জাফরউল্যার ঘোষিত নৌকার প্রার্থী সোনার নৌকা দিয়ে যোগ দিলেন নিক্সন শিবিরে

কাচের বাক্সে রাখা দুই ভরির সোনার নৌকা। এটি উপহার দিয়েই স্বতন্ত্র সাংসদের সঙ্গে যোগ দিলেন চরভদ্রাসন উপজেলা উপনির্বাচনের আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী মো. কাউসার হোসেন (বাঁয়ে)। আজ শুক্রবার বিকেলে ভাঙ্গার আজিমনগর ইউনিয়নের ব্রাহ্মণপাড়া গ্রামেপ্রথম আলো

ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলা পরিষদ উপনির্বাচন। আগামী ১০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এই উপনির্বাচন গত ২৪ ঘণ্টায় বহু নাটকীয় ঘটনার জন্ম দিয়েছে। পাশার দানের মতো উল্টে গেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের স্থানীয় রাজনীতির বড় ঘুঁটি। আজ ‘নাটকের’ শেষের চমকটি একদিকে যেমন এলাকায় রাজনীতি নিয়ে চায়ের টেবিলের আলোচনা সরগরম করে তুলেছে, অন্যদিকে স্থানীয় আওয়ামী লীগের বড় দুইটি শিবিরকে এনেছে মুখোমুখি উত্তাপের কাছাকাছি।

নাটকের প্রথম অঙ্ক মঞ্চস্থ হয় গত ১২ ডিসেম্বর। ওই দিন চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. কাউসার হোসেনের নাম ঘোষণা দেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যা। ১৫ ডিসেম্বর ফরিদপুর-৪ আসনের সাংসদ মুজিবর রহমান চৌধুরী নিক্সন নিজের সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার আলী মোল্লার নাম ঘোষণা করেন।

ফরিদপুরে আওয়ামী লীগের রাজনীতি জাফরউল্যা-নিক্সন শিবিরে দ্বিধাবিভক্ত। কাজী জাফরউল্যা আওয়ামী লীগের আনুষ্ঠানিক অংশটির নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। নির্বাচনে নৌকা প্রতীকটি বরাবরই তাঁর শিবিরে থাকে। নিক্সন চৌধুরী দল থেকে সমর্থন না পেয়ে স্বতন্ত্র হিসেবেই ২০১৪ ও ২০১৮ সালে পর পর দুবার জাফরউল্যাকেই পরাজিত করে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন।

আমি এর আগে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যার বিশ্বস্ত হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছি। কিন্তু তিনি মানুষের প্রতি সম্মান দেখাতে পারেন না। আমি ২০০৯, ২০১৪ ও ২০১৯ সালে এ উপজেলার চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করেছি। কিন্তু জিততে পারিনি। এ নির্বাচনের আগে আমার উপলব্ধি হয়েছে, স্বতন্ত্র সাংসদের সমর্থন ছাড়া এ নির্বাচনে জেতা সম্ভব নয়।
মো. কাউসার হোসেন, চরভদ্রাসন উপজেলা পরিষদ উপনির্বাচনে নৌকার প্রার্থী

ফরিদপুর-৪ সংসদীয় আসনটি ভাঙ্গা, সদরপুর ও চরভদ্রাসন উপজেলা নিয়ে গঠিত। এখানকার রাজনীতিতে নিক্সন চৌধুরীর উত্থানের পর থেকেই সংসদ নির্বাচন ছাড়াও স্থানীয় সব নির্বাচনেই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়ে আসছে তাঁর স্বতন্ত্র শিবির (মূলত নৌকার বিদ্রোহী প্রার্থী) বনাম জাফরউল্যা শিবিরের নৌকার প্রার্থীর মধ্যে। এবারের উপনির্বাচনেও মনোনয়ন ঘোষণার পর থেকেই কাউসার দলীয় প্রতীক নৌকা নিয়ে এবং আনোয়ার আনারস প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে প্রচারণা শুরু করেন।

গত বছর ২৩ অক্টোবর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন মুসার মৃত্যুতে উপজেলার চেয়ারম্যান পদটি শূন্য হয়। গত ২৯ মার্চ এ উপনির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে ২৬ মার্চ ওই নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করা হয়। ১৩ সেপ্টেম্বর এক প্রজ্ঞাপনে ১০ অক্টোবর এ নির্বাচনের ভোট গ্রহণের দিন ধার্য করে নির্বাচন কমিশন।

নাটকের দ্বিতীয় অঙ্ক মঞ্চস্থ হয় গতকাল বৃহস্পতিবার। হঠাৎ করে দুপুরে নিক্সন–সমর্থিত প্রার্থী আনোয়ার আলী মোল্লা আওয়ামী লীগের প্রার্থী কাউসারকে সমর্থন দিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। আজ শুক্রবার প্রথম আলোর ছয়ের পাতায় ‘চরভদ্রাসনে উপনির্বাচন, সরে দাঁড়ালেন স্বতন্ত্র সাংসদের প্রার্থী’ শিরোনামে এ–সংক্রান্ত একটি খবরও প্রকাশিত হয়। সরে দাঁড়ানোর কারণ হিসেবে গতকাল আনোয়ার আলী মোল্লা বলেছিলেন, তাঁর নেতা সাংসদ নিক্সন চৌধুরী নৌকা প্রতীকের পক্ষে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। তাই নেতার নির্দেশেই সরে দাঁড়াচ্ছেন তিনি। কাজী জাফরউল্যাও বিষয়টি নিয়ে অবগত বলে তখন জানানো হয়।

