কুমিল্লায় যেসব কারণে হারলেন আওয়ামী লীগের চার প্রার্থী

ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন, সেলিমা আহমাদ, রাজী মোহাম্মদ ফখরুল ও আবুল হাসেম খানছবি: প্রথম আলো
সেলিমা আহমাদ

নেতা–কর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব, নির্বাচনী এলাকায় কম আসা, জ্যেষ্ঠ নেতাদের অবমূল্যায়ন এবং একাধিক ব্যক্তি স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকায় কুমিল্লার চারটি আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা হেরেছেন। আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা–কর্মী ও সাধারণ ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

কুমিল্লা-২ (হোমনা ও মেঘনা) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন সেলিমা আহমাদ। তিনি ২০১৮ সালে প্রথমবার নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত হওয়ার পর হোমনা উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীদের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব বাড়ে। ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে দলের ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে পছন্দের ব্যক্তিকে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন দেওয়ায় নেতা–কর্মীরা ক্ষুব্ধ ছিলেন।

হোমনা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রেহানা বেগমের সঙ্গেও তাঁর দূরত্ব ছিল। তার ওপর হোমনা ও মেঘনা উপজেলা আওয়ামী লীগ ছিল তাঁর বিপক্ষে। সেলিমা এবার হোমনা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আবদুল মজিদের কাছে ১ হাজার ৯৬১ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। আবদুল মজিদ স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ট্রাক প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন।

ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন

হোমনা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ কে এম ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, গত পাঁচ বছরে মেরীর (সেলিমা) অত্যাচারে হোমনাবাসী অতিষ্ঠ ছিলেন। দলের নেতা–কর্মীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করায় তিনি পরাজিত হন। দলের কর্মীদের নামে মামলাও করেন। যে কারণে হোমনাবাসী তাঁর বিপক্ষে রায় দেন।

কুমিল্লা-৩ (মুরাদনগর) আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন। তিনি ২০১৪ সালে স্বতন্ত্র ও ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য হন। এর আগে ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে নৌকা প্রতীক নিয়ে তিনবার পরাজিত হন। নির্বাচনী এলাকায় তিনি কম আসতেন। নেতা–কর্মীরা তাঁর দেখা পেতেন না। ঢাকায় গেলেও সাক্ষাৎ পেতেন না। গত ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী মনোনয়ন ও সমর্থনে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ায় তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন দলের একাংশের নেতা–কর্মীরা। এ ছাড়া তলে তলে এ আসনের বিএনপিদলীয় সাবেক সংসদ সদস্য কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসাইন কায়কোবাদের অনুসারীরা ইউসুফের বিরুদ্ধে ভূমিকা নেন। এবার তিনি তাঁর দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক স্বতন্ত্র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলমের কাছে ১১ হাজার ৯৫৭ ভোটে পরাজিত হন।

মুরাদনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ তানভীর আহমেদ বলেন, প্রকৃত আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা ওনার কাছে যেতে পারতেন না। বিএনপি ও জামায়াতের লোকজন তাঁকে ঘিরে থাকতেন।

আরও পড়ুন
রাজী মোহাম্মদ ফখরুল

কুমিল্লা-৪ (দেবীদ্বার) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ছিলেন রাজী মোহাম্মদ ফখরুল। ২০১৪ সালে স্বতন্ত্র ও ২০১৮ সালে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব বাড়ে। তিনি তরুণ ও উঠতি বয়সী ছেলেদের প্রাধান্য দেন। এসব তরুণদের বেশির ভাগই ঠিকাদারি, জবরদস্তি ও নানা ধরনের অপরাধমূলক কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েন। ইউপি নির্বাচনে দেবীদ্বারে নৌকার বেশির ভাগ প্রার্থী পরাজিত হন।

এ ছাড়া গত বছর দেবীদ্বার পৌরসভা নির্বাচনে মনোনয়নপ্রত্যাশী দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের বাদ দিয়ে তরুণ একজনকে মেয়র পদে মনোনয়ন দেন। এতে ক্ষুব্ধ হন জ্যেষ্ঠ নেতারা। তার ওপর রাজীর বাবা সাবেক উপমন্ত্রী এ এফ এম ফখরুল ইসলাম মুন্সী মারা যাওয়ায় তিনি বেকায়দায় পড়েন। গত উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে তিনি তাঁর চাচা কুমিল্লা উত্তর জেলা বিএনপির সদস্যসচিব এ এফ এম তারেক মুন্সীর পক্ষে অবস্থান নেন। রাজীর অনুসারীরা প্রকাশ্যে ধানের শীষ প্রতীকে ভোট দেন। এ ছাড়া জাতীয় সংসদ ভবনে সদ্য সংসদ সদস্য হওয়া আবুল কালাম আজাদকে প্রকাশ্যে ঘুষি মারেন। আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতা–কর্মীরা এ নিয়ে রাজীর ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের দিন রাজীকে দেবীদ্বার উপজেলার সূর্যপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ধাক্কা দেন প্রতিপক্ষরা, এতে তিনি আঘাত পান। রাজী নিজেই গণমাধ্যমকর্মীদের বিষয়টি জানান। নির্বাচনে রাজী তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী আবুল কালাম আজাদের কাছে ১৫ হাজার ৫৫০ ভোটে পরাজিত হন।

আরও পড়ুন
আবুল হাসেম খান

দেবীদ্বার পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল কাশেম বলেন, ‘আমাদের অবমূল্যায়ন করার ফল পেয়েছেন।’

কুমিল্লা-৫ (বুড়িচং ও ব্রাহ্মণপাড়া) আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন আবুল হাসেম খান। ২০২১ সালের ২৫ জুন উপনির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। এবারও তিনি নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রার্থী হন। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর অসুস্থতার কারণে তিনি এক দিনও প্রচারণায় নামতে পারেননি। তার ওপর এ আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন তিনজন। দলের নেতা–কর্মীরা তখন চার ভাগে ভাগ হয়ে চার প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেন। নির্বাচনে আবুল হাসেম খান তৃতীয় হন। তিনি আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী কেটলি প্রতীকের এম এ জাহেরের কাছে ৪৩ হাজার ৪৯৫ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী তৃতীয় হন।

বুড়িচং উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আখলাক হায়দার বলেন, একেকটা লোকের কাজের কৌশল দেখে ভোটাররা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, কাকে ভোট দেবেন। গত আড়াই বছর হাসেম খান সংসদ সদস্য ছিলেন। তাঁর কার্যক্রম দেখে ভোটাররা রায় দেন।

আরও পড়ুন