আ.লীগের পথের কাঁটা ‘বিদ্রোহী’, বিএনপিতে কাঁটা দলীয় বিভক্তি

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া পৌরসভা নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের মেয়র প্রার্থী তাকজিল খলিফা (ওপরে বাঁয়ে), ধানের শীষ প্রতীকের মেয়র প্রার্থী জয়নাল আবেদীন ওরফে আব্দু (ওপরে ডানে), নারকেলগাছ প্রতীকের প্রার্থী নুরুল হক ভূঁইয়া (নিচে বাঁয়ে) এবং মোবাইল ফোন প্রতীকের প্রার্থী শফিকুল ইসলাম খান (নিচে ডানে)
সংগৃহীত

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া পৌরসভা নির্বাচনের ভোট গ্রহণ চতুর্থ ধাপে আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে। ভোট সামনে রেখে ভোটার, নির্বাচনী কার্যালয় ও চায়ের টেবিলে এখন নির্বাচনী আলোচনা সরগরম। মেয়র পদে কে জিতবেন, কার ‘ফিল্ড’ শক্তিশালী, কে চমক দেখাবেন—আলোচনা মূলত এটি ঘিরেই। আখাউড়া পৌর নির্বাচনে বিএনপি একক প্রার্থী দিলেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী তিনজন। এর একজন দলীয় মনোনীত প্রার্থী এবং দুজন স্বতন্ত্র পদে দাঁড়ানো ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী। দুটি দলই নিজ দলে বিভেদকেই জয়ের পথে বড় কাঁটা হিসেবে দেখছে।

আখাউড়া পৌরসভায় মোট ভোটার ২৮ হাজার ৯১০ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১৪ হাজার ২৩১ জন ও নারী ভোটার ১৪ হাজার ৬৭৯ জন। এবারের পৌর নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন চারজন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী (নৌকা প্রতীক) তাকজিল খলিফা। আর বিএনপির মনোনীত মেয়র প্রার্থী (ধানের শীষ) জয়নাল আবেদীন ওরফে আব্দু।

এদিকে আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য সাবেক পৌর মেয়র নুরুল হক ভূঁইয়া (নারকেলগাছ প্রতীক) এবং উপজেলা যুবলীগের কর্মী শফিকুল ইসলাম খান (মোবাইল ফোন প্রতীক)। আওয়ামী লীগের আরেকজন ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী ছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মোবারক হোসেন ওরফে রতন। মনোনয়ন চেয়ে না পেয়ে তিনি মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন।

‘বিদ্রোহী’রা তেমন আলোচনায় নেই। জয় নৌকার প্রার্থীরই নিশ্চিত।
আল মামুন সরকার, সাধারণ সম্পাদক, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগ

আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও স্থানীয় লোকজন বলেন, ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনা ছিলেন মোবারক হোসেন। নৌকার প্রার্থীর সঙ্গে তাঁর টক্কর জমবে বলে নিশ্চিত ছিলেন স্থানীয়রা। কিন্তু তিনি গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নিজের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন। এখন যে দুজন ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী মাঠে রয়েছেন, তাঁদেরকেও হেভিওয়েট মনে করছেন ভোটার ও দলীয় নেতা-কর্মীরা। আওয়ামী লীগের পথের কাঁটা এই ‘বিদ্রোহী’রা।

যদিও সেটা মানতে চাইলেন না জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকার। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘বিদ্রোহী’রা তেমন আলোচনায় নেই। জয় নৌকার প্রার্থীরই নিশ্চিত বলে তিনি দাবি করেন।

আওয়ামী লীগের দলীয় নেতা-কর্মীরা জানান, সাবেক পৌর মেয়র নুরুল হক ভূঁইয়ার আগের কার্যকলাপের কারণে পৌর এলাকার মানুষ সন্তুষ্ট না। তবে তাঁর ছেলে চিত্রনায়ক ও অভিনেতা জিয়াউল হক রোশানের কারণে তিনি কিছুটা আলোচনায় রয়েছেন। আর শফিকুল ইসলাম খান তেমন আলোচনায় নেই। অপর দিকে আখাউড়া পৌরসভার বর্তমান মেয়র উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক তাকজিল খলিফা স্থানীয় সাংসদ আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের অনুসারী ও ঘনিষ্ঠজন বলে পরিচিত। নানা কারণে তাকজিলই আলোচনায় এগিয়ে রয়েছেন।

