রাকসু নির্বাচন পেছাল, ভোট গ্রহণের নতুন তারিখ নিয়ে সমালোচনা
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু), হল সংসদ ও সিনেট ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনের পূর্বঘোষিত তফসিল পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। ভোট গ্রহণের তারিখ আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ১৩ দিন পিছিয়ে ২৮ সেপ্টেম্বর নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ভোটকেন্দ্র আবাসিক হল থেকে একাডেমিক ভবনে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
আজ বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে রাকসু কোষাধ্যক্ষের কার্যালয়ে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে রাকসুর প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক এফ নজরুল ইসলাম এ তথ্য জানান।
এদিকে শারদীয় দুর্গাপূজার ছুটি শুরুর আগে মহাষষ্ঠীর দিনে ভোট গ্রহণের নতুন তারিখ নির্ধারণ করায় বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে। এ নিয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন। এ ছাড়া তফসিল পুনর্বিন্যাসের সিদ্ধান্তকে ‘নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র’ উল্লেখ করে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবির।
সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক এফ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করার জন্য পূর্বনির্ধারিত তফসিলের সময় যথেষ্ট হচ্ছে না। আমরা আবাসিক হলে ভোট গ্রহণের প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু ছাত্রদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে একাডেমিক ভবনে ভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত ও ডোপ টেস্ট করার জন্য দীর্ঘ সময় প্রয়োজন, যা আমাদের ধারণায় ছিল না। এ ছাড়া ভোটার তালিকায় ছবি সংযুক্তি করতেও সময় প্রয়োজন। মনোনয়নপত্র বিতরণ, যাচাই–বাছাইসহ সব নির্বাচনীপ্রক্রিয়া সম্পন্ন শেষে ২৮ সেপ্টেম্বর ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।’
সংশোধিত তফসিল অনুযায়ী, ৩১ আগস্ট বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত মনোনয়নপত্র বিতরণ করা হবে; মনোনয়নপত্র দাখিল করা যাবে ১ থেকে ৪ ও ৭ সেপ্টেম্বর বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত; মনোনয়নপত্র বাছাই হবে ৮ ও ৯ সেপ্টেম্বর, প্রার্থীদের প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করা হবে ১১ সেপ্টেম্বর এবং মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করা যাবে ১৫ সেপ্টেম্বর সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে ১৬ সেপ্টেম্বর। ২৮ সেপ্টেম্বর সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত একাডেমিক ভবনে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে এবং একই দিন ভোট গণনা শেষে ফলাফল প্রকাশ করা হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ছাত্রসংগঠনগুলোর বেশ কিছু দাবি ও ছাত্রদলের দুই মাস সময় চাওয়ার ‘অনুরোধের’ পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল মঙ্গলবার নির্বাচন কমিশনের জরুরি সভা বসে। বেলা দুইটায় শুরু হওয়া এ সভা চলে বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত। পরে বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে সংবাদ সম্মেলন করে মনোনয়নপত্র বিতরণের সময় বাড়ানোসহ তিনটি সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নে কিছুটা সময় প্রয়োজন হওয়ায় নির্বাচনের তারিখ পেছানো হবে কি না, সেই আলোচনা অব্যাহত ছিল।
মনোনয়নপত্র সংগ্রহের সময় বাড়ানো ও নির্বাচন পেছানোর আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রশিবির, ছাত্র অধিকার পরিষদ ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়কেরা তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানান। আজ সকাল সাড়ে ১০টায় জরুরি সভায় বসেন নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা। সভা শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচনের নতুন সময় জানানো হয়।
ভোট গ্রহণের তারিখ নিয়ে সমালোচনা
