এমন পরিণতি যেন আর কারও না হয়: বিভুরঞ্জনকে নিয়ে ছোট ভাই
সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারের মতো পরিণতি যেন আর কারও না হয়, সেই প্রার্থনা করেছেন তাঁর ছোট ভাই চিররঞ্জন সরকার। শুক্রবার রাতে মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের মর্গে ভাইয়ের লাশ শনাক্ত করার পর এ কথা বলেন তিনি।
বিভুরঞ্জন সরকারের পরিবারের কারও সঙ্গে কোনো মনোমালিন্য ছিল না জানিয়ে চিররঞ্জন সরকার বলেন, ‘কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীদের সঙ্গে কিছু ছিল কি না আমরা জানি না। এটি আত্মহত্যা, না খুন, না পরিকল্পিত কোনো ঘটনা, আমরা জানি না। এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। তিনি কীভাবে মারা গেলেন, সেটি আমরা জানি না। আমি শুধু এই টুকুই বলব, এমন পরিণতি যেন আর কারও না হয়।’
৭১ বছর বয়সী বিভুরঞ্জন সরকার দৈনিক আজকের পত্রিকার জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক ছিলেন। গত বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে কর্মস্থলে যাওয়ার কথা বলে রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীর বাসা থেকে বের হন তিনি। এর পর থেকে তাঁর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না।
শুক্রবার বিকেলে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় মেঘনা নদীতে একজনের মরদেহ ভাসতে দেখে ৯৯৯–এ ফোন করে পুলিশকে জানান স্থানীয় ব্যক্তিরা। নৌ পুলিশের সদস্যরা গিয়ে বিকেল পৌনে চারটার দিকে লাশটি উদ্ধার করেন। লাশ দেখে নিখোঁজ সাংবাদিক বিভুরঞ্জনের মনে হওয়ায় ছবি তুলে ঢাকার রমনা থানায় পাঠান তাঁরা। সেই ছবি দেখে ঢাকা থেকে মুন্সিগঞ্জে যান বিভুরঞ্জনের ভাই চিররঞ্জন সরকার ও ছেলে ঋত সরকার। রাত পৌনে নয়টায় মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের মর্গে গিয়ে লাশটি শনাক্ত করেন তাঁরা।
বাবার লাশ দেখে আসার পর ঋত সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাবার নাক দিয়ে রক্ত ঝরছিল, কিছু আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এটি আসলে কী কারণে হচ্ছে, আমরা বুঝতে চাই। যাঁরা এ বিষয়ে অভিজ্ঞ, তাঁদের মাধ্যমে বিষয়টি পরিষ্কার হতে চাই।’
তাঁর বাবা কোনো কারণে চিন্তিত বা হতাশাগ্রস্ত ছিলেন কি না, সে প্রশ্নের জবাবে ঋত সরকার বলেন, ‘আমার বাবা স্বাভাবিকভাবে সব সময় শান্ত থাকতেন। তাঁর মধ্যে ব্যতিক্রম কোনো কিছু লক্ষ করিনি। হতাশাগ্রস্ত ছিলেন কি না, সেটি আমরা ঠিক বলতে পারছি না। তিনি প্রতিদিনের মতো স্বাভাবিকভাবেই বৃহস্পতিবার সকালে খেয়ে, ইনসুলিন নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন। যাওয়ার আগে মাকে বলে গিয়েছিলেন বিকেল পাঁচটা, সাড়ে পাঁটার দিকে বাড়িতে ফিরে আসবেন। বিকেল পাঁচটার পরে যখন বাবা ফিরে আসেননি, তখন আমরা তাঁর মুঠোফোনে ফোন করি। ফোনটা বন্ধ পাই। পরবর্তীতে আমরা রমনা থানায় জিডি করি।’
ঋত সরকার বলেন, ‘বাবা পরিচিত কারও সঙ্গে আছেন কি না, নিশ্চিত হওয়ার জন্য তাঁর বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতদেরও ফোন করি। যখন নিখোঁজের ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে যায়, তখন আমরা আরও বেশি চিন্তিত হই। তখন বেশি খোঁজাখুঁজি শুরু হয়। সকালে আমাদের বাসায় পুলিশ এসেছিল। আমরা বাবার ফোনটি বাড়িতে পাই।’
বিভুরঞ্জন সরকার বৃহস্পতিবার সকালে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় মুঠোফোনটি বন্ধ করে রেখে গিয়েছিলেন বলে জানান তাঁর ছোট ভাই চিররঞ্জন সরকার। তিনি বলেন, ‘বৃহস্পতিবার রাতটি চরম উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে গেছে। আজকেও আমরা নানাভাবে চেষ্টা করেছি কোথাও তাঁর কোনো সন্ধান পাওয়া যায় কি না।’
পুলিশের তদন্তে তাঁর ভাইয়ের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ বেরিয়ে আসুক, সেই প্রত্যাশা জানান চিররঞ্জন সরকার।
বিভুরঞ্জন সরকারের নিখোঁজ হওয়ার খবর প্রকাশের পর শুক্রবার বিকেল ৫টা ২৩ মিনিটে অনলাইন সংবাদমাধ্যম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে ‘খোলা চিঠি’ শিরোনামে তাঁর একটি লেখা প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়, বৃহস্পতিবার সকাল সোয়া নয়টায় চিঠিটি তিনি তাদের মেইল করেছিলেন। ‘জীবনের শেষ লেখা হিসেবে এটা ছাপতে পারেন।’ ফুটনোট দেওয়া ওই লেখায় বিভুরঞ্জন সরকার সাংবাদিকতা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ নানা ঘটনা, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ও গণমাধ্যম পরিস্থিতি, নিজের ও ছেলের অসুস্থতা, মেডিকেল পাস সরকারি কর্মকর্তা মেয়ের উচ্চতর পরীক্ষায় অসফল হওয়া, বুয়েট থেকে পাস করা ছেলের চাকরি না হওয়া এবং নিজের আর্থিক দৈন্যদশা নিয়ে হতাশার কথা তুলে ধরেন।
ওই চিঠি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা চলছে। চিঠির বিষয়ে জানতে চাইলে চিররঞ্জন সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার পরিবারের কেউ কারও সঙ্গে তেমন কথা বলি না। আমার ভাইয়ের একটা মেয়ে আছে। মেয়ের ঘরে একটি নাতি আছে। সেই ছোট নাতির সঙ্গে ভাই অনেক কথা বলতেন। তাই এ বিষয়টি আমরা তেমন লক্ষ করিনি।’
বিভুরঞ্জন সরকারের স্ত্রীর ভাই দীপঙ্কর সাহা চিঠির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, চিঠিটি তাঁরা আগে দেখেননি। যদি দেখতেন, তাঁকে বাড়ি থেকে বের হতে দিতেন না।