আনসার সদস্য নারীকে ঘুষি মারায় মধুখালীর ইউএনওর ওপর হামলা হয়, দাবি এলাকাবাসীর

ফরিদপুর জেলার মানচিত্র

ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলায় তিন ফসলি জমিতে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণের উদ্যোগের বিরুদ্ধে অবস্থান ছিল এলাকাবাসীর। এর প্রতিবাদে মানববন্ধন করায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) সঙ্গে আসা আনসার সদস্যদের একজন ঘুষি মেরে এক নারীর নাক ফাটিয়ে দেন। একপর্যায়ে ক্ষুব্ধ হয়ে এলাকাবাসী হামলা করেন। এ সময় চার নারীসহ গ্রামের বেশ কয়েকজন আহত হন বলে স্থানীয় অন্তত ২০ ব্যক্তি এ প্রতিবেদককে বলেছেন।

উপজেলার ডুমাইন ইউনিয়নের নিশ্চিন্তপুর গ্রামের চরপাড়া মহল্লার আফরোজা বেগম (৫২) প্রথম আলোকে বলেন, বৃহস্পতিবার ইউএনও এলে প্রতিবাদ জানাতে এলাকাবাসী মানববন্ধন করেন। ওই সময় ইউএনওর সঙ্গে আসা আনসার সদস্যদের একজন বিধবা আইরিন বেগমের (৪৬) মুখে ঘুষি মারেন। এতে তাঁর নাক ফেটে রক্ত বের হতে থাকে। এটা দেখে গ্রামের মানুষ স্থির থাকতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘এ জমিতে চাষ করতে না পারলে আমাগো না খাইয়া থাকতে হবে।’

যে জমি নিয়ে বিরোধ, সেটি উপজেলার নিশ্চিন্তপুর গ্রামের চরপাড়া মহল্লায় মধুমতী নদীর কাছে অবস্থিত। প্রায় পাঁচ একরের ওই জমিতে পাট, কাঁচা মরিচ, পেঁপে ও বেগুন আবাদ করা হয়।

আরও পড়ুন

৫০–৬০ বছর ধরে এ জমিতে চাষাবাদ হয় বলে দাবি করেন চরপাড়া মহল্লার সোনাই বিবি (৬২)। তিনি বলেন, জমিটি খুব উর্বর। এ জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ ঠেকাতে গ্রামবাসী বৃহস্পতিবার দুপুরে মানববন্ধন করেন।

নিশ্চিন্তপুর গ্রামের চরপাড়া মহল্লায় করা ওই মানববন্ধন থেকে হামলার ঘটনা ঘটে। এ সময় মধুখালীর ইউএনও মো. আশিকুর রহমান চৌধুরী, পুলিশ, আনসার সদস্যসহ ১৫ জন আহত হন। এ ঘটনায় করা দুটি মামলায় ডুমাইন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহ আসাদুজ্জামানসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একই সঙ্গে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গঠন করা হয়েছে এক সদস্যের তদন্ত কমিটি।

ফরিদপুর জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মানিক মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি কোনো জমি কারও দখলে থাকলে তা উদ্ধারের একটি প্রক্রিয়া রয়েছে। ১৯৭০ সালের ‘সরকারি এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষের ভূমি ও ইমারত (দখল পুনরুদ্ধার) অধ্যাদেশ’ অনুযায়ী সরকারি জমি থেকে উচ্ছেদ করতে হলে একটি মিস কেস করতে হয়। যিনি দখলে আছেন তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়ে আইনগতভাবে জমি বুঝে নিতে হয়। এসব না করে কাগজের জোরে দখল নিতে গেলে তা আইনসম্মত হয় না।

আরও পড়ুন

এলাকার লোকজন ওই জমিতে চাষাবাদ করলেও জমিটি সরকারের দখলে ছিল বলে মন্তব্য করেন মধুখালী উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) শামীম আরা। তিনি বলেন, ‘বিপুল পরিমাণ খাসজমির মধ্যে বড়জোর ৫০ শতাংশ জমিতে ২০টি ঘর নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কিছু ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু হামলায় সব ওলটপালট হয়ে গেল।’

গতকাল শুক্রবার সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত নিশ্চিন্তপুর গ্রাম ঘুরে এবং বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে শিশু, নারী ও বৃদ্ধ ছাড়া আর কাউকে দেখা যায়নি। কোনো বাড়িতে রান্নার আয়োজন ছিল না। সবার মধ্যে আতঙ্ক ও ভয়ের ছাপ লক্ষ করা গেছে। আনসার সদস্যদের মারধরে আহত নারীরা কোথায় চিকিৎসাধীন, পুলিশি হয়রানির ভয়ে তা জানাতে চাননি গ্রামের লোকজন।

যে জমি নিয়ে বিরোধ, সেটির মালিকানা দাবি করে আসছেন নিশ্চিন্তপুর গ্রামের বাসিন্দা রুহুল আলম (৬২) ও ভেল্লাকান্দি গ্রামের নিজেল মিয়া। তবে তাঁরা কেউ এ জমিতে চাষাবাদ করেন না, বর্গাচাষি দিয়ে চাষ করান।

নিজেল মিয়ার বাড়িতে গিয়ে পরিবারের কাউকে পাওয়া যায়নি। রুহুল আলমের বাড়িতে তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে কথা হলেও তিনি স্বামীর মুঠোফোন নম্বর দিতে পারেননি।

চরপাড়া মহল্লায় গিয়ে দেখা যায়, পাট ও কাঁচা মরিচ খেতের ফসল কুপিয়ে আশ্রয়ণ প্রকল্পের তিনটি ঘরের জন্য জমি তৈরি করা হয়েছে। এ কাজের জন্য অন্তত আটটি ফলন্ত পেঁপেগাছ কাটা হয়েছে।

চরপাড়া মহল্লার জাহানারা বেগম (৭৫) বলেন, ‘গ্রামের ওই তিন ফসলি জমি আমাদের অনেক উপকারে আসে। ওই জমিতে আমরা সবজি ফলাই। এ জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প করতে বাধা দেন এলাকাবাসী।’

চরপাড়া গ্রামের আমেনা বেগম (৬৬) বলেন, ‘আনসাররা আমাদের মেয়ের গায়ে হাত না দিলে এ ঘটনা ঘটত না।’ একই গ্রামের শিল্পী বেগম বলেন, ‘এ ঘটনার পর থেকে আমরা আতঙ্কে আছি।’

মধুখালী, বোয়ালমারী ও আলফাডাঙ্গা নিয়ে গঠিত ফরিদপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য মো. মনজুর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি বিভিন্ন ঘটনায় দেখেছি এসব ক্ষেত্রে দুই পক্ষেরই ভুল থাকে। যেহেতু মামলা হয়েছে তাতো আর সহজে দুই/চার দিনে মিটবে না। তবে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।’