অসহনীয় গরমে বাড়ছে মানুষের দৈনন্দিন ব্যয়

  • গরমের জন্য এখন জীবনযাপনের নানা উপকরণ থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য, শিক্ষার মতো ক্ষেত্রগুলোতে ব্যয় বাড়ছে।

  • নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।

ইনফোগ্রাফিকস: মাহাফুজার রহমান

আবহাওয়ার বৈরী আচরণে বর্ষাকালে স্বাভাবিকের তুলনায় কখনো বেশি বৃষ্টি, আবার কম। আবার স্বাভাবিকের তুলনায় গরমের তারতম্যও দেখা যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিকে জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম প্রভাব হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

জলবায়ু পরিবর্তনের এমন প্রভাব প্রাণ–প্রকৃতি থেকে শুরু করে এখন মানুষের দৈনন্দিন জীবনেও ছাপ ফেলছে। যেমন এ বছর গ্রীষ্ম মৌসুমে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেছে। এতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে। এ ব্যয় এখন জীবনযাপনের নানা উপকরণ থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ও পরিবহনের মতো ক্ষেত্রগুলোতে বাড়তে দেখা যাচ্ছে।

ঢাকা ও ঢাকার বাইরে প্রায় ৫০টি পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রচণ্ড গরমের কারণে বিদ্যুতের ব্যবহার বেড়েছে। ফ্যান ও এসি বেশি সময় ধরে চালানোর ফলে বিদ্যুৎ বিলও বেশি আসছে। আবার বিদ্যুৎ চলে গেলে জেনারেটর বা আইপিএস ব্যবহৃত হচ্ছে। এতে বাড়তি খরচ যোগ হচ্ছে। অনেকে সাধারণ গণপরিবহন এড়িয়ে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাস বা ট্রেনে যাতায়াত করছেন।

খাবার সংরক্ষণের জন্য রেফ্রিজারেটর কিংবা স্বস্তি পেতে ফ্যান বা এসি কেনার পেছনেও মোটা অঙ্কের টাকা ব্যয় হচ্ছে। আবার প্রচণ্ড গরমে শিশু ও বয়স্কদের মধ্যে বিভিন্ন রোগ বাড়ছে। বিশেষ করে ডেঙ্গুর প্রকোপ উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে চিকিৎসার ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব বাংলাদেশেও স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতে এই গরমের অস্বাভাবিকতা আরও বাড়বে, যা জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়িয়ে দেবে।

আরও পড়ুন
বাইরে বের হলে মনে হয় যেন চামড়া পুড়ে যাচ্ছে। এমনকি তীব্র রোদে চা পাতাও ঝলসে যেতে দেখা যাচ্ছে। এমন গরমে শ্রীমঙ্গলে পর্যটকও কম দেখা যাচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।

দিন দিন বাড়ছে গরম

বাংলাদেশে তুলনামূলক বেশি বৃষ্টিপাতের স্থান হিসেবে পরিচিত শ্রীমঙ্গল পরিচিত। কিন্তু এখন আর আগের মতো নেই। গত বছর এখানে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছিল। এ বছর জুন পর্যন্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, তাপমাত্রা ৩৭-৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠানামা করেছে। শ্রীমঙ্গলের বাসিন্দা ও পারিবারিকভাবে চায়ের ব্যবসা আছে কাজল হাজরার। গত জুন মাসে তাঁর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, ঢাকা আর শ্রীমঙ্গলে একই তাপমাত্রা। বাইরে বের হলে মনে হয় যেন চামড়া পুড়ে যাচ্ছে। এমনকি তীব্র রোদে চা পাতাও ঝলসে যেতে দেখা যাচ্ছে। এমন গরমে শ্রীমঙ্গলে পর্যটকও কম দেখা যাচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।

প্রচণ্ড গরমে বেড়েছে লোডশেডিং। ঘরে বিদ্যুৎ নেই। শিশুকে নিয়ে রাস্তায় বসে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছেন এই মা। মোহাম্মদপুর ক্যাম্পের বাজার এলাকায় সম্প্রতি তোলা
ছবি: প্রথম আলো

