জমি বিক্রি, বন্ধক ও ঋণের টাকায় চিকিৎসা চালিয়ে এসেছিলেন তাঁরা

সারাহ ইসলাম
ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

পাঁচ দিন আগে সারাহ ইসলামের দান করা কিডনি প্রতিস্থাপিত হয়েছে তাঁর শরীরে। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন তিনি। গতকাল সোমবার দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা গেল, ওই নারীর স্বামী ও বড় ভাই রক্তের ব্যাগ নিয়ে ছোটাছুটি করছেন। কারণ, তাঁকে রক্ত দিতে হবে।

রক্ত দিতে দৌড়াদৌড়ি শেষ হওয়ার পর কথা হয় তাঁদের সঙ্গে। দুজন জানালেন, কখন কী প্রয়োজন হয়, সে জন্য তাঁরা এখানেই অপেক্ষা করেন। রাতে তাঁরা এখানকার একটি কেবিনে থাকেন। রোগী এখন অল্প স্বল্প কথা বলছেন। গত রোববার প্রথম মুখে খাবার (স্যুপ) দেওয়া হয়। গতকাল সকালে শক্ত খাবার দেওয়া হয়েছে। বাসা থেকে এনে সকালে রুটি ও সবজি এবং দুপুরে জাউ ভাত, লাউ ও মুরগির তরকারি খাওয়ানো হয়েছে।  

দেশে প্রথমবারের মতো মৃত্যুর পর কিডনি দান করে সারাহ ইসলাম (২০) এখন মানুষের কাছে এক শ্রদ্ধার নাম। তিনি কর্নিয়াও দান করেছেন। এ নিয়ে গত বৃহস্পতিবার ‘দেশে প্রথম মরণোত্তর দানের কিডনি দুজনের দেহে প্রতিস্থাপন’ শিরোনামে প্রথম আলোয় সংবাদ প্রকাশ করা হয়। আগের দিন বুধবার সারাহ ইসলামের দান করা দুটি কিডনির একটি প্রতিস্থাপন করা হয় বিএসএমএমইউতে। আধা ঘণ্টার ব্যবধানে অন্যটি প্রতিস্থাপন করা হয় কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ও গবেষণা ইনস্টিটিউট বাংলাদেশে।

‘কিডনি প্রতিস্থাপন অনেক জটিল একটি অস্ত্রোপচার। কিডনি ঠিকভাবে কাজ করছে কি না, তা বুঝতে অন্তত ছয় মাস অপেক্ষা করতে হবে’-
শেখ মো. মইনুল ইসলাম, চিকিৎসক, কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ও গবেষণা ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ
আরও পড়ুন

হাসপাতালের একটি বারান্দার বেঞ্চে বসে ওই নারীর স্বামী ও ভাইয়ের কাছ থেকে জানা গেল গত পাঁচ বছরে তাঁর কিডনি চিকিৎসা নিয়ে পরিবারের পথচলার কষ্টের গল্প। চিকিৎসার জন্য বাড়ি বন্ধক, জমি বিক্রি আর আত্মীয়স্বজনের কাছে ঋণ নিতে হয়েছে তাঁদের। কিডনি দানের জন্য সারাহর কাছে তাঁদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

ইউডার চারুকলা বিভাগে পড়তেন সারাহ ইসলাম
ছবি: প্রথম আলো
আরও পড়ুন
ওই নারীর ভাই জানান, একপর্যায়ে তাঁর মায়ের সঙ্গে বোনের কিডনির সবকিছু মিলে গেলে তিনি কিডনি দিতে চেয়েছিলেন। তবে জাতীয় পরিচয়পত্র অনুসারে মায়ের বয়স ৬৫ বছরের বেশি ছিল। চিকিৎসকেরা জানান, ৬৫ বছরের নিচে না হলে তাঁরা কিডনি নেবেন না।