আমার ডান পাশে দেখেন, বাঁ পাশে দেখেন—সবাই এখন আমার লোক। আমি দুবার এ এলাকার সাংসদ হয়েছি। এলাকার উন্নয়নে যে পরিমাণ কাজ করেছি, তা অতীতে হয়নি। তাই আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা যোগ দিচ্ছেন।
মুজিবর রহমান চৌধুরী নিক্সন, ফরিদপুর-৪ আসনের সাংসদ

নাটকের চূড়ান্ত অঙ্ক মঞ্চস্থ হয় আজ শুক্রবার। স্বতন্ত্র সাংসদ নিক্সন চৌধুরী নৌকার শিবিরে নন, বরং নৌকার প্রার্থীই আজ সোনার নৌকা নিয়ে হাজির হন নিক্সন চৌধুরীর ব্রাহ্মণপাড়ার বাসভবনে। তিনি তাঁর সমর্থকদের নিয়ে সেখানে দুপুরের খাওয়াদাওয়া করেন। বিকেলে সাংসদের হাতে সোনার নৌকা তুলে নৌকার প্রার্থী কাউসার হোসেন নিক্সন শিবিরে যোগ দেওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে ভাঙ্গার আজিমনগর ইউনিয়নের ব্রাহ্মণপাড়া গ্রামে এ যোগদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন ভাঙ্গা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সাহাদাত হোসেন।

যোগদান অনুষ্ঠানের ব্যানারে লেখা ছিল ‘সাংসদ নিক্সন চৌধুরীর প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করে চরভদ্রাসন উপজেলা পরিষদের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থী ও চরভদ্রাসন উপজেলা আওয়ামী লীগের সংগ্রামী সাধারণ সম্পাদক মো. কাউসারের যোগদান অনুষ্ঠান। প্রচারে চরভদ্রাসনের সর্বস্তরের জনগণ’।

অনুষ্ঠানের শুরুতে বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে সাংসদের হাতে একটি কাচের বাক্সে মোড়ানো দুই ভরি ওজনের একটি সোনার নৌকা তুলে দিয়ে নিক্সনের সঙ্গে যোগ দেন মো. কাউসার। একই সঙ্গে ফুলের তোড়া তুলে দিয়ে নিক্সনের সঙ্গে যোগ দেন চরভদ্রাসন সদর ইউনিয়নের সভাপতি মো. রুবেল মোল্লা, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বাবুল মোল্লা ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম মৃধা।

যোগদান অনুষ্ঠানে মো. কাউসার হোসেন বলেন, ‘আমি এর আগে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যার বিশ্বস্ত হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছি। কিন্তু তিনি মানুষের প্রতি সম্মান দেখাতে পারেন না। আমি ২০০৯, ২০১৪ ও ২০১৯ সালে এ উপজেলার চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করেছি। কিন্তু জিততে পারিনি। এ নির্বাচনের আগে আমার উপলব্ধি হয়েছে, স্বতন্ত্র সাংসদের সমর্থন ছাড়া এ নির্বাচনে জেতা সম্ভব নয়। তাই অনেক ভেবেচিন্তে পরামর্শ করে আমি সাংসদের সঙ্গে দেখা করেছি এবং যোগদানের এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

সাংসদ নিক্সন তাঁর বক্তব্যের শুরুতে ‘যদি থাকে নসিবে আপনা-আপনি আসিবে’ গানের কলি আওড়ান। কাউসারকে নিজ শিবিরে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার ডান পাশে দেখেন, বাঁ পাশে দেখেন—সবাই এখন আমার লোক। আমি দুবার এ এলাকার সাংসদ হয়েছি। এলাকার উন্নয়নে যে পরিমাণ কাজ করেছি, তা অতীতে হয়নি। তাই আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা যোগ দিচ্ছেন।’

নিক্সন শিবিরে যোগাদানের কারণে উপজেলা আওয়ামী লীগ অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে শুনে মো. কাউসার বলেন, ‘আমাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করার তারা কে? ওরা যে সভা করেছে, তার কোনো বৈধতা নেই। আমি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। সভা ডাকতে হলে আমি ডাকব। ওরা সভা ডাকা বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার কে?’

এদিকে, বৃহস্পতিবার রাতেই চরভদ্রাসন উপজেলার গাজিরটেক ইউনিয়নের চরসুলতানপুর গ্রামে উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ইসাহাক মিয়ার বাড়িতে এক জরুরি সভা করে উপজেলা আওয়ামী লীগ। ওই সভায় মো. কাউসারকে চরভদ্রাসনে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়।

উপজেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আজাদ খান আজ প্রথম আলোকে বলেন, দলের প্রার্থী হয়ে কাউসার নিক্সনের সঙ্গে যোগ দেওয়ায় ওই সভায় তাঁর প্রতি ধিক্কার জানানো হয় এবং তাঁকে চরভদ্রাসনে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়।

এ ব্যাপারে মো. কাউসার বলেন, ‘আমাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করার তারা কে? ওরা যে সভা করেছে, তার কোনো বৈধতা নেই। আমি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। সভা ডাকতে হলে আমি ডাকব। ওরা সভা ডাকা বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার কে?’ তিনি বলেন, ‘আমার সিদ্ধান্ত যথার্থ। যারা নৌকা করে, তারা আমাকে ছেড়ে যাবে না।’