রাকসুর ভোট গ্রহণের দিন (২৮ সেপ্টেম্বর) সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীদের দুর্গাপূজার মহাষষ্ঠী। এই দিনে ভোট গ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করায় সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীসহ ছাত্রনেতাদের অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। অনেকে বিষয়টিকে ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবে দেখছেন।
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী অর্পণ ধর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘২৮ সেপ্টেম্বর দুর্গাপূজার মহাষষ্ঠীর দিন রাকসু নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করেছে নির্বাচন কমিশন। বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন হাজারের বেশি শিক্ষার্থীদের নির্বাচন থেকে দূরে রাখার একটা অভিনব কৌশল।’
শাখা ছাত্রদলের সভাপতি সুলতান আহমেদ রাহী তাঁর ব্যক্তিগত ফেসবুকে লিখেছেন, ‘হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভাই–বোনদের পাশে দাঁড়ানো, তাঁদের মন্দিরে গিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করা ছাত্রদলের সংস্কৃতি। কিন্তু ভিসি নকীব–ফকির কমিশন এই ভ্রাতৃত্বকে ভয় পায়। তাই তো ইচ্ছে করে রাকসু ভোটের তারিখ তারা নির্ধারণ করেছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বড় উৎসবের সময় আর ক্যাম্পাস ছুটির আগের দিনে। এর মধ্য দিয়ে একদিকে হিন্দু শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণকে কঠিন করে দেওয়া হলো, আরেকদিকে ছাত্রদলকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালানো হলো। এই তারিখ নির্ধারণ কোনো কাকতালীয় নয়, এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ষড়যন্ত্র।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক সালাউদ্দিন আম্মার লিখেছেন, ‘রাকসু নির্বাচনের তারিখ পিছিয়ে ২৮ সেপ্টেম্বর করেছে। ২৫০০–৩০০০ হিন্দু শিক্ষার্থী আছে, তাদের কি কোনো সংখ্যাই মনে করছেন না? ২৮ সেপ্টেম্বর দুর্গাপূজার মহাষষ্ঠীর দিন হিন্দু শিক্ষার্থীরা কোন সেন্সে নিজ ধর্মীয় উৎসব বাদ দিয়ে আপনাদের দেওয়া তারিখে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে? ভাই প্রশাসনরে আর কীভাবে হুঁশ ফেরাইতে হবে জানা নাই।’
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সনাতন বিদ্যার্থী সংসদের সাধারণ সম্পাদক সৌরভ কর্মকার প্রথম আলোকে বলেন, প্রশাসনের এই সিদ্ধান্ত একদমই অযৌক্তিক। তিন হাজারের অধিক সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীদের বাদ দিয়ে কখনোই তারা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করতে পারে না। নির্বাচন কমিশন সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একটি প্রহসন করছে। অবিলম্বে এই তারিখ পরিবর্তন করতে হবে। সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ অবশ্যই দিতে হবে।
জানতে চাইলে রাকসুর প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক এফ নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২৮ ও ২৯ সেপ্টেম্বর ক্যাম্পাস খোলা আছে। পূজার ছুটির আগে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ক্যালেন্ডার দেখেই নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। অন্য কিছু ভেবে নয়।
ছাত্রশিবিরের বিক্ষোভ মিছিল
রাকসু নির্বাচনের নতুন তারিখকে ‘নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র’ উল্লেখ করে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন শাখা ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা–কর্মীরা। বেলা দুইটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে রাকসু কোষাধ্যক্ষের কার্যালয়ের সামনে গিয়ে শেষ হয়।
বিক্ষোভ মিছিলে ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি মুজাহিদ ফয়সাল বলেন, ‘একাধিকবার কমিশন ছাত্র নেতাদের সঙ্গে বসেছে। সেখানে সবাই ১৫ সেপ্টেম্বর নির্বাচনের পক্ষে মতামত দিলেও একটি দলকে সুবিধা দিতে নির্বাচন পিছিয়েছে। আমরা বলব ১৫ তারিখেই নির্বাচন হতে হবে। কারণ নতুন যে তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে, সেখানে আমাদের সনাতনী ভাইদের ধর্মীয় আবেগ জড়িত রয়েছে। তারা সবাই পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাবে। আর তাদের নির্বাচনের বাইরে রেখে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্ভব না।’