৭৬ বছরের তাপপ্রবাহের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এতে দেখা যায়, ২০২৩ সালে টানা ১৬ দিন তাপপ্রবাহ ছিল। আবার ২০১০ সালে রাজশাহীতে সর্বোচ্চ ২০ দিন তাপপ্রবাহ ছিল, তবে তা টানা ছিল না। কিন্তু ২০২৪ সালে পরিস্থিতি ভিন্ন দেখা যাচ্ছে। ওই বছর টানা ২৬ দিন ধরে তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে।

তাপপ্রবাহের এমন ধরন নিয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেছেন, ১৯৪৮ সাল থেকে উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গতবারের মতো টানা তাপপ্রবাহ আগে কখনোই হয়নি। এটি ৭৬ বছরের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে।

আবহাওয়াবিদ মো. উমর ফারুকের মতে, গত বছর দেশের ৭৫ ভাগ এলাকা দিয়ে টানা তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে, যা আগে কখনো দেখা যায়নি। ৪৩ বছরের মধ্যে যশোরে তাপপ্রবাহের দিন সবচেয়ে বেশি ছিল, এরপরই ঢাকা ও চুয়াডাঙ্গা।

আবহাওয়াবিদ ও বিশেষজ্ঞরা এমন তাপপ্রবাহের পেছনে চারটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। সেগুলো হলো—উপমহাদেশীয় উচ্চ তাপবলয়, শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত কমে যাওয়া, এল নিনোর সক্রিয়তা এবং বজ্রমেঘের কম সংখ্যা।

আরও পড়ুন
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে অধিক গরমের দিনের সংখ্যা বাড়ছে, যা শহরের নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য ও উৎপাদনশীলতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে বস্তি এলাকার মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, কারণ অধিক গরম ক্রমেই একটি সাধারণ ঘটনা হয়ে উঠছে। এই জনগোষ্ঠীর পর্যাপ্ত অর্থ, উপযুক্ত বাসস্থান এবং পানি ও বিদ্যুতের যথাযথ ব্যবস্থা না থাকায় গরম মোকাবিলা করা তাদের জন্য কঠিন। এখনই ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।
আইআইইডির প্রধান গবেষক আনা ওয়ালনিস্কি

ঢাকায় বাড়ছে প্রচণ্ড গরমের দিন

যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক পরিবেশ ও উন্নয়ন সংস্থা আইআইইডি বিশ্বের বড় শহরগুলোতে প্রচণ্ড গরমের মাত্রা বিশ্লেষণ করেছে। বিশ্লেষণটি গত বছর সংস্থাটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়। এতে ৩৫ বছরের ঢাকার গরমের চিত্র বিশ্লেষণ করে আইআইইডি জানিয়েছে, বিশ্বের যে কটি শহরের তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে, ঢাকা তার মধ্যে অন্যতম।

বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি তাপমাত্রা ‘অধিক গরম’ হিসেবে বিবেচিত। গত ৩০ বছরে ঢাকায় এমন গরমের দিন ছিল মোট ১ হাজার ২৪২ দিন।

দশকওয়ারি ভিত্তিতেও গরমের মাত্রা বিশ্লেষণ করেছে আইআইইডি। এতে দেখা যায়, এমন গরমের দিনের সংখ্যা ক্রমাগতভাবে বেড়েছে। যেমন: ১৯৯৪-২০০৩ সাল পর্যন্ত ২৮৩ দিন, ২০০৪-২০১৩ সাল পর্যন্ত ৪৪২ দিন এবং ২০১৪-২০২৩ পর্যন্ত ৫১৭ দিন ৩৫ ডিগ্রি বা তার বেশি তাপমাত্রা ছিল।

আইআইইডির হিসাব অনুযায়ী, গত ৩০ বছরে ঢাকায় অধিক গরমের (৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও তার বেশি) দিনের সংখ্যা ৯৭% বৃদ্ধি পেয়েছে।

ই–মেইলে যোগাযোগ করলে আইআইইডির প্রধান গবেষক আনা ওয়ালনিস্কি প্রথম আলোকে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে অধিক গরমের দিনের সংখ্যা বাড়ছে, যা শহরের নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য ও উৎপাদনশীলতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে বস্তি এলাকার মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, কারণ অধিক গরম ক্রমেই একটি সাধারণ ঘটনা হয়ে উঠছে। এই জনগোষ্ঠীর পর্যাপ্ত অর্থ, উপযুক্ত বাসস্থান এবং পানি ও বিদ্যুতের যথাযথ ব্যবস্থা না থাকায় গরম মোকাবিলা করা তাদের জন্য কঠিন। এখনই ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।’

