নদী–গবেষক শ্যামল কর্মকার

পোড়া চিনির বর্জ্যে কর্ণফুলীর দূষণের প্রভাব এক মাসে শেষ হবে না

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানার ইছানগরে ৪ মার্চ এস আলম রিফাইন্ড সুগার মিলের গুদামে আগুন লাগে। একটি গুদামের ৬০ টনের বেশি অপরিশোধিত চিনি পুড়ে বর্জ্য গিয়ে পড়ে কর্ণফুলী নদীতে। আগুন পুরোপুরি নেভাতে সময় লেগেছে প্রায় চার দিন। চিনির তরল বর্জ্যে নদীর জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এ নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন কর্ণফুলী দূষণ নিয়ে গবেষণারত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শ্যামল কর্মকার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রণব বল

প্রথম আলো:

অপরিশোধিত চিনি পুড়ে তরল বর্জ্য গিয়ে মিশেছে কর্ণফুলী নদীতে। পোড়া চিনির বর্জ্যে কী কী ক্ষতিকর উপাদান থাকে, যা নদীর পানির বিভিন্ন মানমাত্রায় প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করেন?

শ্যামল কর্মকার: চিনির রাসায়নিক উপাদান মূলত সুক্রোজ। পরিশোধিত বা অপরিশোধিত দুটি অবস্থাতেই চিনির সঙ্গে আরও কিছু উপাদান ও রাসায়নিক মিশ্রিত থাকে। এ কারণে যখন চিনি বর্জ্য বা চিনিমিশ্রিত পানি নদী বা জলাশয়ে মেশে তখন পানির ভৌত, জৈব ও অজৈব গুণাগুণ পরিবর্তন হয়। অর্থাৎ চিনি পানির ভৌত অবস্থার পরিবর্তন ঘটায়। অজৈব উপাদানসমূহের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করে জীব ও অণুজীবসমূহের সমন্বয়ে যে বাস্তুসংস্থান, তার ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এ কারণে পোড়া চিনি ও গলিত চিনির বর্জ্য নদীর ওপর মারাত্মক রকম প্রভাব সৃষ্টি করে। যদিও এ ধরনের দূষণের মাত্রা এবং প্রতিবেশগত ক্ষতি নদীর পানির গুণাগুণ, জোয়ার ভাটার সময় ও প্রবাহ এবং বর্জ্যের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে।

কারখানা থেকে অপরিশোধিত চিনি ও রাসায়নিক গলে নালা দিয়ে সরাসরি পড়ছে কর্ণফুলী নদীতে। ৬ মার্চ কর্ণফুলী থানার বাংলাবাজার ঘাট এলাকায়
ফাইল ছবি: প্রথম আলো
প্রথম আলো:

বলা হচ্ছে, ৬০ হাজার টন বা তারও বেশি চিনি পুড়ে নদীতে গিয়ে মিশেছে চার দিন ধরে। প্রাথমিকভাবে আমরা মাছ মরে ভেসে ওঠার চিত্র দেখেছি। পানির রং পরিবর্তন হয়েছে। দূষণের মাত্রাটা কোন পর্যায়ের মনে হয় আপনার?

শ্যামল কর্মকার: পানিতে দ্রবীভূত জৈব রাসায়নিক পদার্থ এবং অধিক পরিমাণে পলিমাটির উপস্থিতির কারণে কর্ণফুলী নদীর পানির রং পরিবর্তন হয়েছে। এ ছাড়া মাছের মৃত্যুর সঙ্গে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন পরিমাণের সম্পর্ক রয়েছে বলে আমার ধারণা।

