বনরক্ষীদের অভিযোগ, সুন্দরবনের অপরাধীরা একজোট হয়ে ষড়যন্ত্র করছে

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবনপ্রথম আলো ফাইল ছবি

খুলনার কয়রা উপজেলার সুন্দরবনসংলগ্ন গ্রামে নানা কৌশলে হরিণ শিকার করে কয়েকটি দল। তাদের ঠেকাতে অভিযান চালানোর পর তোপের মুখে পড়েছেন বন কর্মকর্তারা। হরিণশিকারিসহ সুন্দরবনকেন্দ্রিক অপরাধী চক্র এককাট্টা হয়ে নানামুখী ষড়যন্ত্র শুরু করেছে বলে বনরক্ষীদের অভিযোগ।

গত ১২ মার্চ সুন্দরবনের হায়াতখালী টহল ফাঁড়ির বনরক্ষীরা অভিযানে গিয়ে বনের মধ্যে হরিণশিকারের ফাঁদ দেখতে পান। এ সময় হরিণশিকারিদের একটি দল বনরক্ষীদের দেখে বনের ভেতর পালিয়ে যায়। তবে বনরক্ষীরা শিকারিদের চিনতে পেরে ছয়জনের নাম উল্লেখ করে একটি মামলা করেন। গত ৪ এপ্রিল আবার বন থেকে হরিণ শিকারের ফাঁদ উদ্ধার হলে আবারও ছয়জনের নামে মামলা করে বনরক্ষীরা। এরপর হরিণশিকারিসহ সুন্দরবনের অপরাধী চক্র এককাট্টা হয়ে স্থানীয় বন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে হয়রানির অভিযোগ এনে মানববন্ধনসহ সংবাদ সম্মেলন করে।

সুন্দরবনের বানিয়াখালী ফরেস্ট স্টেশন কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবনকেন্দ্রিক অপরাধী চক্রের মূল হোতা উপজেলার মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল গনির ছেলে শহিদুল ইসলাম। তিনি হরিণশিকারি চক্রের জন্য বনসংলগ্ন খোড়লকাটি বাজারে লায়ন্স স্পোর্টিং ক্লাব নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছেন। ওই সংগঠনের সভাপতি তিনি। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, ওই ক্লাব ঘিরে বন অপরাধের সব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো। সম্প্রতি র‍্যাবের অভিযানে ক্লাবটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

খোড়লকাটি বাজারসংলগ্ন সুন্দরবনের ওই অংশটি বানিয়াখালী ফরেস্ট স্টেশনের আওতাধীন। স্টেশন কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম বলেন, শহিদুলের দলে ৩০ জনের মতো সদস্য আছে। তারা হরিণ শিকার, বিষ দিয়ে মাছ শিকারসহ বনকেন্দ্রিক নানা অপরাধে জড়িত। এই দলের নেতা শহিদুলসহ অধিকাংশ সদস্য একাধিক বন মামলার আসামি।
এসব ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিরা সম্প্রতি জেলেদের হয়রানির অভিযোগ এনে স্টেশন কর্মকর্তা মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে মাঠে নামেন। ১০ মে মনিরুলের বিরুদ্ধে মানববন্ধন ও ১৬ মে সংবাদ সম্মেলন করা হয়। মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলনে শহিদুলের বাবা আবদুল গনি দাবি করেন, তাঁর ছেলে বনসংক্রান্ত কোনো অপরাধে জড়িত নন। বরং বানিয়াখালী ফরেস্ট স্টেশন কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম, হায়াতখালী বন টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জেলেদের হয়রানি করতে অহেতুক মামলা করেছেন।

আরও পড়ুন

অভিযুক্ত শহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি সুন্দরবনের কোনো ব্যবসার সঙ্গেই জড়িত না। বনরক্ষীদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সুন্দরবনে সব ধরনের প্রকার অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। অবৈধ জেলেদের আটক তো দূরের কথা, বরং তাদের বিষ দিয়ে মাছ ধরা, কাঠ পাচার ও হরিণ শিকারের জন্য মোটা অঙ্কের টাকায় চুক্তিবদ্ধ হন বন কর্মকর্তারা। বনে মাছ ধরতে গেলে সব সময় মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করেন, যা সাধারণ জেলেদের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। ফলে যারা বিষ দিয়ে মাছ শিকার করে, বন্য প্রাণী শিকার করে, তাদের সঙ্গে বন কর্মকর্তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এসব বিষয়ে প্রতিবাদ করায় আমিসহ নিরীহ মানুষের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে।’