কিডনি দিতে চেয়েছিলেন মা

বিএসএমএমইউতে সারাহর কিডনি পাওয়া ওই নারীর বয়স ৩৪ বছর। গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ী। স্বামী ও ১১ বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে তিনি বসবাস করেন রাজধানীর মিরপুরে। পাঁচ বছর আগে তাঁর প্রস্রাবে সংক্রমণ দেখা দেয়। ওই সময়ের একদিন গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন তিনি। ধরা পড়ে, তাঁর শরীরে ক্রিয়েটেনিন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। এর পর থেকে সময়ে–সময়ে ক্রিয়েটেনিনের মাত্রা বাড়তে থাকে, আর গুরুতর অসুস্থ হতে থাকেন তিনি।

ওই নারীর স্বামী বলেন, পাঁচ বছর আগে রাজবাড়ী ও ফরিদপুরে চিকিৎসকদের দেখানোর পর তাঁর স্ত্রীকে ঢাকায় নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। এরপর ঢাকার কয়েকটি ব্যয়বহুল বেসরকারি হাসপাতালে স্ত্রীর চিকিৎসা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়। সাড়ে চার বছর আগে ভারতের চেন্নাইতে গিয়ে চিকিৎসা নেন তিনি। সেখানের চিকিৎসকেরা ডায়ালাইসিস শুরু করার পরামর্শ দেন।

দেশে ফিরে কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ও গবেষণা ইনস্টিটিউট বাংলাদেশে তাঁর স্ত্রীর নিয়মিত চিকিৎসা দেওয়া শুরু হয়। সারাহর কিডনি পাওয়া ওই নারী তিন ভাইবোনের মধ্যে ছোট। বাবা বেঁচে নেই। তাঁর মেজ ভাই বলেন, সাড়ে তিন বছর ধরে তাঁর বোনের ডায়ালাইসিস চলেছে। সপ্তাহে দুটি ডায়ালাইসিস আর একটি ইনজেকশন লাগত। ওষুধ ও বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাদেই সপ্তাহে খরচ হতো ৫ হাজার টাকার বেশি। মাসে মোট ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা খরচ হতো।

রোগীকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। এটার সুস্থতা সময়সাপেক্ষ।
হাবিবুর রহমান (দুলাল), বিএসএমএমইউর রেনাল ট্রান্সপ্ল্যান্ট বিভাগের প্রধান অধ্যাপক

ওই নারীর ভাই জানান, একপর্যায়ে তাঁর মায়ের সঙ্গে বোনের কিডনির সবকিছু মিলে গেল তিনি কিডনি দিতে চেয়েছিলেন। তবে জাতীয় পরিচয়পত্র অনুসারে মায়ের বয়স ৬৫ বছরের বেশি ছিল। চিকিৎসকেরা জানান, ৬৫ বছরের নিচে না হলে কিডনি নেওয়া যাবে না।

ওই নারীর মেজ ভাই জানান, আড়াই বছর আগে কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ও গবেষণা ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ মরণোত্তর কিডনি দান নিয়ে একটি সম্মেলন করে। সেখানে তাঁর বোন ও মা উপস্থিত ছিলেন। হাসপাতালের এক চিকিৎসক জানান, মৃত ব্যক্তির কিডনি নিতে ইচ্ছুক হলে কয়েকটি ফরম পূরণ করে এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাগজপত্র জমা দিয়ে যেতে পারেন তাঁরা। ফরম পূরণের পর আড়াই বছর ধরে তাঁরা একাধিকবার কিডনি পাওয়া গেছে কি না জানতে ফোন করেছিলেন। কিন্তু কোনো সুখবর পাননি।

অঙ্গ দান করে দেশে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন সারাহ ইসলাম
ছবি: প্রথম আলো

এরই মধ্যে কিডনি ফাউন্ডেশনের টয়লেটের দেয়ালে ‘কিডনি বিক্রি করতে চাই’ জানিয়ে সাঁটা একটি কাগজ চোখে পড়ে তাঁদের। ওই কাগজে লেখা মুঠোফোন নম্বরে ফোন করা হলে একজন ছাত্র ফোন ধরেন। ওই ছাত্র কিডনির বিনিময়ে ১২ লাখ টাকা চান। তবে তাঁরা ৮ লাখ টাকা দিতে চেয়েছিলেন।

আরও পড়ুন

এরপর ৪ লাখ টাকায় আরেক কিডনি বিক্রেতার সন্ধান পেয়েছিলেন। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, নিকটাত্মীয় না হলে তারা কিডনি প্রতিস্থাপন করবে না। বিক্রি করা কিডনিও প্রতিস্থাপন করবে না।