সচরাচর পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের (ডিও) মাত্রা আমাদের দেশের তাপমাত্রায় প্রতি লিটারে ৫-৮ মিলিগ্রামের মধ্যে থাকে (তবে এই  নদীর উজানে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ ৮০-১২০ শতাংশ সম্পৃক্ত মাত্রায় পাওয়া গেছে, যা নদীর ভালো জৈবিক পরিবেশ নির্দেশ করে)। তবে চিনি বা অন্যান্য জৈব রাসায়নিকের কারণে এই দ্রবীভূত অক্সিজেন ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাকসহ অন্যান্য অণুজীব দ্বারা অজৈব রাসায়নিকে পরিণত করতে ব্যবহৃত হয়। উল্লেখযোগ্য পরিমাণ চিনি এবং অণুজীবের উপস্থিতির কারণে দ্রবীভূত অক্সিজেন দ্রুত হ্রাস পেতে পারে। ফলে অক্সিজেন প্রতি লিটারে ০.৫ থেকে ১.৫ মিলিগ্রামের মধ্যে বা এর চেয়ে কমে গেলে অধিকাংশ মাছ এক ঘণ্টা বা তারও কম সময়ে মারা যায়। এ ক্ষেত্রে বিবেচ্য হলো চিনি বা দূষণের পরিমাণ কত, দূষণের ব্যাপ্তিকাল কতক্ষণ, জোয়ার-ভাটার সময় পানির চাপ, যা মূলত পানির মিশ্রণের পরিমাণ। যদি আমরা ৬০ হাজার টন চিনি বা বিশুদ্ধ সুক্রোজ হিসেবেও ধরে নিই, তবে এই পরিমাণ চিনির জন্য অক্সিজেন প্রয়োজন হবে ৩৩ হাজার ৬৫৫ টন। এত পরিমাণ দ্রবীভূত অক্সিজেন কর্ণফুলী নদীর ভাটির মতো বাস্তুসংস্থান এই দূষণ অংশে সরবরাহ করতে পারবে না। মূলত কোনো বাস্তুসংস্থান এই পরিমাণ দূষণকে জারিত করতে স্বল্প সময়ে পারে না। তাই দ্রবীভূত অক্সিজেনের সংকট হয়। ফলে এই অংশে সব জীব অল্প সময়ে মারা যায়, এই দূষণ অঞ্চল স্থানিক মৃত অঞ্চলে পরিণত হয়।

কর্ণফুলী নদীতে চিনির গলিত পানি মিশে কালচে বর্ণ ধারন করেছে। বিপুলসংখ্যক মৃত মাছ ভাসতে দেখা যাচ্ছে। ৬ মার্চ বেলা ১টায় কর্ণফুলী নদীর চট্টগ্রাম বন্দরের এলাকায়
ছবি: সৌরভ দাশ
প্রথম আলো:

গুলসা, চিংড়ি, কাচকি, কাঁকড়াসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী মারা গেছে। এসব প্রাণীর মধ্যে দূষণের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে টিকে থাকা কোনো প্রজাতি কি আছে? মাছ ছাড়া অন্য কোনো উদ্ভিদ প্রজাতিতে এই বর্জ্য বা গরম পানি প্রভাব ফেলেছে কি না?

শ্যামল কর্মকার:  প্রাণিজগতে একেকটি জলজ প্রাণীর অক্সিজেনের প্রয়োজন একেক রকম। অ্যামোনিয়াসহ অন্যান্য দূষণ সহ্যক্ষমতাও ভিন্ন ভিন্ন। এই জীবসমূহের জীবনকালের সময়, পরিবেশ ও প্রতিবেশ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যেমন রুইজাতীয় মাছের পোনার জন্য অক্সিজেন ৪.৮৮ হলেও মৃগেলের জন্য তা ৪.৫৫ মিলিগ্রাম প্রতি লিটার। অপর দিকে অক্সিজেন প্রতি লিটারে ১.৬৮ এবং ১.৭৫ মিলিগ্রামের নিচে থাকলে এই মাছগুলোর পোনা বেঁচে থাকতে পারে না। এ ছাড়াও ধাতব পদার্থের উপস্থিতি, অনেক বেশি জৈব উপাদান, অ্যামোনিয়া, ক্ষতিকারক শৈবাল ও ছত্রাকের বৃদ্ধি পানির জীবন ধারণের পরিবেশের পরিবর্তন ঘটায়। পানির তাপমাত্রা, দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ, উদ্ভিদ কণা ও প্রাণিজ কণা বৃদ্ধি বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। তাই গরম বর্জ্য বা পানি যতটা তাপীয় শক তৈরি করে, তার চেয়ে বেশি দ্রবীভূত অক্সিজেন শূন্যতাজনিত মৃত অঞ্চল তৈরিতে ভূমিকা রাখে বলে মনে করা হয়। এ ছাড়া দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ নদী বা জলাশয়ে সমানভাবে থাকে না। সচরাচর জলাশয়ের উপরিভাগে ১.৫ মিটারের বেশি থাকে। গভীরে এর পরিমাণ ১.৫ মিলিগ্রামের কম থাকে।

প্রথম আলো:

সার্বিকভাবে কর্ণফুলী নদীর দূষণ কেমন? এ ঘটনা দূষণের মাত্রাকে কতটা প্রভাবিত করে?

