কুমিল্লায় যুবলীগ নেতা হত্যা মামলায় ‘বোরকা পরা এক অস্ত্রধারীসহ’ গ্রেপ্তার আরও ৩

কুমিল্লার তিতাস উপজেলার যুবলীগ নেতা জামাল হোসেন হত্যার মামলায় দেলোয়ার হোসেন (সবুজ গেঞ্জি) ও মো. সাহিদুল ইসলামকে (পাঞ্জাবি) গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। আজ বুধবার কুমিল্লা নগরের শাকতলায় কার্যালয়ে
ছবি : প্রথম আলো

কুমিল্লার তিতাস উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক জামাল হোসেন হত্যা মামলার আরও তিন আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এর মধ্যে দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব, অপরজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। র‌্যাবের কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁদের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া একজন বোরকা পরা অস্ত্রধারীদের মধ্যে একজন।

র‌্যাব-১১ ক্রাইম প্রিভেনশন কোম্পানি-২ কুমিল্লার শাকতলা দপ্তরে আজ বুধবার সকাল ১০টায় এক সংবাদ সম্মেলন করা হয়। সেখানে র‌্যাব-১১ (সিপিসি-২) কুমিল্লার উপপরিচালক মেজর মোহাম্মদ সাকিব হোসেন এসব তথ্য দেন। র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা হলেন কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার চর চারুয়া গ্রামের বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন (৩১) ও তিতাস উপজেলার বড় গাজীপুর এলাকার বাসিন্দা মো. সাহিদুল ইসলাম (৩৩)।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, দেলোয়ার হোসেন বোরকা পরা অস্ত্রধারী তিন ব্যক্তির মধ্যে একজন। দেলোয়ারের বিরুদ্ধে দুটি হত্যা মামলাসহ ছয়টি মামলা আছে। সাহিদুল ইসলাম কুমিল্লার তিতাসের ইঞ্জিনিয়ার হারুন-উর-রশিদ গার্লস কলেজের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়ের প্রভাষক। সাহিদুল অস্ত্র ও মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। দেলোয়ারকে ৯ মে বিকেলে ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে, সাহিদুলকে ৯ মে রাতে তিতাসের গাজীপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

অন্যদিকে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার নবিয়াবাদ গ্রামের মো. মাজহারুল ইসলাম (২৪)। বেলা সাড়ে ১১টায় জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে ব্রিফিং করে এ তথ্য দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও কুমিল্লা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবির) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রাজেস বড়ুয়া। মাজহারুল দেবীদ্বার উপজেলা বরকামতা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও ওষুধের দোকানদার। মাজহারুলকে ৯ মে রাত সাড়ে ১২টায় বুড়িচং উপজেলার নিমসার থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এ ছাড়া পুলিশ হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ২টি বিদেশি পিস্তল, ১টি রিভলবার, ২৪টি গুলি, হত্যাকাণ্ডের সময় ব্যবহৃত ৭টি মুঠোফোন, ২টি নিকাব (বোরকার) ও ১টি জিনস প্যান্ট উদ্ধার করে। পুলিশ বলছে, হত্যার পর মাজহারুল অস্ত্রগুলো জমা রাখেন।

জামাল হোসেনকে যেভাবে হত্যা করা হয়

র‌্যাবের সংবাদ সম্মেলনে মোহাম্মদ সাকিব হোসেন বলেন, তাঁরা গ্রেপ্তার আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। দেলোয়ার জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, গত ৩০ এপ্রিল বিকেলে যুবলীগ নেতা জামাল হত্যা মামলার ১ নম্বর আসামি সুজন ও ২ নম্বর আসামি আরিফের জিয়ারকান্দি এলাকার মাছের খামারে কাজ করছিলেন দেলোয়ার। সেখান থেকে দেলোয়ারকে নিয়ে আরিফ গৌরীপুর পাওয়ার হাউসে যান। এ সময় দেলোয়ার দেখতে পান সেখানে কালো রঙের একটি মাইক্রোবাস। গাড়িতে হত্যা মামলার ৯ নম্বর আসামি কালা মনির ও জিয়ারকান্দি গ্রামের শাহ আলী ওরফে আল আমিন বসা ছিলেন। তাঁরা পরে মাইক্রোবাসে ওঠেন।

জামাল হোসেন
ছবি: সংগৃহীত

আরিফ এরপর দেলোয়ারকে বলেন, জামাল হোসেন তাঁদের দুজনের অনেক ক্ষতি করেছেন। জামাল বেঁচে থাকলে তাঁদের আরও ক্ষতি করবেন। তাই জামালকে তাঁরা হত্যা করবেন। এ কাজ শেষে ঋণ পরিশোধ ও পরিবার চালানোর জন্য দেলোয়ারকে টাকা দেওয়া হবে। দেলোয়ার টাকার প্রয়োজনে ও পুরোনো শত্রুতা থাকায় রাজি হয়ে যান। সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁরা গৌরীপুর পাওয়ার হাউসে অপেক্ষা করেন। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে আরিফ একজন সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালককে ফোন করে নিয়ে আসেন। এরপর আরিফ নিজে একটি পিস্তল নেন। দেলোয়ার ও কালা মনিরকে একটি পিস্তল দেন। এরপর তাঁরা বোরকা পরে অস্ত্র নিয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশা করে গৌরীপুর বাজারে যান। পরে তাঁরা গৌরীপুর বাজার শিকদার মেডিকেলের পাশের সড়ক (গৌরীপুর বড় মসজিদ) দিয়ে কিছু দূর যান। এরপর অটোরিকশা ছেড়ে দিয়ে হাঁটা শুরু করেন।

