সুনামগঞ্জের হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধের কাজে ধীরগতি

সুনামগঞ্জের খরচার হাওরের হরিমনের ভাঙা এলাকায় ফসল রক্ষা বাঁধে এখনো মাটি পড়েনি। অথচ স্থানটি ঝুঁকিপূর্ণ। গতকাল দুপুরেছবি: প্রথম আলো

সুনামগঞ্জে হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণের নির্ধারিত সময় ৭৫ দিন। এর মধ্যে ৩৩ দিন চলে গেছে, বাকি আছে ৪২ দিন। এই সময়ের মধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) হিসাবে কাজের অগ্রগতি ১০ শতাংশ। গত সোমবার পর্যন্ত বাঁধের জন্য নেওয়া ৭৩৩টি প্রকল্পে মধ্যে কাজ শুরু হয়েছে ৩৯০টিতে। কিন্তু পাউবোর এই হিসাব মানতে নারাজ ‘হাওর বাঁচাও আন্দোলন’–এর সদস্যরা। তাঁদের দাবি, মাঠের অবস্থা ভালো না।
গতকাল মঙ্গলবার জেলার তিনটি উপজেলার হাওরে ঘুরে ‘অবস্থা ভালো না’ কথার অনেকটাই মিল পাওয়া যায়। অনেক প্রকল্পে এখনো মাটি পড়েনি। আবার কোনো কোনো প্রকল্পে কাজ শুরু হয়েছে মাত্র। কোনোটিতে কাজ শুরুর প্রস্তুতি চলছে। স্থানীয় কৃষকেরা বলছেন, হাওরে বাঁধ নির্মাণ পুরোনো বৃত্তেই আটকে আছে। শুরুতে ‘ঢিলেমি’ আর শেষে ‘তাড়াহুড়া’। এবারও মাঠে তাই হচ্ছে।
কাজ শুরুতে বিলম্বের কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা হাওর থেকে পানি নামতে দেরি ও মাটির কাজের জন্য খননযন্ত্রের (এক্সকাভেটর) অপ্রতুলতার সঙ্গে এবার নির্বাচনকে সামনে আনছেন।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সব প্রকল্পের কাজ যত দ্রুত সম্ভব শুরু করতে হবে। আমরা মাঠে কঠোর তদারকি করব। কাজে কোনো ধরনের গাফিলতি হলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার বড় ধানের হাওর হলো খরচার হাওর। এই হাওরের ফসল রক্ষায় হাওরের পশ্চিমপাড়ের ঘটঘটিয়া নদের তীর ঘেঁষে ১০টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। উপজেলার রাধানগর থেকে দক্ষিণ দিকে একেবারে জিরাক তাহিরপুর গিয়ে শেষ হয়েছে এই বাঁধ। এই ১০টি প্রকল্পের মধ্যে পাঁচটিতে এখনো কোনো কাজ শুরু হয়নি। বাকি পাঁচটির মধ্যে একটিতে কাজ শুরু হয়েছে তিন দিন আগে। আরেকটিতে ১৫ ডিসেম্বর কিছু মাটি ফেলে আর কাজ হয়নি।

আরও পড়ুন

গতকাল সকালে সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, রাধানগর গ্রামের পাশে হাওর থেকে কয়েকটি ট্রাকে মাটি এনে বাঁধের একটি জায়গায় ফেলা হচ্ছে। সেখানে গিয়ে কথা হয় পাশের নতুন হাটি গ্রামের জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে। তিনিই কাজের তদারকিতে ছিলেন। জাহাঙ্গীর জানালেন, তিন দিন হয় কাজ শুরু হয়েছে। এক্সকাভেটর না পাওয়ায় কাজ শুরুতে বিলম্ব হয়েছে তাঁদের। এরপর পাশেই বাঁধের ‘হরিমণের ভাঙা’। এই স্থানটি এই বাঁধের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা (ক্লোজার)। কিন্তু সেখানে এখনো কোনো মাটি পড়েনি। এরপর রায়পুর, বাহাদুরপুর হয়ে গাছতলা পর্যন্ত বাঁধের কোনো কাজ শুরু হয়নি। গাছতলা বাজারের সামনে দুটি স্থানে কিছু মাটির স্তূপ করে রাখা। স্থানীয় কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এটি ফতেপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আবুদল হেকিমের কাজ। ১৫ ডিসেম্বর উদ্বোধনের দিন শুধু কিছু মাটি ফেলা হয়েছিল। এরপর আর মাটি পড়েনি। সেখান থেকেই আবদুল হেকিমের মুঠোফোনে কল দিলে তিনি ফোন ধরেননি।

সুনামগঞ্জের খরচার হাওরের পশ্চিমপাড়ে একটি ফসল রক্ষা বাঁধে মাটি ফেলা হচ্ছে। কাজ শুরু হয়েছে তিনদিন আগে। গতকাল দুপুরে
ছবি: প্রথম আলো