এদিকে বিএনপিতে একক প্রার্থী থাকলেও নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব ও কমিটি নিয়ে দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধে বেকায়দায় রয়েছে তারাও। বিএনপির নেতা-কর্মীদের সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় বিএনপি এখন দুই ভাগে বিভক্ত। একদিকে রয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (কসবা-আখাউড়া) আসনের সাবেক সাংসদ ও বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মুশফিকুর রহমান এবং জেলা বিএনপির সহসভাপতি ও কেন্দ্রীয় কৃষক দলের সদস্য নাসির উদ্দিন হাজারী। দীর্ঘদিন ধরেই এই দুজনের নেতৃত্বে উপজেলা বিএনপির কার্যক্রম পরিচালিত হতো।

লন্ডনে থাকা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ব্যক্তিগত সহকারী আবদুর রহমান ওরফে সানির আপন বড় ভাই কবির আহমেদ। মেয়র পদে বিএনপির মনোনয়ন পাওয়া জয়নাল আবেদীন এই কবির আহমেদের অনুসারী।

আরেক দিকে রয়েছেন লন্ডনে থাকা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ব্যক্তিগত সহকারী আবদুর রহমান ওরফে সানির আপন বড় ভাই কবির আহমেদ। পুরো জেলাসহ আখাউড়া বিএনপিতে কোনো কমিটিতে না থাকায় বিএনপি বলয়ে প্রভাবশালী হিসেবে এই কবির আহমেদের উত্থান হয়। মেয়র পদে বিএনপির মনোনয়ন পাওয়া জয়নাল আবেদীন এই কবির আহমেদের অনুসারী।

এক থেকে দেড় বছর ধরে উপজেলা বিএনপি এই দুই ভাগের অনুসারী হিসেবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। বিএনপির নেতা-কর্মীরা জানান, কবির সদর উপজেলার বরিশাল গ্রামের বাসিন্দা। ১৯৯৭ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি আখাউড়া উপজেলা ছাত্রলীগের সহসাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলেন। কিন্তু ছোট ভাইয়ের প্রভাবে আখাউড়াসহ জেলা বিএনপি ও অঙ্গসংগঠন এখন কবিরের নেতৃত্বেই চলছে। উপজেলা ও পৌর বিএনপিতে নেতৃত্ব ও কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্ব-কোন্দলের প্রভাব পৌরসভা নির্বাচনে পড়বে বলে নেতা-কর্মীরা মনে করছেন।

স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীদের সূত্রে জানা গেছে, ১৩ জানুয়ারি জেলা বিএনপির আহ্বায়ক জিল্লুর রহমান স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সেলিম ভূঁইয়াকে আহ্বায়ক ও আক্তার খানকে সদস্যসচিব করে আখাউড়া পৌর বিএনপির ৩১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। ১৬ জানুয়ারি জিল্লুর নিজের ফেসবুকে এই সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পোস্ট করে কমিটির ঘোষণা দেন। সেলিম ভূঁইয়া কবির আহমেদের আরেক ভাই। তিনি সদর উপজেলার বরিশাল গ্রামের বাসিন্দা ও সদর উপজেলার বাসুদেব ইউনিয়ন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক পদে রয়েছেন। এই কমিটি গঠন প্রক্রিয়ার প্রতিবাদ করে কমিটি গঠনের পরদিন ১৭ জানুয়ারি চারজন নেতা ও ২৩ জানুয়ারি আরও সাতজন নেতা আহ্বায়ক কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন।

দলীয় বিভক্তির বিষয়টি জেলা বিএনপিকে বলেছি। বিরোধ ও বিভক্তি নিয়ে পথচলাটা কঠিন হয়ে যাবে। জেলা বিএনপি এটি অচিরেই সমাধান করবে।
জয়নাল আবেদীন, বিএনপির মেয়র প্রার্থী

এদিকে ওই কমিটি থেকে পদত্যাগ করা পৌর বিএনপির সাবেক সভাপতি বাহার মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘কমিটি থেকে পদত্যাগ করেছি, দল থেকে না। দলের প্রার্থীর পক্ষে নেতা-কর্মীরা কাজ করবেন। আবার অনেকে হয়তো অভিমান থেকে নীরব থাকবেন। এদিকে নির্বাচনে আমি নিজেই একজন কাউন্সিলর প্রার্থী।’

বিভক্তির বিষয়টি স্বীকার করে উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি মেয়র প্রার্থী জয়নাল আবেদীন ওরফে আব্দু বলেন, ‘দলীয় বিভক্তির বিষয়টি জেলা বিএনপিকে বলেছি। বিরোধ ও বিভক্তি নিয়ে পথচলাটা কঠিন হয়ে যাবে। জেলা বিএনপি এটি অচিরেই সমাধান করবে।’

এদিকে আখাউড়া পৌরসভার মেয়র ও আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী তাকজিল খলিফা বলেন, ‘দল, দলের নেতা-কর্মী ও পৌরবাসীর ওপর আমার আস্থা আছে। আমার বিশ্বাস, পৌরবাসী আমাকে নিরাশ করবে না।’