঞ্চলের অনেক জেলে চট্টগ্রামে অন্য কাজে চলে গেছে। কীভাবে যে টিকে থাকব, কিছু ভাবতে পারছি না।’

আরও পড়ুন

নাসির উদ্দীনের এই দীর্ঘশ্বাস বরিশালের পোর্ট রোডের মৎস্য বন্দরেও দেখা গেল। আজ সকালে এই মৎস্য বন্দরে গিয়ে দেখা যায়, সুনসান। শ্রমিকেরা বেকার বসে আছেন। আড়তগুলোতে হাঁকডাক-কোলাহল নেই।

আড়তদার সমিতি সূত্র জানায়, রোববার এই বন্দরে ১০ থেকে ১৫ মণ ইলিশ এসেছে। অথচ এই সময়ে প্রতিদিন এক হাজার মণের বেশি ইলিশ আসার কথা। ইলিশের আমদানি কম হওয়ায় দাম আকাশচুম্বী। আজ ৬০০ থেকে ৯০০ গ্রাম ওজনের (এলসি সাইজ) প্রতি মণ ইলিশ পাইকারি বিক্রি হয়েছে ৫৩ থেকে ৫৪ হাজার টাকা। এক কেজি ওজনের ইলিশ মণপ্রতি বিক্রি হয়েছে ৬৩ থেকে ৬৫ হাজার এবং এর ওপরে ওজনের ইলিশ বিক্রি হয়েছে ৭২ থেকে ৭৫ হাজার টাকায়।

ইলিশের সরবরাহ কম থাকায় দামও বেশি। আজ রোববার দুপুরে বরিশালের পোর্ট রোডের মৎস্য বন্দরে
ছবি: প্রথম আলো

পাইকারি বাজার থেকে এই মাছ যখন বরিশালের খুচরা বাজারে যায়, তখন এর কেজি দেড় হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা কেজি বিক্রি হয়। এখানের আড়তদার জহির সিকদার বলেন, ‘প্রায় ২২ বছর ধরে এখানে ব্যবসা করি। কিন্তু ইলিশের ভরা এই মৌসুমে এমন আকাল আর দেখিনি। ব্যবসায় টিকে থাকা এখন কঠিন হয়ে পড়েছে।’

ইলিশের এমন আকালের কারণ বিষয়ে জানতে চাইলে পোর্ট রোডের অপর এক আড়তদার আশরাফ আলী প্রথম আলোকে বলেন, বাধাহীনভাবে নির্বিচার জাটকা নিধন এর পেছনে প্রধান কারণ। ফাল্গুন মাসে যখন বাচ্চা ইলিশগুলো নদীর মিঠা পানিতে দল বেঁধে বিচরণ করে, তখন এসব পোনা ছোট ফাঁসের জাল দিয়ে নির্বিচারে ধরে ফেলে জেলেরা। এসব চাপলি মাছ বলে বাজারে বিক্রি করে। আসলে এগুলো ইলিশের পোনা।

আশরাফ আলী বলেন, সরকার যদি এসব অবৈধ জালের ব্যবহার বন্ধ এবং জাটকা নিধন রোধে কঠোর না হয়, তাহলে আগামী দু-এক বছরে ইলিশের আকাল দেখা দেবে। যাঁরা এসব ইলিশের পোনা নির্বিচার ধরে এবং যাঁরা এসব বন্ধে দায়িত্ব পালন করেন না, তাঁরা উভয়ই দেশের শত্রু। ইলিশসম্পদ রক্ষায় এখন আর উদাসীনতা দেখানোর কোনো সুযোগ নেই।

মেঘনা অববাহিকার নদ-নদী বিষখালী, পায়রা, বলেশ্বর, তেঁতুলিয়া, আন্ধারমানিক, রামনাবাদ, ইলিশা, কালাবদর, লতা, মাসকাটা, বদরটুনি, কীর্তনখোলার মাছঘাটগুলোও এখন মাছের অভাবে খাঁ খাঁ করছে। তেমনি গভীর সাগরেও তেমন ইলিশের দেখা পাচ্ছেন না জেলেরা।

জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে আমাদের বর্ষা মৌসুমে এখন হেরফের হচ্ছে। ইলিশের প্রজনন, উৎপাদনেও তাই হেরফের হচ্ছে। বৃষ্টি, নদীতে স্রোত, পানির চাপ—এর সঙ্গে ইলিশের প্রজনন-উৎপাদন সম্পর্কিত।
আনিসুর রহমান, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, চাঁদপুরে অবস্থিত মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট

বরগুনার পাথরঘাটায় অবস্থিত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মৎস্য অবতরণকেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মৌসুমের এমন সময়ে দেড় থেকে দুই হাজার মণ ইলিশ আসে। কিন্তু এবার ইলিশ আসছে একেবারেই কম। রোববার এই বন্দরে ইলিশ এসেছে ২২৫ মণ বা ৯ হাজার কেজি। আর সাগরে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর এক সপ্তাহে এই বন্দরে ইলিশ এসেছে প্রায় ১ হাজার ৪৫০ মণ। এই অবতরণকেন্দ্রে আকারভেদে মাছের দাম ৫৪ থেকে ৭০ হাজার টাকা মণ।

আরও পড়ুন

পাথরঘাটা বিএফডিসির মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের বিপণন কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার সরকার প্রথম আলোকে বলেন, এখন মাছ আসছে কম, তাই দামও বেশি। মাছের আমদানি বাড়লে দামও কমে আসবে হয়তো।

জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উপকূলের জেলেরা জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর—এই তিন মাস ইলিশের মৌসুম ধরেন। কিন্তু কয়েক বছর ধরেই এ সময়ে নদীতে ইলিশের আকাল থাকে।

ইলিশ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আগে বর্ষা মৌসুম ছিল আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে। নব্বইয়ের দশকেও এই মৌসুমে প্রচুর বৃষ্টি হতো। কিন্তু ২০০৭ সালের পর দেশের ঋতুগুলোতে বেশ পরিবর্তন আসায় এখন বর্ষা মৌসুম সরে গিয়ে আগস্ট-সেপ্টেম্বর কিংবা অক্টোবরে চলে গেছে। যেহেতু ইলিশের উৎপাদন-প্রজনন সবকিছুই আবর্তিত হয় বর্ষা ও নদীর উঁচু জোয়ার, স্রোতকে ঘিরে, তাই ইলিশের মৌসুমও সরে গেছে। আর ভালো ব্যবস্থাপনার কারণে এখন শীতেও ব্যাপক হারে ইলিশ মিলছে। ফলে শীতে ইলিশের বর্ধিত একটি মৌসুম পরিলক্ষিত হচ্ছে।

চাঁদপুরে অবস্থিত মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আনিসুর রহমান রোববার দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, এখন জুন-জুলাইকে নয়; মূলত সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসকে ইলিশের মূল মৌসুম ধরা হয়।। তাই এই সময়ে ইলিশ না পাওয়ায় হতাশার কিছু নেই। সামনে আগস্ট মাস। এই মাসের প্রথম সপ্তাহে যে পূর্ণিমা আছে, তখন থেকেই মূলত ইলিশের মূল মৌসুমের সূচনা হবে।

আনিসুর রহমান বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে আমাদের বর্ষা মৌসুমে এখন হেরফের হচ্ছে। ইলিশের প্রজনন, উৎপাদনেও তাই হেরফের হচ্ছে। বৃষ্টি, নদীতে স্রোত, পানির চাপ—এর সঙ্গে ইলিশের প্রজনন-উৎপাদন সম্পর্কিত। একই সঙ্গে পদ্মা-মেঘনাসহ উপকূলের নদ-নদীতে প্রচুর অবৈধ জাল, ডুবোচর ও দূষণের কারণেও নদ-নদীতে ইলিশ আসতে বাধা পাচ্ছে।’

আরও পড়ুন