আরও পড়ুন

আসামিদের বরাত দিয়ে সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, হাঁটার সময় আরিফ কয়েকজনকে ফোন করেন ও জামাল হোসেনের অবস্থান নিশ্চিত করেন। পরে ঘটনাস্থলে এসে জামালকে দেখতে পেয়ে গুলি করে সেখান থেকে চলে যান। পালানোর সময় আরিফের বোরকার নেকাব খুলে যায়। কালা মনিরের হাত থেকে পিস্তল পড়ে যায়। পরে মনির পিস্তলটি সড়ক থেকে তুলে নেন। এরপর তাঁরা বোরকাগুলো গৌরীপুর বালুর মাঠের একটি ঝোপের মধ্যে রেখে যান। পরে তাঁরা গৌরীপুরে এক গাড়ির গ্যারেজের সামনে আসেন। সেখানে শাহ আলী ওরফে আল-আমিন নামের এক সহযোগী আগ থেকেই মাইক্রোবাস নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। এরপর তাঁরা চান্দিনায় আসেন। এখানে এসে তাঁদের পূর্বপরিচিত এক ব্যক্তির কাছে অস্ত্র রেখে আরিফ, কালা মনির, দেলোয়ার ও শাহ আলী নোয়াখালী চলে যান। পরদিন ১ মে তাঁরা আবার একই মাইক্রোবাসে করে চান্দিনায় আসেন। একপর্যায়ে বিপদ আঁচ করতে পেরে পুনরায় নোয়াখালী চলে যান।

জামাল হোসেন হত্যায় ব্যবহৃত তিনটি পিস্তল ও ২৪টি গুলি ও ৭টি মোবাইলসহ মাজহারুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করেছে কুমিল্লা জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। বুধবার কুমিল্লা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে
ছবি: প্রথম আলো

কালা মনির ২ মে সকালে দেলোয়ারকে জানান, আরিফ বিদেশ চলে গেছেন। ৩ মে তিতাস থেকে গাড়ি নিয়ে সাহিদুল নোয়াখালী যান। পরে তিনি কালা মনির, দেলোয়ার ও শাহ আলীকে নিয়ে ফেনীতে যান। ফেনী থেকে শাহ আলীকে ঢাকার একটি বাসে তুলে দেওয়া হয়। কালা মনির ও দেলোয়ার নরসিংদীতে যান। সাহিদুল পরে হোমনায় নেমে যান। ৪ মে নরসিংদীতে দেলোয়ারের আত্মীয়র বাসা থেকে কালা মনির ও দেলোয়ার পরে ঢাকার উত্তরায় যান। সেখান থেকে তাঁরা ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে আসেন। সেখান থেকে কালা মনির অন্য গাড়িতে চলে যান।

এরপর দেলোয়ার কয়েক দিন স্থান বদল করে লুকিয়ে থাকেন। ঢাকার শনির আখড়ায় থাকার সময় ৮ মে বিকেলে সাহিদুল তাঁকে ফোন করে বিদেশ চলে যেতে বলেন। কিন্তু দেলোয়ার বলেন, তাঁর পাসপোর্ট নেই। এ সময় পরিবারের সদস্যদের ভরণপোষণের জন্য সাহিদুলের কাছে তিন লাখ টাকা দাবি করেন তিনি। ৯ মে যাত্রাবাড়ী এলাকায় এলে র‌্যাব তাঁকে গ্রেপ্তার করে। পরে দেলোয়ারের দেওয়া তথ্যমতে, সাহিদুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। অন্যদিকে তাঁদের সঙ্গে থাকা শাহ আলী ৩ মে বিমানে করে দুবাই চলে যান।

র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে সাহিদুল বলেন, জামাল হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে তিনি আগে থেকে জানতেন না। মামলার এজাহারনামীয় ৬ নম্বর আসামি শাকিল তাঁর কাছে সাহায্য চান। তাই তিনি তাঁকে সাহায্য করেন।

আরও পড়ুন

৩০ এপ্রিল রাত আটটার পর দাউদকান্দির গৌরীপুর পশ্চিম বাজার বাইতুন নুর জামে মসজিদ এলাকার এক বেকারির সামনে বোরকা পরা তিনজন গুলি করে জামাল হোসেনকে হত্যা করেন। এ ঘটনায় মঙ্গলবার তাঁর স্ত্রী পপি আক্তার বাদী হয়ে দাউদকান্দি থানায় ৯ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় সাত থেকে আটজনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। এ পর্যন্ত এজাহারনামীয় তিন আসামি ও অজ্ঞাতনামা ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার পাঁচজনের তিন দিন করে রিমান্ড চলছে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রাজেস বড়ুয়া বলেন, তাঁরা হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্র ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক লাগোয়া কুমিল্লা জেলার চান্দিনা থেকে উদ্ধার করেন। জামালকে হত্যা করার পর ৩০ এপ্রিল রাত নয়টায় আসামিরা নোয়াখালী যাওয়ার পথে বুড়িচংয়ের নিমসার এলপিজি পাম্পে তাঁদের পরিচিত মাজহারুলের কাছে অস্ত্র, গুলিভর্তি স্কুলব্যাগ ও শপিং ব্যাগ দেন। পরে আসামিদের সঙ্গে মাজহারুল মাইক্রোবাসে ওঠেন। এরপর চান্দিনা উপজেলা পরিষদে যাওয়ার সড়ক থেকে ২০০ গজ পূর্বে এক ঝোপের মধ্যে রেখে দেন। এ ঘটনায় অস্ত্র আইনে চান্দিনা থানায় মাজহারুল, সুজন, আরিফ, কালা মনির, শাহ আলী ও দেলোয়ার হোসেনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় ৩ থেকে ৪ জনের নামে থানায় মামলা করা হয়েছে।

আরও পড়ুন