হাওরের পরিস্থিতি ভালো নয়, ঝুঁকির মুখে কৃষকের ধান
সুনামগঞ্জের হাওর এলাকায় চাষ করা ধান এখনো সবুজ, কাঁচা। পাকতে আরও ১০–১২ দিন সময় নেবে। এর মধ্যেই ভারী বৃষ্টি ও উজানের পাহাড়ি ঢলে কৃষকের শ্রমে–ঘামে ফলানো এসব ‘সোনার ধান’ ঝুঁকির মুখে পড়েছে। এতে চরম আতঙ্ক আর উদ্বেগে আছেন কৃষকেরা। গতকাল শনিবার টাঙ্গুয়ার হাওরের একটি ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে বেশ কিছু জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় কৃষকদের উদ্বেগ আরও বেড়েছে।
কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সুনামগঞ্জের ছোট-বড় ১৫৪টি হাওরে এবার ২ লাখ ২২ হাজার ৮০৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। এতে ৩ হাজার ২২০ কোটি টাকার বোরো ধান উৎপাদিত হওয়ার কথা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, ভারতের মেঘালয়, চেরাপুঞ্জিতে অতিবৃষ্টি হলেই ঢল নামে সুনামগঞ্জে। সেখানে গত ৪ দিনে ৫৪৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এতে করে ব্যাপক পরিমাণে পাহাড়ি ঢল নামছে সুনামগঞ্জে। জেলার নদ-নদী ও হাওরে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। তাহিরপুর উপজেলার মাটিয়ান হাওর, শনির হাওর, সমসার হাওরসহ সব কটি হাওরের ফসলই এখন ঝুঁকিতে আছে। একইভাবে জেলার জামালগঞ্জ, ধর্মপাশা, দিরাই ও শাল্লায় উপজেলায় নদ-নদীতে পানি বাড়ছে। বিভিন্ন স্থানে ফসল রক্ষা বাঁধে ধস ও ফাটল দেখা দিয়েছে।
‘হাওর বাঁচাও আন্দোলনের’ নেতারা বলছেন, শুধু উজানের ঢলের দোহাই দিলে চলবে না, ফসল ঝুঁকিতে পড়ার মূল কারণ হচ্ছে বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম ও গাফিলতি। নির্ধারিত সময়ের এক মাস পরও বাঁধের কাজ শেষ হয়নি। মূল কাজ রেখে প্রশাসন, পাউবোর কর্মকর্তারা কীভাবে একের পর একে প্রকল্প আর প্রাক্কলন বাড়ানো যায়, সেটিতেই গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি।
‘বুক কাঁপছে। কৃষকদের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। পরিস্থিতি মোটেও ভালো নয়। যদি পানি আরও বাড়ে, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুনামগঞ্জে চার-পাঁচ বছর পরপর অকালবন্যাসহ প্রাকৃতিক কোনো কারণে হাওরের ফসলের ক্ষতি হয়। সর্বশেষ ২০১৭ সালে ফসলডুবিতে হাওর থেকে একেবারে শূন্য হাতে ফিরেছিলেন কৃষকেরা। তাই এবার শুরু থেকেই একটা আশঙ্কা ছিল। কৃষকেরা বলছেন, যেভাবে পাহাড়ি ঢল নামছে, নদ-নদীর পানি বাড়ছে, এতে করে তাঁরা ২০১৭ সালের মতো পরিস্থিতির আশঙ্কা করছেন। বৃষ্টি ও ঢল না থামলে পানি উন্নয়ন বোর্ড যেসব বাঁধ দিয়েছে, তাতে ফসল রক্ষা হবে না।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান করুণা সিন্ধু চৌধুরী বলেছেন, ‘বুক কাঁপছে। কৃষকদের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। পরিস্থিতি মোটেও ভালো নয়। যদি পানি আরও বাড়ে, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। তাই গ্রামে গ্রামে মানুষকে খবর দেওয়া হয়েছে, সবাই যেন বাঁধে অবস্থান নেন।’
তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওরকে বলা হয় জেলার বোরোভান্ডার। শনিবার বিকেলে হাওরে সবুজ ধানখেত দেখিয়ে স্থানীয় জামালগড় গ্রামের কৃষক আবদুন নূর (৫২) বলেন, ‘ধানে মাত্র থোর (শিষ) আসছে। টাঙ্গুয়া ডুবছে শুনছি। নদীত পানি ভরা। এর লাগি মনে ভয় ঢুকছে। এই জমির ধানের উপরই আমরার বাঁচা-মরা, বাবা।’
চিকসা গ্রামের কৃষক সুবাস তালুকদার (৪৮) বলেন, ‘ইবার (এ বছর) ২০১৭ সালের মতো আগে আগে ঘোলা (ঢল) আইছে। ধান তো কাঁচা। যদি ধান না পাই, তাইলে সংসার, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া কি-লা চলব। এসব মনও অইলে রাইতে ঘুম অয় না।’
