কারখানার মালিক ভোটে হেরে গেছেন, শ্রমিকদের বেতনের খবর নেই

বকেয়া বেতনের দাবিতে সাবেক সংসদ সদস্য এনামুল হকের কারখানার শ্রমিকদের বিক্ষোভ। বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজশাহী বিসিক শিল্পনগরী এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

চার মাস বেতন পাননি। সর্বশেষ নির্বাচনের মধ্যে বেতন চাইতে গেলে বলা হয়, কারখানার মালিক (এনামুল হক) নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত। ভোট পার হলে বেতন দেবেন। ভোটে তিনি হেরে গেছেন। বেতনের খবর নেই। কথাগুলো বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন পিয়ারা বেগম নামের এক নারী শ্রমিক। তাঁর ছেলেও একই কারখানায় কাজ করেন। ছেলেও তিন মাস বেতন পাননি।

রাজশাহী নগরের বিসিক শিল্পনগরীতে অবস্থিত এই কারখানাটির নাম সাকোয়াটেক্স। এটির মালিক রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক তিনবারের সংসদ সদস্য এনামুল হক। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে তিনি কাঁচি প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী (৫৩ হাজার ৮১২ ভোট) হিসেবে নৌকার প্রার্থী তাহেরপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র আবুল কালাম আজাদের (১ লাখ ৭ হাজার ৯৮৩ ভোট) কাছে হেরে যান। তাঁর এই কারখানায় প্রায় ৩০০ শ্রমিক কর্মরত আছেন, সবার বেতন বকেয়া পড়েছে। বেতন আদায়ে তাঁরা গতকাল বুধবার সকাল থেকে কারখানার ভেতরে অনশন শুরু করেন। এই কনকনে ঠান্ডায় সারা রাত তাঁরা কারখানার ভেতরেই ছিলেন। আজ বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত তাঁরা ভেতরেই অবস্থান করে বিক্ষোভ করছিলেন।

আরও পড়ুন

শ্রমিকেরা জানান, এই কারখানায় কেউ তিন মাস, কেউ আট মাস ধরে বেতন পাননি। তাঁদের বাড়িভাড়া বাকি পড়েছে, দোকানে বাকি খাচ্ছেন। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। তাই দিতে পারেননি বাড়িভাড়া, দোকানে ভরেছে বাকির খাতা। কারও কারও সন্তানের পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার উপক্রম। অসুখ-বিসুখে কেউ নিজের চিকিৎসাটা পর্যন্ত করাতে পারছেন না। বেতন না পেয়ে এ রকম বিপদে পড়া কর্মচারীরা শেষে বিক্ষোভ শুরু করেছেন।

কেউ বেতন চাইতে গেলে কারখানার কর্মকর্তারা দুর্ব্যবহার করেন। যাঁরা বেতন চান, তাঁদের নামের তালিকা করা হয়। এর পরদিন থেকে আর কারখানায় ঢুকতে দেওয়া হয় না। সম্প্রতি এভাবে ১৫ থেকে ২০ জনকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হয়েছে।
সম্পা খাতুন, সাকোয়াটেক্স কারখানার শ্রমিক

তাঁরা জানান, তিন-চার মাস ধরে প্রতি সপ্তাহেই বেতন পরিশোধের আশ্বাস দেওয়া হয়। সোম কিংবা বৃহস্পতিবার বেতন দেওয়া হবে বলে কর্মকর্তারা জানান। কিন্তু বেতন দেওয়া হয় না। মাসের পর মাস তাঁরা এভাবে বেতন ছাড়া মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন।

শ্রমিকেরা অভিযোগ করেন, কারখানায় তাঁরা বেতনের দাবিতে অবস্থান নিলে পুলিশ আসে। কিন্তু পুলিশও কারখানার পক্ষ নিয়েই কথা বলে। আন্দোলনের জন্য অবস্থান নিলে লাঠিপেটা করে বের করে দেওয়ার হুমকি দেয়।

