জলদস্যুদের হাতে জিম্মি ৩৩ দিনের বর্ণনা দিলেন এমভি আবদুল্লাহর নাবিক

মা–বাবা ও স্বজনদের সঙ্গে নাবিক নাজমুল হক
ছবি: প্রথম আলো

ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ ‌এমভি আবদুল্লাহর নাবিক নাজমুল হক স্বজনদের কাছে ফিরতে পেরে আপ্লুত। বাড়িতে ফেরার পর ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন মা নার্গিস খাতুন। খবর পেয়ে নাজমুলকে একনজর দেখতে বাড়িতে ভিড় করেন স্বজনেরা। পরে জাহাজে জিম্মিদশার বর্ণনা দেন নাজমুল হক।

আজ বুধবার সকাল সাড়ে সাতটার দিকে নিজ বাড়িতে এসে পৌঁছান নাবিক নাজমুল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘জিম্মিদশার দিনগুলোতে খুব ভয় পেয়েছিলাম। জাহাজে দস্যুদের অস্ত্রের মহড়া দেখে ভেঙে পড়েছিলাম। জলদস্যুরা জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আনন্দে ফাঁকা গুলি ছোড়ে, তখন ভয়ে ঠিকমতো ঘুমাতে পারতাম না। ভেবেছিলাম, আর বুঝি মা–বাবা ও বোনের সঙ্গে দেখা হবে না।’

আরও পড়ুন

ভারত মহাসাগর থেকে গত ১২ মার্চ কেএসআরএম গ্রুপের এমভি আবদুল্লাহ জাহাজ ছিনতাই করে সোমালিয়ার দস্যুরা। জাহাজে থাকা ২৩ নাবিক ও ক্রুকে জিম্মি করে। জলদস্যুদের হাতে জিম্মির খবরে নাবিকদের পরিবারে নেমে আসে দুশ্চিন্তা।

শেষ পর্যন্ত মুক্তিপণ দিয়ে ৩৩ দিনের মাথায় গত ১৩ এপ্রিল দিবাগত রাতে নাবিকসহ জাহাজটি মুক্ত করা হয়। এরপর সংযুক্ত আরব আমিরাত হয়ে জাহাজটি বাংলাদেশে আসে। আরব আমিরাত থেকে রওনা হওয়ার ১৪ দিন ও জিম্মিদশা থেকে মুক্তির ১ মাস পর নাবিকেরা ঘরে ফেরেন।

আরও পড়ুন

দুর্বিষহ ৩৩ দিনের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়ে নাবিক নাজমুল বলেন, ‘জলদস্যুরা সংখ্যায় সব মিলিয়ে ৪০ থেকে ৫০ জন ছিল, সবাই অস্ত্রধারী। আমরা সংখ্যায় ছিলাম ২৩ জন।’ দস্যুরা প্রথম দিন তাঁদের সবার মুঠোফোন জমা দিতে বলে। তাঁরা সবাই মিলে ২৪টি মুঠোফোন জমা দেন। এর বাইরে সহকর্মীদের কাছে তিন-চারটি মুঠোফোন গোপনে লুকিয়ে রাখা ছিল। নামাজের কথা বলে সেই সময় ওই ফোন দিয়ে কেউ কেউ স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।

নাজমুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই ৩৩ দিন সবাইকে জাহাজের ব্রিজে একসঙ্গে থাকতে হয়েছে। শুধু নামাজের সময় একটু বাইরে বের হতে দিত। খাবার আমাদের রান্না করে খেতে হয়েছে। জলদস্যুরা আলাদা রান্না করে খেত। দু-এক দিন পরপর ইতালি, স্পেনসহ বিভিন্ন দেশের নৌ সেনাদের জাহাজ আমাদের উদ্ধারের চেষ্টা করত। তখন জলদস্যুরা আমাদের দিকে অস্ত্র তাক করে ভয়ভীতি দেখাত।’

আরও পড়ুন

নাজমুল আরও বলেন, নৌ সেনাদের জাহাজগুলো সাগরের মধ্যে দুই নটিক্যাল মাইল দূরে থেকে জাহাজের রেডিও সিগন্যাল ব্যবহার করে ক্যাপ্টেনের সঙ্গে যোগাযোগ করত। তখন জলদস্যুরা অস্ত্র তাক করে তাঁদের হত্যার হুমকি দিয়ে বিষয়টি জাহাজের ক্যাপ্টেনের মাধ্যমে জানিয়ে দিত। এর পর থেকে কোনো উদ্ধারকারী জাহাজ তাঁদের জাহাজের কাছাকাছি না এসে চলে যেত। এভাবেই দুর্বিষহ ৩৩ দিন কেটে যায়।

একমাত্র ছেলেকে ফিরে পেয়ে খুবই খুশি মা নার্গিস খাতুন। তিনি বলেন, ‘আমার একমাত্র ছেলেকে কাছে পেয়ে অনেক আনন্দ অনুভব করছি। তিন সন্তানের মৃত্যুর পর নাজমুলের জন্ম। এরপর এক মেয়ে। দুই ভাই–বোনের মধ্যে নাজমুল বড়। যে কারণে তার ওপর পরিবারের অনেক আশা-ভরসা। যাঁদের সাহায্যে আমার সন্তান আমার বুকে ফিরে এসেছে, তাঁদের সবার প্রতি অনেক কৃতজ্ঞতা জানাই।’

আরও পড়ুন

নাজমুলের ছোট বোন খাদিজা খাতুন বলেন, ‘ভাই আমাদের মাঝে ফিরে আসায় আমরা চরম আনন্দিত।’

কৃষক বাবা আবু সামা শেখ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এখন অনেক খুশি। আমার মনের অবস্থা বলে বোঝাতে পারব না। যাঁরা আমার ছেলেসহ ২৩ নাবিককে উদ্ধার করতে ভূমিকা রেখেছেন, তাঁদের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা।’

আরও পড়ুন