পঞ্চগড়ের ক্ষতিগ্রস্ত আহমদিয়ারা আতঙ্ক নিয়ে ঘরে ফেরার চেষ্টা করছেন

বসবাসের জন্য বাড়ির এক কোণে পলিথিনের ঝুপড়ি তৈরি করেছেন মোমেনা বেগম। গতকাল বিকেলে পঞ্চগড়ের সোনাচান্দি এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

পুড়ে যাওয়া বাড়ির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে নড়বড়ে সিমেন্টের খুঁটিগুলো। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আঁকা-বাঁকা টিন। ছাইয়ে কালো হয়ে আছে পুড়ো উঠোন। তারই এক কোণে পলিথিনের ঝুপড়ি তৈরি করে শুয়ে আছেন মোমেনা বেগম (৫০)। মানুষের কণ্ঠ শুনতেই বের হয়ে এলেন তিনি। বললেন, ‘কিছুই নেই। কয়েক দিন স্বামীসহ (রমজান আলী) মসজিদে ছিলাম। কিন্তু ভিটায় তো ফিরতে হবে। এ জন্য দুদিন ধরে পলিথিন টানিয়ে এখানেই থাকছি। এখানে জায়গা না থাকায় পাশের মসজিদে ছেলে আর বউমা (পুত্রবধূ) থাকছে।’

গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে পঞ্চগড়ের সোনাচান্দি এলাকায় গিয়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের পুড়ে যাওয়া বাড়িঘরে গিয়ে এমন চিত্রই দেখা গেছে। আতঙ্ক থাকলেও নিজের ভিটার ফেরার চেষ্টা করছেন ক্ষতিগ্রস্তদের কেউ কেউ।

মোমেনাদের প্রতিবেশী রফিক আফ্রাদের (৭০) বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পুড়ে যাওয়া বাড়িঘরগুলো আগের মতোই এলোমেলোভাবে পড়ে আছে। বাড়ির উঠোনে রাখা হয়েছে নতুন কিনে আনা খাট। আগুনে সামান্য বেঁচে যাওয়া রান্নাঘরটিতে উঁকি দিয়ে দেখা গেল, সেখানেও একটি নতুন খাট ঢোকানো হয়েছে।

আরও পড়ুন

কথা প্রসঙ্গে রফিক আফ্রাদ বললেন, ‘কয়েক দিন ধরে মসজিদে ছিলাম। কিন্তু ভিটা ফেলে রাখলে তো ভূতের ভিটা হবে। এ জন্য দুদিন থেকে বাড়ি ভিটার মধ্যে মাটিতে বিছানা করে শোয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু মাটিতে শুইতে পোকা মাকরের ভয় লাগে। এ জন্য আজকে (বৃহস্পতিবার) বাজার থেকে দুই হাজার টাকা দরের দুটি খাট কিনে এনেছি। একটা আমাদের জন্য আর একটি ছেলে স্বপন আফ্রাদের জন্য।’

গত ৩ মার্চ (শুক্রবার) পঞ্চগড়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ‘সালানা জলসা’ বন্ধের দাবিতে করা বিক্ষোভ থেকে আহম্মদনগর, ফুলতলা, শালশিড়ি ও সোনাচান্দি এলাকার দুই শতাধিক ব্যক্তির বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা হয়। আহমদিয়ারা ওই দিন দুপুরে বাড়িঘরে তালা দিয়ে জলসায় ছিলেন। এ সুযোগে বিকেল থেকেই দুষ্কৃতকারী ব্যক্তিরা তাঁদের বাড়িঘরে প্রথমে হামলা চালান। লুট করে নিয়ে যান সর্বস্ব। পরে বাড়িঘরে আগুন দিয়ে চলে যান তাঁরা। এ ঘটনার প্রায় ১৩ দিন পর ক্ষতিগ্রস্ত বেশির ভাগ ঘরবাড়ি পড়ে থাকলেও স্বল্প সংখ্যক লোকজন তাঁদের ঘরে ফেরার চেষ্টা করছেন।

