‘ম্যাডাম, লম্বা ছুটি পাইছি, মামাবাড়ি বেড়াইতে যাইমু’ বলা সোনিয়াও না ফেরার দেশে

সোনিয়া সুলতানা পড়ত দ্বিতীয় শ্রেণিতে
ছবি: সংগৃহীত

সোনিয়া সুলতানা (৮) পড়ত দ্বিতীয় শ্রেণিতে। মুখে সব সময় হাসি লেগে থাকত। শিক্ষকেরা তাকে খুব আদর করতেন। সপ্তাহখানেক আগে বিদ্যালয়ে প্রায় এক মাসের ছুটি ঘোষণা হয়। এ সময় সোনিয়া খুশি হয়ে শিক্ষকদের বলেছিল, লম্বা ছুটিতে মামার বাড়িতে বেড়াতে যাবে সে। তবে তা আর হয়নি। পরিবারের আর সবার সঙ্গে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছে ছোট্ট সোনিয়াও।

সোনিয়াদের বাড়ি মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার গোয়ালবাড়ী ইউনিয়নের পূর্ব গোয়ালবাড়ী গ্রামে। তাদের টিনের চালা আর বেড়ার তৈরি বসতঘরের ওপর দিয়ে টানানো ১১ হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ লাইন। গতকাল মঙ্গলবার ভোরে বজ্রপাতসহ ঝড়-বৃষ্টিতে লাইনের খুঁটি থেকে একটি তার ছিঁড়ে ঘরটির ওপর পড়ে যায়। এতে ঘরটি বিদ্যুতায়িত হয়ে পড়ে। পরিবারের সদস্যরা জীবন বাঁচাতে দরজা খুলে বাঁচার চেষ্টা করেন। এ সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই সোনিয়ার বাবা বাক্‌প্রতিবন্ধী দিনমজুর ফয়জুর রহমান (৫০), মা শিরি বেগম (৪৫), বড় বোন সামিয়া সুলতানা (১৪), সাবিনা আক্তার (১১) ও ছোট ভাই সায়েম আহমদ (৭) মারা যায়। গুরুতর দগ্ধ অবস্থায় সোনিয়াকে প্রথমে সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাতে ঢাকায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে দিবাগত রাত চারটার দিকে মারা যায় সোনিয়া।

আরও পড়ুন

সোনিয়া সুলতানা গোয়ালবাড়ী ইউনিয়নের উত্তর গোয়ালবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ত। তাঁর মৃত্যুর খবরে ওই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরাও সবাই বিমর্ষ। সহকারী শিক্ষক হুছনে আরা আক্তার কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘সব শিক্ষার্থীকেই ভালোবাসি। তবে সোনিয়াকে কেন জানি একটু বেশি ভালোবাসতাম। হাসিমাখা মুখে আর আমাদের সালাম দেবে না, কথা বলবে না, ভাবতেই পারছি না।’

হুছনে আরা আক্তার বলেন, পবিত্র রমজান, ঈদুল ফিতরসহ নানা অনুষ্ঠানের জন্য ২১ মার্চ থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত বিদ্যালয়ে ছুটি ঘোষণা করা হয়। ছুটির ঘোষণা শুনে সোনিয়া বলেছিল, ‘ম্যাডাম, লম্বা ছুটি পাইছি, কয় দিনের লাগি মামাবাড়ি বেড়াইতে যাইমু।’ হাসিমুখে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিল। এটা যে শেষ বিদায়, কে ভেবেছিল।

দুর্ঘটনায় নিহত সোনিয়ার ছোট ভাই সায়েম আহমদও (৭) একই বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে পড়ত। আর বড় দুই বোন সামিয়া সুলতানা (১৪) স্থানীয় হাজী ইনজাদ আলী উচ্চবিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে ও সাবিনা আক্তার (১১) স্থানীয় নওয়াবাজার ফাজিল মাদ্রাসায় ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ত।

আরও পড়ুন

আজ বুধবার সকাল ৯টার দিকে সোনিয়াদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ফাঁকা পড়ে আছে ফয়জুরের বসতঘরটি। অথচ দুই দিন আগেও এই ঘরে পরিবারের সবাই ছিলেন। ঘরের সামনেই ইটবিছানো পূর্ব গোয়ালবাড়ী গ্রামের রাস্তা। ফয়জুরের ঘরের দিকে তাকিয়ে ওই রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা ইব্রাহীম আলী (৬০)। তিনি বলেন, দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া সোনিয়া চিকিৎসায় সেরে উঠতে পারে, এমনটাই আশা ছিল তাঁদের। কিন্তু শেষমেশ তা হলো না। ছয়টি তরতাজা প্রাণ চলে গেল।
স্থানীয় বাসিন্দা মকবুল আলী (৫৫) বলেন, ‘ফজরের নামাজ পড়ি হুনলাম, বাইচ্চাটাও (সোনিয়া) দুনিয়াত নাই। পরিবারর আর কেউ রইল না। আল্লাহ তারার বেহেশত নসিব করুন।’

ঘটনা তদন্তে আরইবির কমিটি

দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ প্রধান প্রকৌশলী বিশ্বনাথ শিকদারকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে। গতকাল এ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির (পবিস) বড়লেখা আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক সোহেল রানা চৌধুরী আজ সকালে প্রথম আলোকে বলেন, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলায় তাঁদের ২ হাজার ২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ বিদ্যুৎ লাইন আছে। এ লাইনগুলো পুরোনো। জনসংখ্যা বাড়ায় বিভিন্ন স্থানে অনেকে লাইনের নিচে নানা স্থাপনা হয়েছে। পূর্ব গোয়ালবাড়ীতেও একই ঘটনা ঘটেছে। ঝুঁকিপূর্ণ লাইনের বিষয়ে তাঁদের কাছে কেউ অভিযোগ করেন না। এরপরও তাঁদের কর্মীরা খোঁজখবর নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানের লাইন অপসারণের কাজ করে থাকেন বলে দাবি করেন তিনি।

জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি

প্রথম আলোর মৌলভীবাজারের নিজস্ব প্রতিবেদক জানিয়েছেন, জুড়ীতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে একই পরিবারের ছয়জনের মৃত্যুর ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে জেলা প্রশাসন থেকে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে মৌলভীবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. আবদুস সালাম চৌধুরীকে। কমিটিকে আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।