তাপপ্রবাহ শুরুর পর রোগী বেড়েছে। কারণ, শিশুরা গরমে বেশি ঘামে এবং তাদের পানিশূন্যতা দ্রুত বেড়ে যায়।
হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক শায়লা আফরোজ

চিকিৎসা খরচ মেটাতে নাভিশ্বাস

প্রচণ্ড গরমের সময় হাসপাতালে রোগীর চাপ বাড়তে দেখা যায়। বিশেষ করে শিশুদের জ্বর, সর্দি, কাশি এবং পানিশূন্যতাজনিত ডায়রিয়ার রোগীর সংখ্যা বাড়ে। এ বছর গ্রীষ্মে শুধু রাজধানী নয়, দেশের প্রায় ১০টি জেলায় একই রকম পরিস্থিতি দেখা গেছে।

বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ১ থেকে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত বহির্বিভাগে ২১ হাজার ৭০৯ জন রোগী সেবা নিয়েছেন। আর গড়ে প্রতিদিন ১৩০টি শিশু নতুন করে ভর্তি হয়েছে। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক শায়লা আফরোজ বলেন, ‘তাপপ্রবাহ শুরুর পর রোগী বেড়েছে। কারণ, শিশুরা গরমে বেশি ঘামে এবং তাদের পানিশূন্যতা দ্রুত বেড়ে যায়।’

প্রচণ্ড গরমে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকিও থাকে। অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, এই গরমে হিটস্ট্রোক হতে পারে, যা শরীরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক বৃদ্ধির ফলে ঘটে। মানবদেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৯৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট হলেও এটি ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি হলেই হিটস্ট্রোক হতে পারে। তাৎক্ষণিক চিকিৎসা না পেলে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। হিটস্ট্রোকের প্রধান কারণ পানিশূন্যতা এবং এর চিকিৎসাও বেশ ব্যয়বহুল।

কয়েক বছর ধরে গরমের সময়ে ডেঙ্গুর প্রকোপও বেড়েছে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তৌহিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, এবার থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে এবং ভ্যাপসা গরম বিরাজ করছে, যা ডেঙ্গুর এডিস মশা বৃদ্ধির জন্য আদর্শ পরিবেশ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই মাসের প্রথম ১২ দিনে ডেঙ্গুতে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। ১ জানুয়ারি থেকে ১২ জুলাই পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে ৫৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে শুধু গত জুনে মারা গেছেন ১৯ জন।

গরমে হাঁপিয়ে উঠেছে স্কুলের শিশুরাও। শ্যামলী পার্কের পাশে জামিলুতুন আইনুন আনন্দ স্কুলের সামনে মাঠা পান করছে একটি শিশু। পথচারীদের অনেকে এ মাঠা পান করছেন
ছবি: প্রথম আলো

বিভাগওয়ারি তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ঢাকা বিভাগে, ৩০ জন। এরপর সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন বরিশাল বিভাগে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের এই বিভাগে ১৪ জন মারা গেছেন।

মৃত্যুর পাশাপাশি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। সর্বশেষ ৪২০ জনসহ এ বছর এ পর্যন্ত ১৪ হাজার ৮৮০ রোগী ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে জুলাই মাসের ১২ দিনে ভর্তি হয়েছেন ৪ হাজার ৫৮৪ জন। রোগতত্ত্ববিদেরা বলছেন, জুলাইয়ের বাকি দিনগুলোতে ও আগস্ট মাসে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি আছে।

মগবাজারের বাসিন্দা আয়নাল মিয়া জানান, গত বছর তাঁর মেয়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১১ দিন হাসপাতালে ভর্তি ছিল। এতে তাঁর প্রায় দেড় লাখ টাকা খরচ হয়, যা ধারদেনা করে মেটাতে হয়েছিল।

ডেঙ্গু নিয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) ২০১৯ সালের একটি গবেষণা অনুযায়ী, একজন ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় গড় ব্যয় ছিল ৩৩ হাজার ৮১৭ টাকা। সরকারি হাসপাতালে এই ব্যয় ছিল ২২,৩৭৯ টাকা এবং বেসরকারি হাসপাতালে ৪৭,২৩০ টাকা, যা বর্তমানে আরও বেড়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