নতুন খাট কিনেছেন রফিক আফ্রাদ। গতকাল বিকেলে পঞ্চগড়ের সোনাচান্দি এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ক্ষতিগ্রস্তরা জানান, ঘটনার পর থেকে এক কাপড়েই ছিলেন তাঁরা। তবে কয়েক দিন ধরে আহমদিয়া জামাত থেকে ধীরে ধীরে তাঁদের জন্য কিছু কাপড়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আহমদিয়া সম্প্রদায়ের আহম্মদনগর মসজিদ ও শালশিড়ি মসজিদে রান্না করে তাঁদের খাবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

আহমদিয়াদের হিসাব অনুযায়ী, আহম্মদনগর এলাকায় ২০৬টি বাড়ি, একটি ওয়াক্তিয়া মসজিদ ও দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও হামলা হয়। ক্ষতিগ্রস্ত এসব বাড়িঘরের তালিকা করে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করেছেন আহমদিয়া জামাতের নেতারা। এতে তাঁদের প্রায় ১০ কোটি টাকা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করছেন আহমদিয়ারা। জেলা প্রশাসনের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ কমিটির তালিকা অনুযায়ী, হামলায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৩ কোটি ৯২ লাখ ৭০ হাজার টাকা।

আরও পড়ুন

এরই মধ্যে রেলপথমন্ত্রী ও পঞ্চগড়- আসনের সংসদ সদস্য নূরুল ইসলাম এবং পঞ্চগড়-১ আসনের সংসদ সদস্য তাঁদের শাড়ি, লুঙ্গি, কম্বল ও চাল দিয়ে সহায়তা করেছেন। এ ছাড়া গত বুধবার প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে আহমদিয়াদের এক কোটি টাকা সহায়তা দেওয়া হয়েছে। আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ক্ষতিগ্রস্ত ২০৬ জন ব্যক্তির মাঝে সর্বনিম্ন ৪ হাজার ৮০৩ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫ লাখ ২৬ হাজার ৩৬৬ টাকার চেক প্রদান করা হয়।

আরও পড়ুন

হারুন অর রশিদ নামে এক ভুক্তভোগী বলেন, বাড়িতে বিদেশি আটটি গরুর খামার ছিল তাঁর। হামলা-অগ্নিসংযোগের সময় প্রতিবেশীদের সহায়তায় তাঁর গরুগুলো রক্ষা পেলেও পুরো বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ঘরের সবকিছুই লুটপাট করে নিয়েছে হামলাকারীরা। বৃহস্পতিবার তিনি একটি ঘর পরিষ্কার করেছেন। আশা করছেন শুক্রবার থেকে সেখানে থাকবেন।

শালশিড়ি এলাকার মীর আবদুল হাফিজ বাড়ির সামনের পুড়ে যাওয়া দোকানটিতে মিস্ত্রি দিয়ে মেরামত করছেন। দিয়েছেন নতুন টিনের ছাউনি। হাফিজ বললেন, বাড়িঘরের সঙ্গে দোকানটাও পুড়ে দিয়েছে হামলাকারীরা। দোকানের সব মালামাল লুটপাট হয়েছে। গত বুধবার প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক সহায়তার ৭২ হাজার ৩৯ টাকা পেয়েছেন তিনি। সেই টাকা দিয়েই আপাতত সংসার চালানোর জন্য দোকানটি ঠিকঠাক করছেন।

আহম্মদনগর এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত মাহমুদ আহমদ বলেন, আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর থেকে সব বাড়িতেই বিদ্যুতের সংযোগ নেই। পুরো গ্রাম অন্ধকার হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে কেউ কেউ আলো জ্বালানোর জন্য বিদ্যুতের সংযোগ স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ বাড়িতে ফেরার চেষ্টা করছেন। তবে তাঁদের খাওয়া-দাওয়া ব্যবস্থা এখনো জামেয়া (আহমদিয়াদের ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান) থেকে ও মসজিদ থেকে করা হচ্ছে।

পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক তদারকিতে বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। তাঁরা ধীরে ধীরে নিজেদের ঘরে ফিরবেন বলে আহমদিয়া জামাতের পক্ষ থেকে আমাদের জানিয়েছে। আহমদিয়াদের ঘরে ফিরতে যে কোনো ধরনের অসুবিধা না হয় সে জন্য নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। তাঁদের ওপর যেন আর কোনোভাবে হামলা বা অন্যায় করা না হয় সে জন্য প্রশাসন সজাগ রয়েছে।

আরও পড়ুন