তাহিরপুর উপজেলা সদর থেকে বৌলাই নদ হয়ে টাঙ্গুয়ার হাওরে যাওয়ার পথে ডান পাশে জেলার বৃহৎ মাটিয়ান হাওর, বাঁ দিকে শনির হাওর। এই নদে ২০১৭ সালের পর এই সময়ে এত পানি দেখেননি স্থানীয় লোকজন। পাহাড়ি ঢলের ঘোলা জলে নদ ভরে গেছে। যেন বর্ষার দৃশ্য। নদের দুই পাড়ে ফসল রক্ষা বাঁধ। যেতে যেতে চোখে পড়ে বাঁধের বিভিন্ন স্থানে মাটি নরম, কাঁচা। বৃষ্টিতে কোথাও ফাটল, কোথাও চির ধরেছে। বাঁধের ঢালে ঘাস লাগানোর কথা থাকলেও অনেক স্থানেই ঘাস নেই। কোনো কোনো স্থানে কাজ করছেন লোকজন।
বৌলাই নদের পাটাবুকা, সুলেমানপুর; পাটলাই নদের ছিলান তাহিরপুর; মাটিয়ান হাওরের আনন্দপুর এলাকায় বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় দেখা গেছে। মাটিয়ান হাওরের ৫৩ নম্বর প্রকল্পে গিয়ে দেখা যায়, ১৫-২০ জন লোক বাঁধের দুই পাশে বাঁশের আড় দিয়ে বস্তা ফেলার কাজ চলছে। বাঁধের পূর্ব প্রান্তে এখনো মাটির কাজ চলছে। এই হাওরের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান এটি। নির্ধারিত সময়ের এক মাস পরও কাজ শেষ হয়নি কেন, জানতে চাইলে এই প্রকল্পের সভাপতি স্থানীয় বাসিন্দা মতিউর রহমান বলেন, জায়গাটিতে গভীর খাদ ছিল। অন্তত ছয়বার বাঁধে ধসের ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টি প্রশাসন ও পাউবো কর্মকর্তারাও জানেন। এ কারণেই কাজে বিলম্ব হয়েছে।
পাশে থাকা দুজন কৃষক তখন জানান, আসলে কাজই শুরু হয়েছে নির্ধারিত সময়ের অনেক পর। শুধু এটি নয়, উপজেলার বেশির ভাগ বাঁধের কাজই সময়মতো শুরু ও শেষ হয়নি। যে কারণে শেষ দিকে তাড়াহুড়া করে কাজ করতে গিয়ে কাজ দুর্বল হয়েছে।
‘হাওর বাঁচাও আন্দোলনের’ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, ‘শুধু তাহিরপুর নয়, পুরো জেলার চিত্র একই। অকালবন্যা ও পাহাড়ি ঢলের কবল থেকে ফসল রক্ষা করতেই বাঁধ দেওয়া হয়। এতে সরকার শতকোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। এখন কেবল উজানের ঢলের দোহাই দিয়ে দায় এড়াতে চাইছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এটা হবে না। বাঁধের কাজে নানাভাবে অনিয়ম, গাফিলতি ছিল। আমরা হাওরে হাওরে ঘুরে এসব তুলে ধরেছি। কিন্তু কোনো ফল হয়নি।’
পাউবো সূত্রে জানা গেছে, এবার জেলার হাওরে ৭২৭টি প্রকল্পে ১২১ কোটি টাকার ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ হয়েছে। এই বাঁধের নির্মাণকাজের সময়সীমা ছিল ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি।
সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহরুল ইসলাম বলেছেন, সুনামগঞ্জে কম বৃষ্টি হয়েছে, চেরাপুঞ্জির ব্যাপক বৃষ্টিতে ঢল নেমে একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এতে হাওরের ফসল ঝুঁকিতে রয়েছে। প্রতিটি বাঁধে তাঁদের লোক আছে। যেখানে যেটি করা দরকার, সেটি তাঁরা করছেন। এ ছাড়া ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ নীতিমালা অনুযায়ী হয়েছে।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেছেন, ‘প্রশাসন ও পাউবো কর্মকর্তারা মাঠে আছেন। জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় লোকজনকেও হাওরে থাকতে অনুরোধ করা হয়েছে। সবাইকে সতর্ক থাকতে এবং প্রতিটি বাঁধে নজরদারি বাড়াতে বলা হয়েছে। এখনো হাওরগুলো সুরক্ষিত আছে। বৃষ্টি না হলে আশা করি পরিস্থিতির উন্নতি হবে।’
এদিকে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার নজরখালী ফসল রক্ষা বাঁধটি ভেঙে যাওয়ায় পাহাড়ি ঢলের পানি ধর্মপাশা উপজেলার বংশীকুণ্ডা দক্ষিণ ইউনিয়নের সীমানায় থাকা টাঙ্গুয়ার হাওরে ঢুকছে। এই পানি বৃদ্ধি পেলে টাঙ্গুয়ার হাওরে থাকা এ উপজেলার ৫৪০ হেক্টর বোরো জমির ধান তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে উপজেলা কৃষি বিভাগের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. নাজমুল ইসলাম আজ রোববার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, এখনো ফসল তলিয়ে যাওয়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। পানি এখন কিছুটা স্থিতিশীল রয়েছে। তবে পানি বৃদ্ধি পেলে টাঙ্গুয়ার হাওরে থাকা উপজেলার ৫৪০ হেক্টর বোরো জমির ধান তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।