বিআইডিএসের গবেষক আবদুর রাজ্জাক সরকার এক সেমিনারে বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আফগানিস্তানের পর বাংলাদেশের মানুষের চিকিৎসা ব্যয় সবচেয়ে বেশি। ১৯৯৭ সালে যা মোট ব্যয়ের ৫৫.৯ শতাংশ ছিল, ২০২১ সালে তা বেড়ে ৭৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

বাড়ছে বিদ্যুৎ ও পরিবহনের বিল

প্রচণ্ড গরমে ফ্যান, এসির মতো ইলেকট্রনিক পণ্যের ব্যবহার বেড়েছে। ফলে বিদ্যুৎ বিলও বাড়ছে। মোহাম্মদপুরের মাজেদুল হকের বিদ্যুৎ বিল জানুয়ারিতে ছিল ১ হাজার ৫০০ টাকা। কিন্তু মে মাসে প্রচণ্ড গরমে এসি ব্যবহার বেড়ে যায়। এতে তাঁর বিদ্যুৎ বিলও বাড়ে। তিনি জানান, এসি ছাড়া এখন থাকা অসম্ভব।

রামপুরার অনামিকা হক জানান, গত বছর গরমের সময় বিদ্যুৎ যাওয়া শুরু হলে তাঁদের বাড়ির মালিক জেনারেটর ব্যবহারের জন্য অতিরিক্ত ৫ হাজার টাকা দাবি করেন। কারণ হিসেবে তেলের মূল্য বৃদ্ধি দেখানো হয়। যদিও এই বাড়তি খরচ তাঁদের মাসিক ব্যয়ে যুক্ত হয়েছে, কিন্তু বিদ্যুৎ গেলে জেনারেটর নিয়মিত চালানো হয় না।

রংপুরের আতিক রহমান বিদ্যুৎ–বিভ্রাট থেকে বাঁচতে ৩০ হাজার টাকা দিয়ে আইপিএস কিনেছেন। এর জন্য মাসে অতিরিক্ত ২-৩ হাজার টাকা বিল দিতে হচ্ছে, যা নিয়মিত বিদ্যুৎ বিলের বাইরে।

পরিবহন ব্যয়ও বেড়েছে। আজিমপুরের শরিফুল ইসলাম জানান, আগে তিনি ঢাকা থেকে রাজশাহী নন-এসি ট্রেনে ৩০০ টাকায় যেতেন। এখন বাচ্চাদের নিয়ে এসি বাস বা ট্রেনের এসি বগিতে যাচ্ছেন, যেখানে প্রতি টিকিটে ৪০০-৫০০ টাকা বাড়তি লাগছে। তাঁর পরিবারে এখন এই খরচ ৪ থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে, যার ফলে তাঁর বাড়ি যাওয়া কমে গেছে।

গরম এত বেশি যে ফল আনতে আনতেই গলে যায়। অনেক ফল ফেলে দিতে হয়। যে পাঠায় সে তো টাকা আগেই পায়, লোকসান হয় আমাদের। লোকসান ঠেকাতে বেশি দামে ফল বিক্রির চেষ্টা করি, কিন্তু সব সময় তো সম্ভব হয় না।
কারওয়ান বাজারের পাইকারি আম বিক্রেতা রমজান মিয়া

বাড়ছে খাবারের খরচ, সঙ্গে স্কুলে বাড়তি ব্যয়

গরমের কারণে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যায়। এতে অনেক সময় লোডশেডিং হয়। রংপুরের কৃষক আবদুস সালাম জানান, এক বিঘা জমিতে আগে সেচ খরচ ছিল দেড় হাজার টাকা। কিন্তু বিদ্যুৎ না থাকলে জেনারেটরের মাধ্যমে সেচ দিতে হয়। এতে খরচ বেড়ে ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে।

দেখা যায়, কৃষকের বাড়তি খরচের প্রভাব চালের বাজারেও পড়ে। এ ছাড়া গরমে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে থেকে আসা ফলমূল-সবজি অনেক সময় নষ্ট হয়। কারওয়ান বাজারের পাইকারি আম বিক্রেতা রমজান মিয়া বলেন, ‘গরম এত বেশি যে ফল আনতে আনতেই গলে যায়। অনেক ফল ফেলে দিতে হয়। যে পাঠায় সে তো টাকা আগেই পায়, লোকসান হয় আমাদের। লোকসান ঠেকাতে বেশি দামে ফল বিক্রির চেষ্টা করি, কিন্তু সব সময় তো সম্ভব হয় না।’

