‘ভূমিকম্প সচেতনতা দিবস’ উপলক্ষে বিশেষ আলোচনা
ভালো বাড়ি নির্মাণে দরকার সঠিক নকশা, অবকাঠামো ও রক্ষণাবেক্ষণ
বাংলাদেশ এখন ভূমিকম্পের বড় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বিশেষ করে গত কয়েক বছরে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা শহরে বেশ কিছু ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে। অনেকেরই জানা আছে, ভূমিকম্প হলে কী করতে হবে, কীভাবে এগিয়ে যেতে হবে এবং কীভাবে ভালো বাড়ি নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দরকার সচেতনতা।
১২ জুন ‘ভূমিকম্প সচেতনতা দিবস’ উপলক্ষে বিএসআরএমের উদ্যোগে প্রথম আলো ডটকম আয়োজন করে ‘ভূমিকম্প: সচেতনতা ও করণীয়’ শীর্ষক তিন পর্বের বিশেষ টক শো। প্রথম আলোর ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন ও যুব কার্যক্রমের প্রধান সমন্বয়ক মুনির হাসানের সঞ্চালনায় দ্বিতীয় পর্বে আলোচক হিসেবে ছিলেন পিডব্লিউডির সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আবদুল মালেক সিকদার, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. সৈয়দ ফখরুল আমীন এবং এসবি কনসালট্যান্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম সাইফুল বারী, পিইঞ্জ।
ভূমিকম্প বিষয়ে আমরা কীভাবে সচেতন হব? মুনির হাসানের এমন প্রশ্নের উত্তরে মো. আবদুল মালেক সিকদার জানান, ‘সবচেয়ে বড় কথা হলো সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। বিদ্যমান ভবনের যে দুর্বলতার কথা আমরা দুটি বড় গবেষণা থেকে জানতে পেরেছি, সেগুলো থেকে বোঝা যায়, ঢাকা শহরে যে ভবনগুলো আছে, সেগুলো বড় কোনো ভূমিকম্প হলে বিশাল ক্ষয়ক্ষতি হবে। অনেক লোক মারা যাবে এবং সম্পদের ক্ষতি হবে। ঢাকা শহরে থাকা ভবনগুলোর মধ্যে অনেক সরকারি ভবন আছে। তবে বেশির ভাগই ব্যক্তিগত ভবন, যেগুলোর অধিকাংশই তৈরি করা হয়েছে নিজের ইচ্ছেমতো। ভবনগুলো তৈরির সঙ্গে কোনো দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার যুক্ত থাকেন না। ভবন নির্মাণে অভিজ্ঞ কোনো লোক নেওয়া হয় না। এ রকম পরিস্থিতিতেই তৈরি করা হচ্ছে বসবাসের জন্য ভবন।’
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ড. সৈয়দ ফখরুল আমীন বলেন, ‘ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির অনেক বড় ঝুঁকির মধ্যে আছে বাংলাদেশ। তাই সবার আগে ক্ষতি কমিয়ে আনার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ভবনের নকশা করতে হবে ভূমিকম্প সহনশীল করে। এটি করার জন্য দরকার দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার। এবং সে নকশা অনুযায়ী নির্মাণ করতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় নকশা ঠিকমতো হয়েছে, কিন্তু নির্মাণটা ঠিকমতো হয়নি; তাহলে কিন্তু হবে না। নকশার সঙ্গে নির্মাণের দিকেও আমাদের নজর দিতে হবে। শুধু রাজমিস্ত্রির ওপর ছেড়ে দিলে হবে না। তাহলে বিল্ডিংয়ের ভেঙে পড়ার ঝুঁকি থেকেই যাবে। ভালোভাবে নকশা ও নির্মাণ করলে একটা বিল্ডিং কম হলেও ৫০ বছরের বেশি ভালো থাকবে। আর যদি সেটা না করা হয়, তাহলে ২৫ বছরের বেশি টিকবে না।’
দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে ডিজাইন করার পর অনেক সময় নির্মাণের জন্য আমরা একজন অদক্ষ রাজমিস্ত্রির ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দিচ্ছি। নির্মাণ-উপকরণ ও সামগ্রী বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা কতটুকু দক্ষতার পরিচয় দেন? সঞ্চালকের এ প্রশ্নের জবাবে ড. সৈয়দ ফখরুল আমীন বলেন, ‘এত দিন আমাদের কনস্ট্রাকশন ম্যানেজমেন্ট বলতে কিছু ছিল না। তবে বর্তমানে এ বিষয়টি বেশ গুরুত্বসহকারে দেখা হচ্ছে। আমাদের মধ্যে একটা ভুল ধারণা আছে, কনস্ট্রাকশন ম্যানেজমেন্ট টিম থাকলে খরচ বাড়ে। বিষয়টি ঠিক নয়, এই টিমটা থাকলে খরচ কমে। যেমন সিমেন্ট, বালি সব ঠিকমতোই দিলাম। কিন্তু পানি বেশি দিলে সব নষ্ট হয়ে যাবে। পানির পরিমাণ যদি কম দিয়ে করতে পারি, তাহলে সিমেন্টটাও কম লাগবে। সিমেন্ট বেশি দিলে বিল্ডিংয়ের অনেক সময় সমস্যা দেখা দেয়। তাই অভিজ্ঞ লোক দিলে বিল্ডিং বানানো উচিত। নতুন নতুন টেকনোলজি এসেছে আমাদের। এ প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করার জন্য দক্ষ মানুষও দরকার। এ জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।’
প্রসঙ্গক্রমে ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম সাইফুল বারী বলেন, ‘বর্তমানে বেশির ভাগ বিল্ডিংয়ে নতুন নতুন প্রযুক্তি সংযুক্ত করা হয়েছে। এ প্রযুক্তির মাধ্যমে নিজের ভবনকে রাখা যাবে আরও বেশি সুরক্ষিত। শুধু ভূমিকম্পের কথা বলে বসে থাকলে হবে না। আমাদের সব জায়গাতে এটা নিয়ে আলোচনা করতে হবে।’
যারা এ সেক্টরের সঙ্গে যুক্ত, তারা তো সবাই দক্ষ নয়। তাদের কীভাবে দক্ষ করে গড়ে তোলা যায়? মুনির হাসানের এই প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক ড. সৈয়দ ফখরুল আমীন বলেন, ‘বর্তমানে অনেক স্টিল, রড ও সিমেন্টের কোম্পানি এ সেক্টরের সঙ্গে যুক্তদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তুলছে। এ বিষয়টি খুবই পজিটিভ।’
একটি বিল্ডিং দক্ষ মানুষ দিয়ে তৈরি করা হলো। কিন্তু বিল্ডিংয়ের মেইনটেন্যান্স কীভাবে করতে হবে? দেশের বেশির ভাগ বাড়িতে মেইনটেন্যান্সের বিষয়টি কীভাবে দেখা হয়? জানতে চান মুনির হাসান।
উত্তরে ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম সাইফুল বারী বলেন, ‘অবকাঠামো হয়ে গেলে সেটা অনেক দিন টেকে। কিন্তু বিষয়টা যত সহজে ভাবা যায়, তত সহজ নয়। বিল্ডিংয়ের অবকাঠামো তৈরি করলেই হবে না, বিল্ডিংকে ভালোভাবে মেইনটেন্যান্স করতে হবে। তাহলে টিকে থাকবে বছরের পর বছর। অবকাঠামোর কোনো সামান্য ক্ষতি হলে পুরো বিল্ডিংয়ের জন্যই ক্ষতিকর। সমস্যা দেখা দেওয়ার আগে থেকেই যদি আমার ভালোভাবে মেইনটেন্যান্স করতে পারি, তাহলে বিল্ডিং টিকে থাকবে বছরের পর বছর।’