হাওরে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা ধানের ব্লাস্ট রোগ

হাওরে এ বছর ঢলের পানিতে ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর সঙ্গে এবার যুক্ত হলো ব্লাস্ট রোগ।

হাওরে ধান কাটা চলছে। সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার লুঙ্গাতুঙ্গা হাওরেফাইল ছবি

মার্চের শুরু থেকে হাওরে বোরো ধানে ছত্রাকজনিত ব্লাস্ট রোগ ছড়িয়ে পড়ার খবর আসছিল। দেশের বৃহত্তম হাওর মৌলভীবাজারের হাকালুকি থেকে শুরু করে কিশোরগঞ্জের ইটনার এলংজুরি এলাকার হাওর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে ব্লাস্ট রোগ। এ রোগে প্রথমে ধানগাছের শিষ ভেঙে যায়, ধান সম্পূর্ণ শুকিয়ে চিটা হয়ে যায়, শুকিয়ে যায় ধানগাছের পাতাও। কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে খেতের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত ব্লাস্ট রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ধান সব চিটা হয়ে যায় নিমেষে।

হাওরে এ বছর ঢলের পানিতে ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর সঙ্গে এবার যুক্ত হলো ব্লাস্ট রোগ।

এবার হাওর এলাকায় বিআর-২৮ ধানের জমির অন্তত এক-চতুর্থাংশ নেক ব্লাস্টে আক্রান্ত হয়েছে। কৃষকদের এ হিসাবে কৃষি কর্মকর্তারা দ্বিমত করতে পারেন। ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ দেখে কৃষকেরা দিশাহারা হলেও স্থানীয় কৃষি কর্তারা তখন বলেছিলেন, এতে মূল উৎপাদনে কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে না।

কৃষি কর্মকর্তার কথায় আমরা বাজার থাইক্কা কীটনাশক নিয়া ছিটাইতাছি, তা-ও কাম হইতাছে না। ঋণ নিয়া ধান করছি। ফলন না পাইলে ঋণ কিবা কইরা শোধ করমু।
শেরপুরে নকলার বরইতার গ্রামের রহুল আমিন

কিশোরগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মার্চ মাসে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘আমরা কিন্তু কৃষকদের ব্রি-২৮ ধান চাষ করতে নিরুৎসাহিত করি। কারণ, এ জাত অনেক পুরোনো হয়ে গেছে। এখন আমরা পরামর্শ দিই কৃষকদের ব্রি-৮৮ জাতের ধান চাষ করতে। কিন্তু আগাম ফসল তোলার জন্য কৃষকেরা কৃষি বিভাগের পরামর্শ না নিয়ে ব্রি-২৮ চাষ করেন। এ ধানে নেক ব্লাস্ট বেশি হয়। তবে আশা করি, নেক ব্লাস্টের সমস্যা দ্রুত কেটে যাবে। চাষিরা যেন এ নিয়ে আতঙ্কিত না হন।’ শেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালকও গণমাধ্যমকে ব্রি-২৮ সম্পর্কে প্রায় একই কথা বলেছেন।

কিন্তু যাঁর ধান চিটা হয়ে যাচ্ছে, তিনি আতঙ্কিত না হয়ে উদ্বাহু নৃত্য করবেন এমন আশা করা যায় না। যদি ব্রি-২৮ জাতের দিন শেষ হয়ে গিয়ে থাকে, রোগবালাই প্রতিরোধের ক্ষমতা একেবারে কমেই যায়, তাহলে এ বীজ বাজারে রাখা হয়েছে কেন?

খবর নিয়ে জানা গেল, বাংলাদেশে হীরা হাইব্রিড ধান চাষ শুরু হয় ১৯৯৬ সালে। প্রথম বছর মাত্র ১৫ টন ধান চাষ হয়েছিল। ২০১০ সালে ৮ হাজার টনে দাঁড়ায়। তারপর এ জাতের ধানের আবাদ বেড়েই চলেছে। তবে বাংলাদেশে শুধু হীরা ধান কত হেক্টর জমিতে চাষ হচ্ছে, সেটার সুনির্দিষ্ট হিসাব পাওয়া যায়নি। মোটা জাতের হীরা ধান কাটিং ও পলিশ করে আমাদের পাতে মিনিকেট নামে চলে আসে। বাজারে কোনো হীরা চাল নেই।

কৃষক কেন ব্রি-২৮ পছন্দ করেন

ব্রি-২৮ জাতের ধান ১৪০ দিনের কম সময়ের ফসল। এ ধানের জীবনকাল ১৩৫ থেকে ১৪০ দিন, উচ্চতা ৮৫ থেকে ৯০ সেন্টিমিটার এবং ফলন হেক্টরে ৫ থেকে ৬ টন। একই সময়ে অবমুক্ত ব্রি-ধান ২৯-এর জীবনকাল ১৫৫ থেকে ১৬০ দিন, উচ্চতা ৯০ থেকে ৯৫ সেন্টিমিটার এবং ফলন হেক্টরে ৭ থেকে ৮ টন। বন্যা আর পাহাড়ি ঢলের ঝুঁকিতে থাকা হাওরের মানুষের কাছে ১০ থেকে ১৫ দিন অনেক বড় সময়। ঢলের ফাঁড়া এড়ানোর জন্য তাই সে কম সময়ের ধানের দিকেই ঝোঁকেন।