আরও পড়ুন

কারখানার লিংকিং অপারেটর আশা বেগম বলেন, এখানে শ্রমিকেরা উৎপাদনের ওপর নির্ভর করে পারিশ্রমিক পান। মাসে গড়ে তাঁরা ১৭ হাজার টাকা করে বেতন পান। কারখানার ২০০ শ্রমিকের কেউ সর্বনিম্ন তিন মাস এবং কেউ সর্বোচ্চ আট মাসের বেতন পাবেন। তিনি নিজে চার মাসের বেতন পাবেন। প্রতি মাসে বেতন না পাওয়ার কারণে বাড়িভাড়া বাকি পড়েছে। দোকানে অনেক টাকা বাকি পড়েছে। এখন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে পারছেন না। নতুন বছরে বাচ্চাদের স্কুলড্রেস তৈরি করে দেওয়ার মতো টাকাও নেই। খুব বিপদে আছেন।

সম্পা খাতুন নামের এক শ্রমিক বলেন, কেউ বেতন চাইতে গেলে কারখানার কর্মকর্তারা দুর্ব্যবহার করেন। যাঁরা বেতন চান, তাঁদের নামের তালিকা করা হয়। এর পরদিন থেকে আর কারখানায় ঢুকতে দেওয়া হয় না। সম্প্রতি এভাবে ১৫ থেকে ২০ জনকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হয়েছে। এবার তাঁরা একজোট হয়ে আন্দোলন শুরু করেছেন। তাঁদের পাওনা দিয়ে দিলেই তাঁরা চলে যাবেন। তাঁদের আর চাকরির দরকার নেই।

সেলিনা বেগম নামের আরেক শ্রমিক বলেন, গত ঈদে তাঁর এতিম বাচ্চাকে নিয়ে ভালো–মন্দ না খেয়েই দিন কাটিয়েছেন। বেতন দেয়নি। এখানে কাজ করে শ্রমিকদের এই অবস্থা। বেতন চাইতে গেলে জোর করে সাদা কাগজে সই নেয়। বলে এটা রিজাইনের কাগজ। বেতন দিয়ে দেবে। তারপর বাহির (ছাঁটাই) করে দেয়। ওই বেতন আর দেয় না। তিন মাসের বেতনও মেরে খেয়ে নেয়।

আরও পড়ুন

শ্রমিকদের এই ক্ষোভ প্রকাশের সময় কারখানার আইটি ইনচার্জ মো. শামীম সাংবাদিকের বলেন, বিকেলের মধ্যে বেতন দিয়ে দেওয়া হবে। শ্রমিকদের এসব কথা নিয়ে যেন সংবাদ প্রকাশ করা না হয়। এ সময় শ্রমিকদের তোপের মুখে পড়েন শামীম। শ্রমিকেরা বলেন, প্রতি সপ্তাহে তাঁদের বেতন পরিশোধ করা হবে বলে আশ্বাস দেওয়া হয়। কিন্তু বেতন দেওয়া হয় না। এ সময় শামীম বলেন, ‘বাংলাদেশের কারখানায় এমনই হয়।’

এ ব্যাপারে কথা বলতে এনা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সাবেক সংসদ সদস্য এনামুল হকের মুঠোফোনে একাধিকার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি। তিনি ফোন ধরেননি। তবে অন্য একজন সাংবাদিককে তিনি বলেছেন শ্রমিকেরা এক মাসের বেতন পাবেন, আজ (বৃহস্পতিবার) বিকেলের মধ্যেই দিয়ে দেওয়া হবে।

বিকেলে সাড়ে চারটায় শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা জানান, তখনো তাঁদের বেতন দেওয়া হয়নি। তবে কর্তৃপক্ষ দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে। রাতে লিংকিং অপারেটর আশা বেগম মুঠোফোনে নিশ্চিত করেন, সন্ধ্যায় তাঁদের মাত্র এক মাসের করে বেতন দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

আরও পড়ুন