ওই নারীর স্বামী জানান, গত বুধবার সকালে বিএসএমএমইউ থেকে তাঁকে ফোন করে বলা হয়, একজন (সারাহ) মরণোত্তর কিডনি দান করেছেন। তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে সবকিছু মিলে গেলে কিডনি দেওয়া যাবে। তাঁর স্ত্রীর মতো আরও চারজনকে ডাকা হয়। এর মধ্যে দুজনের সঙ্গে দান করা কিডনির সবচেয়ে বেশি মিলে যায়। রাতে তাঁর স্ত্রীর অস্ত্রোপচার হয়।

৫ বছরে ঋণের ভার অনেক

ওই নারীর স্বামী ও ভাই জানান, চিকিৎসার জন্য দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়ে তাঁদের পেশা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুজন বলতে গেলে এখন বেকার। ওই নারীর স্বামী বলেন, দুই পরিবারের গত পাঁচ বছরে ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। তিনি নিজের সঞ্চিত অর্থ খরচ করেছেন, স্বজনদের কাছ থেকে সহায়তাও পেয়েছেন। অনেক টাকা ঋণ করেছেন। তিনি আর কুলাতে পারছিলেন না। ওই সময়ে তাঁর স্ত্রীর ভাইয়েরা জমি বিক্রি করে টাকা দেন।

আর ভাই বলেন, তাঁদের সম্পদ তেমন কিছুই নেই। বোনের চিকিৎসার জন্য দুই বছর আগে ১৬ শতকের বসতবাড়ি কৃষি ব্যাংকের কাছে বন্ধক রেখে ২ লাখ টাকা নেন। ঋণের একটা কিস্তিও দিতে পারেননি। এখন ওই টাকা আরও বেড়েছে। দুটো জমি বিক্রি করা হয়েছে ১০ লাখ ৭০ হাজার টাকায়। বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তির কাছ থেকেও কিছু সহায়তা পেয়েছেন।

আরও পড়ুন

ভাই আরও বলেন বলেন, কিডনি চিকিৎসা এত ব্যয়বহুল যে ওই টাকা খরচ হতেও বেশি সময় লাগেনি। গত দুই মাস বোনের চিকিৎসাও অর্থাভাবে ব্যাহত হয়েছে। সপ্তাহে ১ হাজার ৯০০ টাকার যে ইনজেকশনটি দিতে হয়, সেটি মাঝেমধ্যে বাদ পড়ে গেছে। কিডনি প্রতিস্থাপনের পরও এক বছর ওষুধ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর থাকতে হবে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।

ভাইয়ের ভাষায়, ‘দুটো সংসার এখন এলোমেলো। কিডনি রোগী যাঁদের পরিবারে আছে, তাঁরা এই কষ্টটা বুঝতে পারবেন। সারাহ ইসলামের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার কোনো শেষ নেই! তাঁর মতো আরও অনেকে যদি মরণোত্তর কিডনি দান করেন, তাহলে অনেক মানুষ এই কষ্ট থেকে বাঁচবেন।’

এখনো ৬ মাসের অপেক্ষা

সারাহ ইসলামের শরীর থেকে কিডনি নিয়ে ওই নারীর শরীরে প্রতিস্থাপনে অস্ত্রোপচারের নেতৃত্ব দেন বিএসএমএমইউর রেনাল ট্রান্সপ্ল্যান্ট বিভাগের প্রধান অধ্যাপক হাবিবুর রহমান (দুলাল)। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, রোগীকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। এটার সুস্থতা সময়সাপেক্ষ।

সারাহ ইসলামের আরেকটি কিডনি কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে প্রতিস্থাপিত হয়েছে অন্য এক নারীর শরীরে। ওই হাসপাতালের চিকিৎসক শেখ মো. মইনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘রোগী সুস্থ কি না, এটা বলার মতো সময় এখনো হয়নি। কিডনি প্রতিস্থাপন অনেক জটিল একটি অস্ত্রোপচার। কিডনি ঠিকভাবে কাজ করছে কি না, তা বুঝতে অন্তত ছয় মাস অপেক্ষা করতে হবে।’