‘দোষ করছে একজনে, ধরবেন আরেকজনকে সেইটা কোন কথা!’

রংপুরের পীরগঞ্জে পুলিশের ধরপাকড়ের প্রতিবাদে স্থানীয় নারীদের বিক্ষোভ। আজ শুক্রবার দুপুরে স্থানীয় বটেরহাট জামে মসজিদের সামনে
ছবি: রহিদুল মিয়া

রংপুরের পীরগঞ্জের খেদমতপুর গ্রামের গৃহিণী নুরজাহান বেগম। ঘরে বিদেশি গরু থাকায় আতঙ্কে রাত কাটছে তাঁর। কারণ, গ্রেপ্তারের আতঙ্কে চার দিন ধরে পুরুষেরা গ্রামছাড়া। পুলিশের ধরপাকড়ের প্রতিবাদে আজ শুক্রবার দুপুরে এলাকায় অন্যান্য নারীর সঙ্গে তাই বিক্ষোভে এসেছিলেন নুরজাহানও।

এ সময় পুলিশকে উদ্দেশ করে নুরজাহান বলেন, ‘অনেকগুলা মোটরসাইকেলোত চড়ি বাইরের লোক আসিয়া হিন্দু গ্রামোত আগুন নাগাইছে। এ্যালা দোষ হওচে (এখন দোষ হচ্ছে) হামার গ্রামের মানুষের। চার দিন থাকি বিদেশি গরু ও ছাওয়া নিয়া একলায় বাড়িত আছি। খুব ভয় হয় রাইতে কেউ যদি ক্ষতি করে। সারা রাইত জাগি থাকি। দোষ করছে একজনে, ধরবেন আরেকজনকে সেইটা কোন কথা!’ ক্ষুব্ধ নুরজাহান একপর্যায়ে বলেন, ‘হামরা আলছি হামাকও ধরি নিয়া যাও।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাপ–দাদার আম্বল থাকি হামরা হিন্দু–মুসলমান একসঙ্গে আছি। কখনো কিছু লাগে নাই। হামরা ভালো না খারাপ সেটা হিন্দুপাড়ার মানুষ সবাই জানে।’

পীরগঞ্জে হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত রামনাথপুর ইউনিয়নের হিন্দুপল্লির অদূরে বটেরহাট জামে মসজিদের পাশে আজ শুক্রবার বেলা আড়াইটার দিকে বিক্ষোভ করেন নুরজাহানের মতো পাঁচ শতাধিক নারী। খবর পেয়ে সেখানে উপস্থিত হন পুলিশ সদস্যরা। তবে পুলিশ দেখে নারীরা কিছুটা উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। তখন তাঁদের শান্ত করার চেষ্টা করেন পীরগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) একরামুল হক।

রামনাথপুর মাঝিপাড়া গ্রামের বড় করিমপুর এলাকায় গত রোববার রাতে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে উত্তেজিত জনতার দেওয়া আগুনে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের ২১টি ঘর পুড়ে যায়। ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয় অন্তত ৪০টি বাড়িতে। এ সময় বাড়ির লোকজন ধানখেত ও আশপাশের জঙ্গলে লুকিয়ে রক্ষা পান। পুলিশ উত্তেজিত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে ৬১টি রাবার বুলেট ও ১০টি কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। এরপর পুলিশের অভয়ে লুকিয়ে থাকা লোকজন ওই দিন ভোরে পোড়া ঘরে ফেরেন।

প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, আজ শুক্রবার দুপুরে খেদমতপুর, বড় রাজারামপুর, রাজারামপুর, মাদারগঞ্জসহ আশপাশের গ্রামগুলোর পাঁচ শতাধিক নারী ও শিশু বটেরহাট জামে মসজিদের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন। আগে থেকে সেখানে অবস্থান করছিলেন কয়েকজন বিজিবি সদস্য। পাশের খেদমতপুর গ্রামের দিক থেকে উত্তেজিত নারীদের এগিয়ে আসা দেখে বিজিবি সদস্যরা সেখান থেকে অবস্থান পরিবর্তন করে খানিকটা দূরে সরে যান।

