ঢাকার বাতাসে ক্ষতিকর ‘রেসপিরেবল সিলিকা’, এর স্বাস্থ্যঝুঁকি কী

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী, রেসপিরেবল সিলিকা (আরএস) হলো এমন ক্ষুদ্রকণা, যাদের আকার ১০ মাইক্রোমিটার বা তার কমফাইল ছবি: প্রথম আলো

শ্বাসতন্ত্র ও ফুসফুসের সংক্রমণের জন্য দায়ী রেসপিরেবল সিলিকা (আরএস) বা একটি অতিক্ষুদ্র ধূলিকণার মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি পাওয়া গেছে রাজধানীর বাতাসে। শুষ্ক মৌসুমে বা নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত এ ক্ষতিকর উপাদান বেশি পাওয়া গেছে। কোথাও কোথাও সহনীয় মাত্রার চেয়ে দ্বিগুণের বেশি এর উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের এক গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে। বায়ুদূষণের নানা উপাদান নিয়ে এর আগে একাধিক গবেষণা হলেও আরএসের উপস্থিতি নিয়ে এ ধরনের গবেষণা এই প্রথম বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। গবেষণাটি গত শুক্রবার (২৪ অক্টোবর) খ্যাতনামা সাময়িকী নেচার–এ প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণায় শুধু আরএসের উপস্থিতির চিত্রই তুলে ধরা হয়নি। এর উপস্থিতি ক্যানসার বা অন্য সমস্যা সৃষ্টিতে কতটুকু দায়ী, তার সম্ভাব্য চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে।

আরএস ফুসফুসের রোগ, কিডনির রোগ, ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়া এবং সিলিকোসিসসহ গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা। 

আরও পড়ুন

  আরএস কী

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী, আরএস ধূলিকণা হলো এমন ক্ষুদ্রকণা, যাদের আকার ১০ মাইক্রোমিটার বা তার কম। এটি নাক বা মুখ দিয়ে সহজেই শ্বাসের সঙ্গে শরীরে প্রবেশ করতে পারে। অন্যান্য ধরনের ধূলিকণার তুলনায় এরা এতটাই ছোট, প্রায় খালি চোখে দেখা যায় না। ফলে তারা বাতাসে অনেকক্ষণ ভেসে থাকতে পারে এবং ফুসফুসের গভীরে পৌঁছে যেতে সক্ষম।

গবেষণায় নেতৃত্ব দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আব্দুস সালাম। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে শুরু করে এ গবেষণা চলে ২০২৪ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত।
আরও পড়ুন

কেন এই গবেষণা, কখন ও কোথায় হলো

এ গবেষণার নেতৃত্ব দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আব্দুস সালাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকায় দ্রুত নগরায়ণের ফলে সৃষ্ট বায়ুদূষণের প্রভাব বিবেচনায় রেখে বছরের বিভিন্ন ঋতুতে পরিবেশগত বায়ুতে রেসপিরেবল সিলিকা বা আরএসের ঘনত্ব পরিমাপ করা আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল। আরএসের সংস্পর্শে আসার ফলে জনস্বাস্থ্যের যে পরিণতি ঘটে, বিশেষ করে ক্যানসারজনিত ও অক্যানসারজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকিগুলো, তা সমন্বিতভাবে মূল্যায়ন করা।

এই গবেষণায় বিভিন্ন ঋতুতে ঢাকা শহরে বছরের পরিবেশগত বায়ুতে আরএসের ঘনত্ব এবং এর উৎসগুলোর বৈচিত্র্য পরীক্ষা করা হয়েছে। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে শুরু করে এ গবেষণা চলে ২০২৪ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত।

শ্বাসপ্রশ্বাসের বাধা সৃষ্টি করে আরএস। এটি বিপজ্জনক উপাদান। শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে নেওয়া হলে গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন সিলিকোসিস, ফুসফুসের ক্যানসার এবং অন্যান্য শ্বাসযন্ত্রের রোগ হতে পারে।
ডা. আয়েশা আক্তার, শ্যামলীর টিবি হাসপাতালের উপপরিচালক
আরও পড়ুন

ঢাকা শহরের ভিন্ন পরিবেশে আরএসের উপস্থিতি দেখতে গবেষণায় পাঁচটি স্থান বেছে নেওয়া হয়। এগুলো হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুকাররম হোসেন বিজ্ঞান ভবন। এটি একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানভিত্তিক এলাকা, যেখানে শিল্পকারখানা বা নির্মাণকাজ খুবই সীমিত। দ্বিতীয় স্থানটি হলো গ্রিন মডেল টাউন। এটি একটি দ্রুত বিকাশমান একটি আবাসিক এলাকা, যেখানে নিয়মিত নির্মাণকাজ চলছে। তৃতীয় হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকা। যখন এই গবেষণা চলে তখন মেট্রোরেলের কাজ চলছিল। চতুর্থ স্থানটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকা। এখানে বর্জ্য পোড়ানো হয় এবং হাসপাতাল-সংশ্লিষ্ট নানা কার্যক্রম আছে। পঞ্চম স্থানটি হলো মেরাদিয়া কাঁচাবাজার। এটি ঘনবসতিপূর্ণ বাজার এলাকা, যেখানে মানুষ ও যানবাহনের চলাচল অত্যন্ত বেশি। ফলে এখানে ধূলিকণা ও বায়ুকণার মাত্রা তুলনামূলকভাবে বেশি পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন

আরএসের সহনীয় মাত্রা কত, ঢাকার কোথায় কতটা পাওয়া গেল

বাংলাদেশে আরএসের সহনীয় মাত্রা কত, তা নির্ধারণ করা হয়নি এখনো। তবে যুক্তরাষ্ট্রের অফিস অব দ্য এনভায়রনমেন্টাল হেলথ হ্যাজার্ড (ওইএইচএইচএ) বাতাসে আরএসের সহনীয় মাত্রা নির্ধারণ করেছে প্রতি ঘনমিটারে ৩ মাইক্রোগ্রাম। গড়ে পাঁচ এলাকার মধ্যে মুকাররম হোসেন বিজ্ঞান ভবনে ১ দশমিক শূন্য ৮ মাইক্রোগ্রাম, গ্রিন মডেল টাউনে ২ দশমিক ১৪ মাইক্রোগ্রাম, ঢাকা মেডিকেল কলেজের আশপাশে ১ দশমিক ৬৬ মাইক্রোগ্রাম, টিএসসিতে ৭ দশমিক ৩৩ মাইক্রোগ্রাম এবং মেরাদিয়ায় ৩ দশমিক ৪৫ মাইক্রোগ্রাম। দেখা যাচ্ছে, টিএসসি ও মেরাদিয়ায় উচ্চমাত্রায় আরএসের উপস্থিতি আছে।

আরও পড়ুন

গবেষণায় আরএসের উপস্থিতিতে ক্যানসার-ভিন্ন অন্য রোগের ঝুঁকি এবং ক্যানসারের ঝুঁকি নির্ণয় করা হয়েছে। গবেষকদের একজন মো. নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, যদি ঝুঁকির মাত্রা এক বা এর কাছাকাছি হয়, তবে এসব রোগের ঝুঁকি বেশি বলে গণ্য হয়।

টিএসসি এলাকায় ক্যানসার–ভিন্ন রোগের ঝুঁকি সর্বনিম্ন ২ দশমিক ৩৭ থেকে সর্বোচ্চ ২ দশমিক ৪৮। আর ক্যানসারের ঝুঁকি সর্বনিম্ন ২ দশমিক ৭০ থেকে ২ দশমিক ৮৩। মেরাদিয়ায় অন্য রোগের ঝুঁকি সর্বনিম্ন শূন্য দশমিক ৯৭ থেকে ১ দশমিক ৪০। আর ক্যানসারের ঝুঁকি সর্বনিম্ন ১ দশমিক ১১ থেকে সর্বোচ্চ ১ দশমিক ৫৯। বাকি অঞ্চলগুলোর মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকায় অন্য রোগের ঝুঁকি সর্বোচ্চ শূন্য দশমিক ৯৮ আর ক্যানসারের ঝুঁকি সর্বোচ্চ ১ দশমিক ১২।

বালুকণার মধ্যেই মূলত আরএস থাকে। মন্ত্রণালয় জিরো সয়েল ক্যাম্পেইন শুরু করেছে। এর মাধ্যমে আমরা নগরীর উন্মুক্ত স্থান ঢেকে দিতে চাই। কিন্তু নির্মাণকাজ এত বেশি যে এর নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। কতজনকে আর কন্ট্রোল করা যায়?
জিয়াউল হক, পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা)
আরও পড়ুন

আরএসের উচ্চমাত্রায় শরীরে কী হয়

আরএসের মতো সূক্ষ্ম উপাদান শরীরে ঢোকার প্রধান স্থান হলো নাক। এটি এত ছোট যে নাক দিয়ে সহজেই ঢুকে পড়ে। আর এর গন্তব্যস্থল হয় ফুসফুস।

শ্যামলীর টিবি হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার বলেন, শ্বাসপ্রশ্বাসের বাধা সৃষ্টি করে আরএস। এটি বিপজ্জনক উপাদান। শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে নেওয়া হলে গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন সিলিকোসিস, ফুসফুসের ক্যানসার এবং অন্যান্য শ্বাসযন্ত্রের রোগ হতে পারে।

ডা. আয়েশা আক্তার বলেন, সিলিকোসিস একধরনের ফুসফুসের রোগ, যা দীর্ঘ সময় ধরে আরএসের শ্বাসপ্রশ্বাসের প্রবেশের কারণে হয়।

আরও পড়ুন

  সরকার কী করছে

নির্মাণকাজের ধুলাবালু, রাস্তার ধুলা, বজ্র পোড়ানোর সময়ের ধোঁয়া ইত্যাদি আরএসের প্রধান উৎস। রাজধানীর প্রায় সব নির্মাণকাজ একেবারে উন্মুক্ত অবস্থায় হয়। রাস্তার ধুলা নিয়ন্ত্রণে কোনো কাজ নেই বললেই চলে। এ অবস্থায় উন্মুক্ত স্থান ঘাস বা গাছ আচ্ছাদিত করে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) জিয়াউল হক বলেন, বালুকণার মধ্যেই মূলত আরএস থাকে। মন্ত্রণালয় ‘জিরো সয়েল ক্যাম্পেইন’ শুরু করেছে। এর মাধ্যমে আমরা নগরীর উন্মুক্ত স্থান ঢেকে দিতে চাই। কিন্তু নির্মাণকাজ এত বেশি যে এর নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। কতজনকে আর কন্ট্রোল করা যায়?’

আরও পড়ুন