আরও পড়ুন

১৯৯৪ সালে অবমুক্ত হওয়ার পর থেকে ২৮ বছর ধরে ব্রি-২৮ আমাদের কৃষিতে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখে এসেছে। চূড়ান্ত অনুমোদনের পর কৃষক পর্যায়ে ব্যাপকভাবে প্রদর্শনী করা হয়। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ব্রি-২৮ কৃষকের কাছে জনপ্রিয়তা পায়। জাত দুটির উচ্চফলন, সুস্বাদু ভাতের পাশাপাশি মাঝারি উচ্চতার হওয়ায় কৃষকের খড়ের চাহিদাও পূরণ হয়। রোগবালাই প্রতিরোধ ক্ষমতাও মোটামুটি। তা ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে বিকল্প ভালো জাত না আসায় এ জাত দুটি মেগা ভ্যারাইটিতে রূপান্তরিত হয়। এখন ব্রি-২৮ বন্ধ করতে হলে এর বীজ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ বন্ধ করতে হবে। কৃষককে উদ্বুদ্ধ করতে যা যা করা হয়েছিল, তার চেয়ে বরং বেশি কিছু করতে হবে। তাকে খুলে বলতে হবে একটা সময় পর আমাদের নতুন জাতের ব্যবহার করতে হয়। পুরোনো জাতের রোগবালাই প্রতিরোধের ক্ষমতা দিন দিন কমে যায়।

অন্যথায় কৃষকদের আহাজারি বন্ধ হবে না। শেরপুরে নকলার বরইতার গ্রামের রহুল আমিন বলছিলেন, ‘কৃষি কর্মকর্তার কথায় আমরা বাজার থাইক্কা কীটনাশক নিয়া ছিটাইতাছি, তা-ও কাম হইতাছে না। ঋণ নিয়া ধান করছি। ফলন না পাইলে ঋণ কিবা কইরা শোধ করমু।’

বিকল্পের সন্ধানে

ব্রি-২৮ জাতের বিকল্প হিসেবে ভাবা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু ধান ১০০ এবং ব্রি-৮৮। চলে এসেছে চীনা ধান হীরা। তবে এগুলোর কোনোটিই ১৪০ দিনের কম সময়ের ধান নয়। বঙ্গবন্ধু ধান ১০০-এর জীবনকাল কমপক্ষে ১৪৮ দিন। আর ব্রি-৮৮ জাতের ধানের জীবনকাল ১৪০-১৪৩ দিন। হীরা ধানের জীবনকাল ১৪৫ থেকে ১৫০ দিন। চীনা ধান হীরা এর মধ্যেই বাজারে হাত-পা মেলে ধরেছে। সুনামগঞ্জের হাওরে এ জাতের আবাদের ব্যাপক বিস্তৃতি চোখে পড়ার মতো।

খবর নিয়ে জানা গেল, বাংলাদেশে হীরা হাইব্রিড ধান চাষ শুরু হয় ১৯৯৬ সালে। প্রথম বছর মাত্র ১৫ টন ধান চাষ হয়েছিল। ২০১০ সালে ৮ হাজার টনে দাঁড়ায়। তারপর এ জাতের ধানের আবাদ বেড়েই চলেছে। তবে বাংলাদেশে শুধু হীরা ধান কত হেক্টর জমিতে চাষ হচ্ছে, সেটার সুনির্দিষ্ট হিসাব পাওয়া যায়নি। মোটা জাতের হীরা ধান কাটিং ও পলিশ করে আমাদের পাতে মিনিকেট নামে চলে আসে। বাজারে কোনো হীরা চাল নেই।

বাঁধভাঙা না ভাঙার উৎকণ্ঠায় থাকা হাওরবাসীর জন্য দরকার ১৪০ দিনের কম সময়ের ধান। আর ধারাবাহিক গবেষণার মাধ্যমে তার বালাই প্রতিরোধক্ষমতাকে হালনাগাদ করা।

সরকারের অবস্থান জরুরি

ব্রি-২৮ যে শুধু এবারই হাওরে কৃষকদের বিপদ ডেকে এনেছে, তা নয়। মেহেরপুর, সাতক্ষীরা, জামালপুরের বিলে-বাওরে বোরোচাষিদের এখন প্রধান আতঙ্ক ব্লাস্ট। জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার আদ্রা ইউনিয়নের বকচরি বিলের কৃষক রফিকুল ইসলাম তাঁর দুই বিঘা জমিতে ভালো ফলনের আশায় ব্রি-২৮ জাতের ধান লাগিয়েছিলেন। ভালো ধানও হয়েছিল। হঠাৎ প্রায় এক সপ্তাহ থেকে ধানের শিষ সাদা রঙের হয়ে যায়। দূর থেকে দেখে মনে হয়, ধান পেকে যাচ্ছে। কিন্তু ধানের গোড়ায় পচন ধরছে। তিনি পরে জানতে পারেন, খেতে ব্লাস্টের সংক্রমণ হয়েছে। এ রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। ওষুধ ছিটিয়ে বোরো ধানে ব্লাস্ট রোগ কিছুটা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে চলেছেন।

মেহেরপুরে বোরো ধানে ব্লাস্ট ও ব্যাকটেরিয়াল লিফ ব্লাইটের আসর পড়েছে। ধানের শিষ শুকিয়ে চিটা হয়ে যাচ্ছে। জমিতে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ ছিটিয়েও প্রতিকার পাচ্ছেন না কৃষক। সেখানকার কৃষি কর্মকর্তা বলছেন, আগামী মৌসুমে ব্রি-২৮ জাতের ধানের আবাদে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।

নিরুৎসাহিত করতে হলে আনুষ্ঠানিকভাবে কারণ জানিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেই সেটা করতে হবে। কানে কানে ফিস ফিস করে এটা করা উচিত নয়। তা ছাড়া বাজার থেকে এই জাতের বীজ সরিয়ে ফেলতে হবে। কৃষকের সর্বনাশ ঠেকাতে না পারলে দেশের সর্বনাশ ঠেকানো যাবে না।

লেখক গবেষক nayeem 5508 @gmail. com