শ্যামল কর্মকার: কর্ণফুলী নদীর দূষণের পরিমাণ ও প্রকার নিয়ে ভিন্নমত থাকলেও সার্বিকভাবে এই নদী যে ভালো নেই, তা অনেকগুলো গবেষণা থেকে জানা যায়। আমি কর্ণফুলী নদীর উজানে গবেষণায় দেখেছি যে দ্রবীভূত অক্সিজেন, পিএইচসহ অধিকাংশ প্যারামিটার নদী বা পুকুরের জন্য প্রযোজ্য আদর্শসীমার মধ্যে থাকলেও পলি, কিছু ভারী ধাতু এবং সালফেট মাত্রা বেশি, যা ভূমি ব্যবহারজনিত দূষণ নির্দেশ করে। তবে এই নদীর ভাটির অবস্থা খুবই খারাপ। এর অন্যতম কারণ হলো শুষ্ক মৌসুমে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, চট্টগ্রাম নগরের জলীয় ও কঠিন বর্জ্য নিঃসরণজনিত দূষণ এবং সর্বোপরি কলকারখানার দূষণ রয়েছে এই নদীতে। দেশে পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষায় একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিবেশ অধিদপ্তর; কলকারখানার দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) স্থাপনে জোরালো ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু এই শোধনাগারগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের নির্লিপ্ততা পীড়াদায়ক এবং তা এই অধিদপ্তরের সার্বিক ব্যর্থতাও বটে।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

দূষণ এড়াতে আগাম কী ব্যবস্থা নেওয়া যেত? কারখানা কর্তৃপক্ষ কি আগাম ব্যবস্থা নিতে পারত? আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিসই–বা এই দূষণ এড়াতে পারত কি না?

শ্যামল কর্মকার: আমরা সুগার মিলসহ কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ অঞ্চলে ২০১৮ সালে একটি পরিবেশগত সমীক্ষা এবং গবেষণা পরিচালনা করি। এই গবেষণায় আমরা দেখছি যে কারখানাগুলোর কাছাকাছি এলাকাগুলোতে পানির কেমিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড (সিওডি), বায়োলজিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড (বিওডি)–সহ অন্যান্য পানিদূষণ নির্দেশক প্যারামিটারের মাত্রা বেশি এবং লবণাক্ততা বেশি। এই ফলাফলের দুটি দিক হলো কারখানাগুলো দূষণরোধে যে পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা পর্যাপ্ত নয় বা নিচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, অত্যধিক ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে লবণাক্ত পানি স্বাদু পানির স্তরে অনুপ্রবেশ করছে। সুতরাং আগাম ব্যবস্থা নেওয়ার অনেক কিছু রয়ে গেছে। গুরুত্বপূর্ণ হলো জলীয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চালু রাখা। চিনি এবং এর পরিশোধনে ব্যবহৃত অন্যান্য রাসায়নিকের জন্য আলাদা এবং কার্যকর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা এবং আগুন বা দুর্যোগ পরিস্থিতি ব্যবস্থাপনা–সম্পর্কিত পরিকল্পনা পরিবেশ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত রাখা। ফায়ার সার্ভিসসহ অন্য সংস্থাসমূহকে তা অবহিত করা বা অবহিত করার ব্যবস্থা রাখা।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

কর্ণফুলীতে মাছের প্রজাতি দিন দিন কমছে বলে আগের কয়েকটি গবেষণায় উঠে এসেছে। এ ঘটনা সেটাকে কি আরও বেগবান করল? মারা যাওয়া মাছের বাইরে অন্যান্য প্রজাতির মাছের মধ্যে কী প্রভাব পড়তে পারে? দীর্ঘ মেয়াদে এই দূষণের ফল কেমন?

শ্যামল কর্মকার: মূলত এ দূষণের প্রভাব এক সপ্তাহ বা এক মাসের মধ্যে শেষ হবে না। কারণ, উচ্চ ঘনমাত্রার চিনিযুক্ত দ্রবণ, সাধারণ পানির নিচের স্তরে অবস্থান করবে এবং ধীরে ধীরে মিশ্রিত হবে। তাই এর ভাটিতে এবং জোয়ারের সময় উজানে যে অংশ পর্যন্ত এই দূষণ অঞ্চল পৌঁছাবে, সেখানে সব মাছ বা প্রাণিকুল হয় মারা যাবে অথবা অবস্থান বদল করবে। এ ছাড়া সব ধরনের প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম জলাভূমি সংরক্ষণ করতে হবে। কারণ, জলাভূমি শুধু পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করে তা–ই নয়, দূষণ প্রশমিত করে প্রাকৃতিক জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়া বজায় রাখে, যা টেকসই জীবনব্যবস্থার জন্য অত্যাবশ্যক।

প্রথম আলো:

সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

শ্যামল কর্মকার: প্রথম আলোকেও ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।