গরমে চাহিদা বেড়েছে হাতে বহনযোগ্য ছোট ছোট চার্জার ফ্যানের। অনেকে চলতে–ফিরতে এই ফ্যান ব্যবহার করছেন। রাজধানীর কারওয়ানবাজার এলাকা থেকে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

মিরপুরের বাসিন্দা মিজানুর রহমান বলেন, পরিবার নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে খেতে গেলে এসি রেস্টুরেন্ট ছাড়া উপায় নেই, যেখানে খাবারের খরচও বেশি।

স্কুলেও বাড়তি খরচ দেখা যাচ্ছে। মোহাম্মদপুর থেকে ধানমন্ডির একটি বেসরকারি স্কুলে যাওয়া শিশুর বাবা জানান, গরমের কারণে মাইক্রোবাসের ভাড়া ৩ হাজার টাকা বাড়ানো হয়েছে, কারণ হিসেবে অতিরিক্ত এসি ব্যবহার ও যানজটের কথা বলা হয়েছে। আরেক অভিভাবক জানান, তাঁদের সন্তানের স্কুলের জন্য বিশুদ্ধ ঠান্ডা পানি ও সার্বক্ষণিক এসির জন্য ৫ হাজার টাকা অতিরিক্ত নেওয়া হচ্ছে।

আরেকজন অভিভাবক বলেন, ‘এই গরমে আমাদের খরচ অনেক বেড়ে গেছে। স্কুলের সামনে বাচ্চাদের ডাব কিনে দিতে আগে ৫০-৬০ টাকায় হয়ে যেত। কিন্তু এখন লাগে ১৬০-২০০ টাকা। প্রচণ্ড গরমে বাচ্চারা আইসক্রিম খেতে চায়, না করতে পারি না।’

ইলেকট্রনিক পণ্য ও রেফ্রিজারেটরের চাহিদা

আদাবরের ট্রান্সকম ইলেকট্রনিকসের একজন বিক্রয় কর্মকর্তা জানান, গত বছর প্রচণ্ড গরমে এসি বিক্রি বেড়েছিল।

গ্রিন রোডের বাসিন্দা আবদুল্লাহ ইমরান বলেন, আগে ফ্যান দিয়ে থাকা গেলেও এখন এসি ছাড়া চলা কঠিন। এসি লাগানোর ফলে এগুলো কিনতে ও সার্ভিসিং করতে বড় অঙ্কের টাকা ব্যয় হচ্ছে।

প্রচণ্ড গরমে পথের পাশে ফুটপাতে তৈরি শরবত পান করছেন এক রিকশাচালক। রাজধানীর আগারগাঁও এলাকা থেকে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

প্রচণ্ড গরমে গৃহিণীরা গ্যাসের চুলা এড়িয়ে ইলেকট্রিক কুকার ব্যবহার করছেন। দিলু রোডের বাসিন্দা আফরোজা বেগম বলেন, গ্যাসের চাপ কম থাকায় এবং গরম থেকে বাঁচতে তিনি ইনডাকশন কুকার কিনেছেন, যদিও এর দাম বেশি।

মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত—সবার কাছে ফ্রিজের চাহিদা বেড়েছে। অতিরিক্ত গরমে খাবার নষ্ট হওয়ায় এবং রান্না করা খাবার সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা বেড়ে যাওয়ায় রেফ্রিজারেটর কেনা বাড়ছে। মোহাম্মদপুরের জহুরি মহল্লার বাসিন্দা মিজান মিয়া জানান, গরমের কারণে খাবার নষ্ট হওয়ায় তিনি ধারদেনা করে কিস্তিতে ৩০ হাজার টাকায় ফ্রিজ কিনেছেন, যা তাঁর জন্য একটি বড় খরচ।