আরও পড়ুন

এ সময় এসআই একরামুল হকের উদ্দেশে বড় রাজারামপুর গ্রামের নিলুফা খাতুন (২৪) ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘তোমার (পুলিশের) ভয়োতে হামার গ্রামোত কোন পুরুষ মানুষ নাই। রাইতে ছাওয়াছোটো নিয়া একলায় থাকি। হামার নিরাপত্তা দেবে কাঁয়? বাজার করার মোতোন বাড়িত লোক নাই।’

খেদমতপুর গ্রামের নাসিমা বেগম পুলিশকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘যাকে পান তাঁকে ধরোছেন। সেই জন্যে পুরুষ মানুষ কাঁয়ো বাড়িত থাকে না। হামরাও চাই অপরাধী ধরো। কিন্তু সবায় কি অপরাধ করছে?’

রাজারামপুর গ্রামের শরিফা বেগম বলেন, ‘মোর স্বামীক (আবুল কালাম) রাস্তা থাকি ধরি নিয়া গেইচে। ছাওয়াচোটো নিয়া খুব কষ্টোত পড়চু। ঘরোত খাবার নাই। সকাল হইলে কোলের বাচ্চা ছোঁয়ামনি বাবাক খোঁজে। তোমারওতো (পুলিশের) বাড়ি ছাওয়া আছে। তোরা বোঝেন না!’

বিক্ষোভে অংশ নিতে পীরগঞ্জের খেদমতপুর গ্রাম থেকে আসছেন নারীরা। আজ শুক্রবার দুপুরে
ছবি: প্রথম আলো

খেদমতপুর গ্রামের রাবেয়া বেগম (৪৫) বলেন, ‘মোর ছাওয়া দুইটা নির্দোষ। বটেরহাটে মোস্তফার দোকানে চাকরি করে। দুইটা ছাওয়াকে স্যাটে থাকি ধরি নিয়া গেইচেন।’
মাদারগঞ্জ থেকে আসা মনিরা আক্তার বলেন, ‘বিনা দোষে বাপ, চাচা, ভাইয়েরা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। খরচপাতি নাই। খরচখালা না করলে কী খায়া থাকমো। আমরাও দোষীদের বিচার চাই। যাঁরা দোষ করে নাই তাঁরা কেন পালে থাকবে?’

এতসব প্রশ্নের মুখে এসআই একরামুল হক ক্ষুব্ধ নারীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা বিশৃঙ্খলা করবেন না। শান্ত হন। রোববার আপনাদের সঙ্গে বসা হবে। আপনাদের যা কথা আছে শোনা হবে। আপনারা ঘরে ফিরে যান।’

এ সময় পুলিশকে উদ্দেশ করে ক্ষুব্ধ এক নারী বলেন, ‘আগামী রোববার যদি আপনারা না বসেন, কথা না শোনেন, সুষ্ঠু বিচার যদি না করেন, তাহলে আজকে ৫০০ জন আসছি আগামীতে ৫০০০ মহিলা আসব। ওই দিন সবাইকে ধরি নিয়া যাবেন।’ একপর্যায়ে তাঁরা ঘরে ফিরে যান।

আরও পড়ুন

নারীদের অভিযোগ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট রামনাথপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দুলাল হোসেন বলেন, পুলিশ তাঁর এলাকার বেশ কিছু নিরীহ মানুষকে ধরে নিয়ে গেছে। ধরপাকড়ে আশপাশের গ্রামগুলো পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। বিষয়টি তিনি স্থানীয় সাংসদকে (স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী) জানিয়েছেন।

অভিযোগের বিষয়ে রংপুরের পুলিশ সুপার বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, ‘আমরা কোনো নিরীহ মানুষকে ধরছি না। যাঁরা জড়িত, তাঁদেরকেই ধরা হচ্ছে। তাহলে জড়িত নন এমন ব্যক্তিরা পালিয়ে থাকবেন কেন!’