সুন্দরবনের কাশিয়াবাদ স্টেশন কর্মকর্তা নির্মল মণ্ডল বলেন, তিনি বানিয়াখালী স্টেশনে কর্মরত থাকাকালীন শহিদুল ও তাঁর চক্র বিষ দিয়ে মাছ শিকার করত। তাদের এ কাজে বাধা দেওয়ায় প্রথমে বিভিন্ন প্রলোভনে সমঝোতার চেষ্টা করে। ব্যর্থ হয়ে নারী নির্যাতনের মামলার হুমকি দেয়। পরে শহিদুলের নেতৃত্বে বনরক্ষীদের ওপর হামলা চালায় অপরাধীরা। এ ঘটনায় ২৩ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করা হয়। সেটি চলমান।

বনের এমন কোনো অপরাধ নেই, যা শহিদুল ইসলাম ও তাঁর লোকজন করে না বলে মন্তব্য করেন হযরত আলী সরদার নামে স্থানীয় একজন বাসিন্দা। তিনি বলেন, তারা রাত–দিন ওই ক্লাবে আড্ডা দেয় আর যাবতীয় অপকর্ম করে বেড়ায়। বনরক্ষীরা বাধা দিতে এলেই তাঁদের ওপর হামলার হুমকি দেয়। এ কারণে ভয়ে বনরক্ষীরা বাজারেও আসেন না। এদের যন্ত্রণায় এলাকার সাধারণ জেলে-বাওয়ালিরাও অতিষ্ঠ।

আরও পড়ুন

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একজন স্কুলশিক্ষক বলেন, বাবা আওয়ামী লীগের নেতা হওয়ায় অপরাধ করে পার পাওয়ার চেষ্টা করেন শহিদুল। এই এলাকার বনকেন্দ্রিক যাবতীয় অপরাধে জড়িত তিনি। এলাকার মানুষ ভয়ে মুখ খুলতে চান না তাঁর বিরুদ্ধে।

সুন্দরবন খুলনা রেঞ্জের হায়াতখালী বন টহল ফাঁড়ির কমিউনিটি প্যাট্রোলিং গ্রুপ (সিপিজি) সদস্য আবদুল হামিদ শেখ বলেন, ইউপি সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল গনির ছেলে শহিদুল ইসলাম সুন্দরবনের সব ধরনের অবৈধ কাজের সঙ্গে জড়িত। তাঁর মদদে বিষ প্রয়োগ করে মাছ ও হরিণ শিকার এবং কাঠ পাচার করে থাকেন অসাধু জেলেরা।

খোড়লকাটি এলাকায় সুন্দরবনকেন্দ্রিক একটি বড় অপরাধী চক্র আছে জানিয়ে মহেশ্বরীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহনেওয়াজ বলেন, অপরাধীরা বন কর্মকর্তাদেরও নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। অনেক সময় ব্যর্থ হয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

আরও পড়ুন

সুন্দরবন খুলনা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক এ জেড এম হাছানুর রহমান বলেন, সুন্দরবনে হরিণশিকারি ও অপরাধী চক্রের দৌরাত্ম্য নির্মূলে বন বিভাগ চোরা শিকারিদের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করছে। যাদের বিরুদ্ধে বন আইনে মামলা হচ্ছে, তাঁরা বন বিভাগের তালিকাভুক্ত হরিণশিকারি। যাঁরা বন বিভাগের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছে, তাঁরা মূলত সুন্দরবনকে ধ্বংস করতে চায়। তাঁদের মূল উদ্দেশ্য বন বিভাগের অভিযান বন্ধ হোক। তাহলে অপরাধীরা নির্বিঘ্নে হরিণ শিকার করতে পারবে। তিনি বলেন, ‘আমরা অপরাধীদের মানববন্ধন কিংবা মিথ্যা রটনাকে গুরুত্ব দিচ্ছি না। বরং আমাদের তৎপরতা আরও বৃদ্ধি করেছি।’