শতবর্ষী বারোয়ারি হাটে এখন বিক্রি হয় শুধু গরু-ছাগল আর বাঁশ-বেতের পণ্য

হাটে সাজিয়ে রাখা বাঁশ-বেতের তৈরি বিভিন্ন পণ্য ঘুরে ঘুরে দেখছেন ক্রেতারা। গত বৃহস্পতিবার মৌলভীবাজার সদর উপজেলার সরকার বাজারেছবি: প্রথম আলো

শত বছরের পুরোনো বাজারটি একসময় হাটবারে বারোয়ারি পণ্যে সয়লাব হয়ে উঠত। সপ্তাহে দুই দিন হাটে নানা রকম পণ্য নিয়ে হাজির হতেন বিক্রেতারা। দৈনন্দিন জীবনের নানা উপকরণ, কৃষি সরঞ্জামাদি কেনাকাটা করতে ভিড় করতেন আশপাশের গ্রামের মানুষ। এখনো সেই হাট আছে। ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড় আছে। শুধু নেই হাটের পুরোনো সেই বারোয়ারি চেহারাটা।

এই হাটের অবস্থান মৌলভীবাজার সদর উপজেলার সরকার বাজারে। এই হাটে এখন শুধু গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি এবং প্রায় হারিয়ে যাওয়া বাঁশ-বেতের তৈরি পণ্যই দেখা যায়। আদি সরকার বাজারের কাছেই বারোয়ারি পণ্যের নিয়মিত বাজার গড়ে উঠেছে। এতে পুরোনো হাটটি তার বারোয়ারি চেহারা হারিয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার ছিল সরকার বাজারের সাপ্তাহিক হাটবার। সপ্তাহে দুই দিন সাপ্তাহিক হাট বসে—রোববার ও বৃহস্পতিবার। তবে রোববার তেমন একটা জমে না এখন। প্রকৃত জমজমাট বাজারটি হয় বৃহস্পতিবার।

ঢাকা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কের মৌলভীবাজার সদর উপজেলার সরকার বাজার বাসস্ট্যান্ড এলাকা পার হয়ে কিছুটা উত্তরে গিয়ে গ্রামের দিকে ঢুকে গেছে একটি পাকা গ্রামীণ সড়ক। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে সেই সড়ক ধরে কয়েক মিনিটের দূরত্বে গিয়ে দেখা মেলে পুরোনো সরকার বাজারের।

গরু কেনাবেচা চলছে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার সরকার বাজারে। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে
ছবি: প্রথম আলো

তখন বাজারটি একেবারে পুরোদমে জমে ওঠার সময়। বাজারের বিশাল অংশজুড়ে বেঁধে রাখা হয়েছে নানা আকার ও রঙের গরু। সাধারণত কোরবানির ঈদের সময়টিতে বিভিন্ন মৌসুমি হাট-বাজারে এ রকম গরুর উপস্থিতি চোখে পড়ে। গরু কেনাকাটা চলছে। গরু নিয়ে কেউ হাট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। কেউ পিকআপ ভ্যানে তুলছেন। একপাশে ছাগল নিয়ে দাঁড়িয়েছেন বিক্রেতারা। এখানেও কেনাকাটা চলছে। একদিকে দেশি হাঁস-মুরগি নিয়ে বসে আছেন অনেকে। লোকজন আসছেন, দরদাম করছেন। কেউ কিছু কিনছেন, কেউ ঘুরে দেখছেন। যেমনটা যেকোনো হাটে হয়ে থাকে!

হাটের পূর্ব দিকে অনেকে বসেছেন বাঁশ-বেতের তৈরি পণ্য নিয়ে। এর কিছু আছে মাছ ধরার বিভিন্ন রকম ফাঁদ, কিছু গার্হস্থ্য জীবনের প্রতিদিনের কাজে ব্যবহারের পণ্য, কিছু কৃষি উপকরণ। এই বেতের তৈরি অনেক পণ্য একটা সময় চাল-ডাল, মাছ, মাংস, শাকসবজি ধোয়া, পরিবহনসহ বিভিন্ন কাজের জন্য প্রতিটি ঘরেই অপরিহার্য ছিল। এখনো তা প্রয়োজনীয়, তবে তা জাত বদলেছে। আগে ছিল বাঁশ-বেতের, এখন তা প্লাস্টিকের তৈরি।

আরও পড়ুন

ক্ষিতীশ সরকার ‘বসনি’ নামে বাঁশ-বেতের তৈরি মাছ ধরার ফাঁদ নিয়ে বসেছিলেন। তিনি বলেন, প্রায় ২০ বছর ধরে তিনি বসনি বানিয়ে বিক্রি করেন। প্রতি বৃহস্পতিবার হাটে বসনি বিক্রি করতে আসেন। হাটবারে দুই থেকে পাঁচ-ছয়টা বসনি বিক্রি হয় তাঁর। একটি বসনি বানাতে দুই-তিন দিন সময় লাগে। মুলি, গুয়ারি নামে এক জাতের বাঁশ দিয়ে পণ্যটি তৈরি করেন। একই পণ্য নিয়ে হাটে আসা সমীরণ সরকার বলেন, ‘একটা বিক্রি হয় নিচে ৭০০ টাকায়।’

শুধু বসনিই নয়, বাঁশ-বেতের তৈরি আরও বিভিন্ন জাতের ফাঁদ আছে। অন্যগুলোও হাটে নিয়ে এসেছেন অনেকে। এর মধ্যে আছে ডরি (চাঁই), রহুঙ্গা (উকা), পলোসহ আরও কিছু পণ্য। যত দিন আশপাশে পানি আছে, তত দিন কমবেশি এগুলো বেচা-বিক্রি চলে। চৈত্র-বৈশাখ থেকে অগ্রহায়ণ পর্যন্ত মাছ ধরার পণ্যের চাহিদা থাকে।

হাঁস-মুরগির বেচাকেনাও চলে হাটে। গত বৃহস্পতিবার মৌলভীবাজার সদর উপজেলার সরকার বাজারে
ছবি: প্রথম আলো

বাঁশ-বেতের পণ্যের ব্যবসায়ী মো. নাহিদ জানালেন, আগে রোববার ও বৃহস্পতিবার দুই দিনই বাজার জমত। কিন্তু এখন সরকার বাজার বাসস্ট্যান্ডে প্রতিদিন সব ধরনের পণ্যের বাজার বসে। যে কারণে ১০-১৫ বছর ধরে পুরোনো স্থানের বাজারটি তার আগের জৌলুশ হারিয়েছে।

আরও পড়ুন

আলাল মিয়া নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, সরকার বাজার ঐতিহ্যবাহী হাট। অনেক পুরোনো। শত বছর আগের। তাঁর দাদা, দাদারও দাদার আমল থেকে এটা চলে আসছে। এখানে হবিগঞ্জ, সিলেট থেকেও অনেকে আসেন।

স্থানীয় লোকজন বলেন, দুপুর ১২টা থেকে হাট জমতে শুরু করে। বিভিন্ন স্থান থেকে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, বেতের পণ্যসামগ্রী নিয়ে বিক্রেতারা আসতে শুরু করেন। বিকেলের আলো ফোরানোর আগেই হাট গুটিয়ে যায়। ক্রেতা-বিক্রেতারা যাঁর যাঁর পথে যেতে শুরু করেন।

আরও পড়ুন