পর্যটন খাতেও গরমের প্রভাব

প্রচণ্ড গরম মানুষের ভ্রমণে বাধা না দিলেও কেউ কেউ এখন এসি রুম বা সুইমিংপুলসহ হোটেল-রিসোর্ট বেছে নিচ্ছেন। এমনকি ভ্রমণে সময় বাঁচাতে আকাশপথ ব্যবহার বাড়ছে। গুলশানের বাসিন্দা মনোয়ার হোসেন জানান, আগে তিনি শ্রীমঙ্গলে নন-এসি রুমে থাকতেন, কিন্তু গত বছর প্রচণ্ড গরমে বাধ্য হয়ে এসি রুম ভাড়া নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এখন এসি রুম নিতে বাধ্য হচ্ছি। ভ্রমণের ব্যয় বাড়ছে বলে ভ্রমণও কমিয়ে দিয়েছি।’

হাতিরপুলের আইনজীবী আরাফাত হোসেন জানান, তিনি এখন ঢাকা থেকে রংপুরে যেতে এসি বাসের পরিবর্তে আকাশপথ বেছে নিচ্ছেন; কারণ, এতে সময় কম লাগে এবং গরমে ক্লান্তিও আসে না।

কক্সবাজারের হোটেলের মালিকেরা জানান, গরমের সময় পর্যটকেরা নন-এসি রুমে থাকতে আগ্রহী নন। প্রথমে এসি রুমের বুকিং শেষ হয়, এরপরই নন-এসি রুমের চাহিদা কমে যায়। ফলে নতুন কটেজ বা রিসোর্টগুলোতে নন-এসি রুম কম রাখা হচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনে গরম বেড়ে মানুষের খরচ বেড়েছে, তা এককভাবে বলা যাবে না। মানুষের অভ্যাসও এই খরচ বৃদ্ধির জন্য দায়ী। সেটিও আমাদের সামনে আনা প্রয়োজন।
জলবায়ু পরিবর্তনবিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত

কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা

জলবায়ু পরিবর্তনবিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই তাপ সারা পৃথিবীতেই বাড়ছে। বাংলাদেশেও সেটি অব্যাহত আছে। গরমের কারণে জীবনযাত্রার খরচ বেড়েছে এটা যেমন সত্য, তেমনি আমাদের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে, শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের সহজলভ্যতা বেড়েছে। সর্বোপরি আমাদের অনেকেই এখন আরাম–আয়েশ চান এবং কষ্ট করতে চান না। আর সেটি করতে গেলে খরচ বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক। তবে জলবায়ু পরিবর্তনে গরম বেড়ে মানুষের খরচ বেড়েছে, তা এককভাবে বলা যাবে না। মানুষের অভ্যাসও এই খরচ বৃদ্ধির জন্য দায়ী। সেটিও আমাদের সামনে আনা প্রয়োজন।’

যুক্তরাষ্ট্রের সিরাকিউজ ইউনিভার্সিটির ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ফারহানা সুলতানা বাংলাদেশের পরিবেশ ও জলবায়ু নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন। তিনি বলেন, শহুরে মধ্যবিত্ত এবং বিশেষ করে যাঁরা প্রায়ই স্বল্প মজুরি ও অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন, তাঁরা ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা ও তাপজনিত মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। গরমে কিছুটা ভালো থাকার জন্য তাঁদের খরচ বেড়ে যায় এবং চিকিৎসার পেছনেও অনেক ব্যয় হয়।

ফারহানা সুলতানা আরও বলেন, প্রচণ্ড গরমে এই মানুষগুলোর জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। সবুজ খেলার মাঠ বা খোলা জায়গার অভাব এবং সহজলভ্য ও বিশুদ্ধ পানির অপ্রতুলতাও তাঁদের তাপজনিত সমস্যা আরও বাড়িয়ে তোলে। কারণ, তাঁরা না পারেন বসতবাড়ি ঠান্ডা রাখতে, না পারেন যথাযথভাবে পানি পান করে নিজেকে সতেজ রাখতে। তাঁদের জন্য সবচেয়ে কার্যকর সহায়তা হতে পারে ভালো মানের বাসস্থান ও উন্নত কর্মপরিবেশ, যাতে তাপের প্রভাব কিছুটা হলেও কমে। এসব স্থানে পরিষ্কার পানি ও স্যানিটেশন সুবিধাও উন্নত করা দরকার।

বাংলাদেশের মতো জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের জন্য আলাদা তহবিল তৈরি করার কাজে উন্নত দেশগুলোকে এগিয়ে আসার ওপর জোর দেন ফারহানা সুলতানা।