প্রধান প্রকৌশলীকে কিলঘুষি, নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে লাঞ্ছিত করলেন ছাত্রলীগ নেতা

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাজু মুন্সি
ছবি: সংগৃহীত

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলীকে মারধর ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে লাঞ্ছিত করার অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগ নেতা রাজু মুন্সির বিরুদ্ধে। আজ সোমবার এ ঘটনার প্রতিবাদে গ্যাস, পানি ও বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে অবরোধ করেন প্রকৌশল দপ্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। পরে প্রক্টরের হস্তক্ষেপে বেলা ২টার দিকে তাঁরা অবরোধ প্রত্যাহার করেন। তবে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রাজু মুন্সিকে গ্রেপ্তার করা না হলে আবার অবরোধে যাবেন বলে জানানো হয়।

আজ বেলা ১১টায় ক্যাম্পাসের কাটা পাহাড় সড়কে ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী ছৈয়দ জাহাঙ্গীর ফজলকে মারধরের ঘটনা ঘটে। চাঁদা না দেওয়ায় বেলা সাড়ে ১১টায় নিরাপত্তা কর্মকর্তা শেখ মো. আবদুর রাজ্জাককে রাজু মুন্সি লাঞ্ছিত করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। রাজু মুন্সির বিচার চেয়ে ইতিমধ্যে প্রধান প্রকৌশলী, নিরাপত্তা কর্মকর্তাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রেজিস্ট্রার ও উপাচার্যকে চিঠি দিয়েছেন।

আরও পড়ুন

রাজু মুন্সি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেনের অনুসারী। ইকবাল হোসেন সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী। মারধরের বিষয়ে জানতে চাইলে রাজু মুন্সি বলেন, ‘ওই দুই কর্মকর্তা বিভিন্ন অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। আমি এর প্রতিবাদ জানিয়েছি। আমার প্রতিবাদের ভাষা এমনই। অভিযোগ দিলে দিক।’

দুই কর্মকর্তাকে লাঞ্ছিতের প্রতিবাদে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা–কর্মচারীদের অবস্থান কর্মসূচি। আজ রোববার দুপুর ১২টায় উপাচার্যের দপ্তরে
ছবি: প্রথম আলো

আজ দুপুর ১২টায় উপাচার্য দপ্তরে গিয়ে দেখা যায়, প্রকৌশল দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সবাই সেখানে অবস্থান নিয়েছেন। রাজু মুন্সির বিচার না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা প্রতিবাদ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। এ সময় প্রকৌশলী ছৈয়দ জাহাঙ্গীর ফজল বলেন, তিনি সকালে কাটা পাহাড় সড়ক পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। সেখানে রাজু মুন্সি তাঁকে হঠাৎ গালাগালি করতে থাকেন। এরপর অতর্কিতভাবে তাঁকে কিলঘুষি দেন। পরে সেখান থেকে তিনি প্রশাসনিক ভবনের সামনে চলে আসেন। সেখানেও রাজু মুন্সি তাঁকে মারধর করার জন্য ধেয়ে আসেন। গত শনিবার চাঁদার জন্য দ্বিতীয় কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেন রাজু মুন্সি। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় কর্মকর্তা, কর্মচারীদের সঙ্গে অসদাচরণ করে আসছেন তিনি। তাঁর জন্য মানসম্মান নিয়ে ক্যাম্পাসে চলাচল করা দায়। তিনি এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন।