গাছতলা বাজারে আলাপকালে স্থানীয় কয়েকজন কৃষক জানালেন, ইচ্ছা করলে সময়মতো কাজ শুরু করা যায়। কিন্তু হয় না। কাজ শুরু করতে করতেই এক মাস চলে যায়। পরে যখন শুরু হয়, তখন তাড়াহুড়া লাগে। কাটাখালি গ্রামের বশির আহমদ (৭০) বলেন, ‘এখন তো মাটি পাওয়া যায় না। কাজে গতি বাড়াইত অইব। না অইলে সমস্যা অইব।’
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় বাঁধের কাজের দায়িত্বে থাকা পাউবোর শাখা কর্মকর্তা গোলাম কিবরিয়া জানালেন, এই উপজেলায় ৩১টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৮টিতে কাজ চলছে। এক সপ্তাহের মধ্যে সব প্রকল্পে কাজ শুরু হবে।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মফিজুর রহমান সব কাজ শুরু এবং কাজে গতি বাড়ানোর তাগিদ দিতে মঙ্গলবার বাঁধ নির্মাণ-সংক্রান্ত উপজেলা কমিটির সভা করেছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘সবাইকে বলে দেওয়া হয়েছে দ্রুত কাজ শুরু করার জন্য। আমরা কঠোর তদারকি করব।’

একইভাবে গতকাল ধর্মপাশা উপজেলার চন্দ্র সোনার থাল হাওর এবং মধ্যনগর উপজেলার ঘোড়াডোবা হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধের অন্তত ২০টি প্রকল্পের কাজ ঘুরে দেখা গেছে, অনেক প্রকল্পের কাজ এখানো শুরুই হয়নি। চন্দ্র সোনার থাল হাওরের ৭৫ নম্বর প্রকল্প বাস্তবায়নর কমিটির (পিআইসি) সভাপতি জিয়াউর রহমান বলেন, ‘আমরা এক্সকাভেটর ও ড্রাম ট্রাক আনার জন্য যাঁর সঙ্গে চুক্তি করেছিলাম, তিনি তা দিতে পারেননি। নতুন করে আরেকজনের সঙ্গে চুক্তি করেছেন। দু–এক দিনের মধ্যে কাজ শুরু করবেন।’
একই হাওরের ৬৪ নম্বর পিআইসির সদস্যসচিব আবদুল মান্নান বলেন, ‘হাওর থেকে পানি দেরিতে নামায় আমরা দুদিন হলো কাজ শুরু করেছি। সাইনবোর্ড বানাতে দিয়েছি। নির্ধারিত সময়েই কাজ শেষ করব।’

আরও পড়ুন

মধ্যনগর উপজেলার ঘোড়াডোবা হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধের ৬ নম্বর পিআইসির সভাপতি দিলীপ রায় ও ৭ নম্বর পিআইসির সভাপতি বিশ্বজিৎ রায় বলেন, এই দুই উপজেলার নয়টি হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধের ১২৮টি প্রকল্পের ২৭টিতে এখনো কাজ শুরুই হয়নি। যথাসময়ে কাজ শেষ না হওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয় কৃষকেরা।
শুধু এই তিন উপজেলাই নয়, জেলার ১২টি উপজেলার একই অবস্থা। জেলার যেসব উপজেলা বাঁধের কাজ বেশি হয়, সেগুলোর মধ্যে তাহিরপুর উপজেলায় সোমবার পর্যন্ত ৮২টি প্রকল্পের মধ্যে ৫২টিতে, জামালগঞ্জে ৪৪টির মধ্যে ১৭টিতে, শাল্লায় ১৩১টির মধ্যে ৪৮টি, দিরাইয়ে ১১০টির মধ্যে ৩২টি প্রকল্পে কাজ শুরু হয়েছে।
হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি বিজন সেন রায় বলেন, এবার কাজে শুরু থেকেই গাফিলতি আছে। সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে। নির্ধারিত সময়ে যদি এবারও কাজ শেষ না হয়, তাহলে ফসল ঝুঁকিতে পড়বে।

সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী ও জেলা হাওরে বাঁধ নির্মাণ-সংক্রান্ত জেলা কমিটির সদস্যসচিব মো. মামুন হাওলাদার মঙ্গলবার বিকেলে বলেন, এখন পুরোদমে কাজ শুরু হয়েছে। নির্বাচনের কারণে কাজে গতি কিছুটা কম ছিল।
পাউবো সূত্রে জানা গেছে, হাওরে একসময় ঠিকাদারদের মাধ্যমে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণের কাজ হতো। ২০১৭ সালে হাওরে ব্যাপক ফসলহানির পর বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এরপর পাউবো হাওরে বাঁধ নির্মাণে নতুন নীতিমালা করে। প্রতিটি প্রকল্পের জন্য প্রকৃত কৃষক ও স্থানীয় সুবিধাভোগীদের নিয়ে পাঁচ থেকে সাত সদস্যের একটি পিআইসি থাকে। একটি পিআইসি সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকার কাজ করতে পারে।