আরও পড়ুন

নিরাপত্তা কর্মকর্তা শেখ মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক বলেন, রাজু মুন্সি এক কর্মচারীকে দিয়ে তাঁর কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা চাঁদা চেয়েছিলেন। টাকা না দেওয়ায় তাঁকে মারধরের হুমকি দেন। নিরাপত্তা দপ্তর বন্ধ করে দেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয়। এ ঘটনা তিনি প্রক্টরিয়াল বডিকে জানালে সবার সামনেই তাঁকে লাঞ্ছিত করেন রাজু মুন্সি। তিনি এই ঘটনার বিচার চান। ইতিমধ্যে রেজিস্ট্রার বরাবর চিঠি দিয়েছেন বলে জানান তিনি।
প্রকৌশল দপ্তরের সেকশন অফিসার সাঈদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রাজু মুন্সিকে গ্রেপ্তারের আশ্বাসে তাঁরা অবরোধ কর্মসূচি প্রত্যাহার করেছেন। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ আবার দেওয়া হয়েছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ব্যবস্থা না নিলে আবার তাঁরা আন্দোলনে যাবেন।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একটি সূত্র জানায়, রাজু মুন্সি কর্মচারী পদে তাঁর পছন্দের কিছু লোক নিয়োগ দেওয়ার জন্য প্রশাসনকে চাপ দিয়ে আসছিলেন। নিয়োগ না দেওয়ায় প্রকৌশলীকে মারধর করেছেন তিনি। আজ দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরকেও নিয়োগের বিষয়ে বলেন রাজু মুন্সি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রক্টর নূরুল আজিম সিকদার প্রথম আলোকে বলেন, রাজু মুন্সি কী বলেছে, সেটি পত্রিকায় বক্তব্য হিসেবে তিনি দিতে পারবেন না। পরে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার কে এম নূর আহমদ বলেন, এ ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে।

কে এই রাজু মুন্সি

রাজু মুন্সি অ্যাকাউন্টিং বিভাগের ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। রাজুর ছাত্রত্ব শেষ হয়েছে অন্তত তিন থেকে চার বছর আগে। ছাত্রত্ব না থাকার পরও শাহজালাল হলের ২১৮ নম্বর কক্ষটি একাই দখল করে থাকেন তিনি।

রাজু মুন্সির বিরুদ্ধে এর আগেও বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগ ওঠে। গত ১ জুন অনুপস্থিতির কারণে তাঁর দুই কর্মীকে পরীক্ষা দিতে না দেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকে তালা দিয়ে অবরোধ করেছিলেন রাজু মুন্সি। গত বছরের ৪ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক মো. তানবীর হাসানকে ফোন করে মারধরের হুমকি দিয়েছেন তিনি। এ ঘটনায় ওই শিক্ষক প্রক্টরকে লিখিত অভিযোগও দিয়েছিলেন। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজু মুন্সির বিরুদ্ধে চাঁদার দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজের নির্মাণাধীন একটি ভবনের কাজ বন্ধে করে দেওয়ার অভিযোগ করেন এক ঠিকাদার।

২০১৩ সালের ২৪ জুন রেলওয়ের কোটি টাকার দরপত্রের ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী ওরফে বাবর এবং ছাত্রলীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় নেতা সাইফুল আলম ওরফে লিমনের অনুসারী নেতা-কর্মীদের মধ্যে চট্টগ্রামের সিআরবি (রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সদর দপ্তর) এলাকায় সংঘর্ষ হয়। এ সময় গুলিতে প্রাণ হারান যুবলীগের কর্মী সাজু পালিত (২৮) এবং শিশু মো. আরমান (৮)। এ ঘটনায় প্রথমে পুলিশ বাদী হয়ে ও পরে সাজু পালিতের মা মিনতি পালিত মামলা করেন। রাজু মুন্সি এ মামলার আসামি হয়ে জেল খেটে জামিনে মুক্তি পান। মামলাটি এখনো বিচারাধীন।

আরও পড়ুন

এদিকে ছাত্রত্ব না থাকা শিক্ষার্থীদের ১৫ মার্চের মধ্যে ক্যাম্পাস ও হল ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এরপর ছাত্রত্ব নেই এ রকম কাউকে পাওয়া গেলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণাও দেওয়া হয়েছিল। এরপরও রাজু মুন্সি কীভাবে ক্যাম্পাসে অপকর্ম করে বেড়াচ্ছেন, তাঁর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, জানতে চাইলে প্রক্টর নূরুল আজিম সিকদার কোনো উত্তর দিতে রাজি হননি।