পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত মার্কিন সাংবাদিক পিটার আর কান ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় ছিলেন। ওই সময় প্রতিদিন যুক্তরাষ্ট্রে লেখা পাঠানোর সুযোগ না পেয়ে দিনপঞ্জি রাখতে শুরু করেন তিনি। কয়েক দিনের দিনপঞ্জি একসঙ্গে পাঠালে তা প্রকাশ করত দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল তাঁর দিনপঞ্জি প্রকাশ করে। প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য আজ তাঁর ১৬ থেকে ১৮ ডিসেম্বরের দিনপঞ্জি তুলে ধরা হলো।
১৬ ডিসেম্বর সকাল ১০টা ১০ মিনিটে একজন হোটেল কর্মকর্তা এসে জানালেন, ‘এটি নিশ্চিত, এটি নিশ্চিত। এটি আত্মসমর্পণ।’ পাঁচ মিনিট পর, হোটেলে থাকা জাতিসংঘের একজন সহযোগী এটি আনুষ্ঠানিকভাবে জানালেন, ‘আত্মসমর্পণ করার চূড়ান্ত প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে।’
কয়েকজন প্রতিবেদক জেনারেল ফরমানকে দেখার চেষ্টা করার জন্য পাকিস্তান সেনানিবাসে গেলেন। উদ্দেশ্য পূরণ হলো না, তবে সেনানিবাসের ফটকে বেশ একখানা দৃশ্য দেখা গেল। সব ধরনের যানবাহনে করে সেনারা এখন সেনানিবাসে ঢোকার চেষ্টা করছে—বাস, ট্রাক, গাড়ি—এমনকি রিকশায়ও। চলমান এক মাইক্রোবাস দেখা গেল, যার পেছনের অংশে লেখা, ‘বাঁচো এবং বাঁচতে দাও’। পশ্চিম পাকিস্তানি এবং বেসামরিক বিহারিরাও সেনানিবাসে ঢোকার চেষ্টা করছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মনে হচ্ছে, তারা সব ব্যক্তিগত জিনিস ফেলেই চলে এসেছে, শুধু ট্রানজিস্টর রেডিও বাদে।
এখানকার জাতিসংঘের প্রধান পল মার্ক হেনরির সঙ্গে দেখা হলো, তিনি নটর ডেম কলেজে আরেকটি নিরপেক্ষ এলাকা পরিচালনা করছেন। আত্মসমর্পণের বিষয়টি নিয়ে হেনরি বেশ উচ্ছল ছিলেন, কিন্তু যোগাযোগের পথ হিসেবে তাঁর ভূমিকা নিয়ে চাপে ছিলেন। কলেজ ক্যাম্পাসের চারপাশে, নিজের বড় ও কালো রঙের ল্যাব্রাডোর কুকুর নিয়ে তিনি হাঁটছিলেন। আরেকটি কুকুরের সঙ্গে ল্যাব্রাডোরটির লড়াই বেধেছিল, এতে হেনরির দীর্ঘ বক্তব্য বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। হেনরি তখনো উদ্বেগে ছিলেন যে সংখ্যালঘুদের হত্যাযজ্ঞের শিকার হওয়ার আশঙ্কা আছে। তাঁর একজন সহকারী সেটি সরলভাবে বলে দিলেন, ‘আজকের রাতটি হবে লম্বা ছুরির রাত’।
অন্য প্রতিবেদকদের সঙ্গে দৌড়ে যেতে হলো বিমানবন্দরে। ১২টা ৪৫-এ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি গাড়ি দৃশ্যমান হলো, যার প্লেটে দুটি তারকা চিহ্নিত ছিল। ধারণা করা হচ্ছিল, পাকিস্তানের জেনারেল ভারতীয় হেলিকপ্টারের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। কিন্তু বেগুনি পাগড়ি পরা এক জেনারেল এবং ঘোড়সওয়ারির টুপি পরা আরেকজন বের হয়ে এলেন; এটি পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর শিরস্ত্রাণ নয়। ঘোড়সওয়ারির টুপি পরা ব্যক্তিটি বললেন, ‘হ্যালো, আমি জেনারেল নাগরা, ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং ইনি হলেন ব্রিগেডিয়ার ক্লের’, পাগড়ি পরা ব্যক্তিকে দেখিয়ে তিনি জানালেন। ভারতীয় যে দলটি উত্তর দিক থেকে আজ সকালে ঢাকার উপশহরে ঢুকেছে, সেটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁরা।
ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে কিছু মানুষ সমস্যা সৃষ্টি করেছে বলে খবর পেলাম এবং হোটেলে ফিরে গেলাম। প্রবল উত্তেজিত এক মুক্তিকে (মুক্তিবাহিনীর সদস্য) হোটেলের ফটক দিয়ে ভেতরে আনা হয়েছে, যাঁর পায়ে প্রচণ্ড আঘাত। মুক্তিকে অবশেষে হোটেলের তিনটি চেয়ারের ওপর শোয়ানো হলো। হোটেলের কর্মকর্তারা এলেন, সেই কেতাদুরস্ত গ্লেন প্লেইড স্যুট পরে। হোটেলের কর্মকর্তা বলেন, ‘আমার সেরা চেয়ারগুলো তাঁর রক্তে ধুয়ে গেল এবং সব জারজ তাঁর পায়ের আঙুলেই আঘাত করেছে।’
এই শহর সশস্ত্র আতঙ্কিত মানুষে পূর্ণ হয়ে আছে: উত্তেজিত তরুণ মুক্তি, বিভ্রান্ত ভারতীয়রা এবং ভীত পাকিস্তানি সেনারা, যারা আত্মসমর্পণ করার চেষ্টা করছে, কিন্তু তারা জানে না কীভাবে এবং কার কাছে তা করবে।
আজ বিকেলে জেনারেল নাগরা ও পাকিস্তানি জেনারেল ফরমান হোটেলের ফটকে এলেন জিপে করে। ফরমানের চারপাশে জটলা বেধে গেল এবং তারা চেঁচাতে লাগল এই বলে, ‘কসাই, খুনি, জারজ’। ফরমান সেই জটলার দিকে এগিয়ে গেলেন এবং ধীর স্বরে বললেন, ‘কিন্তু আপনারা কি জানেন না, আপনাদের জন্য আমি কী করেছি?’ আত্মসমর্পণকেই তিনি বুঝিয়েছিলেন, যেটি অনেক প্রাণ বাঁচিয়েছিল। হয়তো মানুষের জটলাও সেটি জানত, কিন্তু তারা তোয়াক্কা করছে না।
বিকেল পাঁচটা এবং প্রতিবেদকেরা আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের জন্য রেসকোর্স ময়দানে দৌড়ে গেলেন। আত্মসমর্পণের দলিল চার দফায় স্বাক্ষরিত হলো। কিছুটা সময় লাগল, কারণ জেনারেল নিয়াজি সব দলিল পড়লেন এমনভাবে, যেন প্রথমবারের মতো পড়ছেন। স্বাক্ষরের পর দৃশ্যপট সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ল। জড়ো হওয়া মানুষেরা ভারতীয় জেনারেলদের কাঁধে তোলার চেষ্টা করল, পাকিস্তানের জেনারেলরা মানুষের ভিড়ে বিস্মিত হয়ে গেলেন। মানুষের ভিড়ে মিশে যেতে যেতেও জেনারেল ফরমান হয়ে পড়লেন একলা, হতবাক। দুজন বাঙালি দৌড়াতে দৌড়াতে জেনারেল ফরমানের সঙ্গে ধাক্কা খেল, ওই অবস্থাতেই ফরমান বিড়বিড় করে বললেন, ‘দেখছেন, আমরা সবখানেই প্রহৃত হলাম।’
ফরমান ধীরে ধীরেই হাঁটতে থাকলেন, সোয়েটারের পকেটে এক হাত ঢোকানো ছিল। ‘এই জায়গা থেকে আমি বের হব কীভাবে?’ ভিড়ের মধ্যে তাঁকে হারিয়ে ফেলার আগে অবশ্য এ ব্যাপারে বিশেষভাবে নির্দিষ্ট কাউকে তিনি কিছু জিজ্ঞেস করলেন না।
১৭ ডিসেম্বর, শুক্রবার
হোটেলের লন্ড্রি বইয়ের হিসাব রাখা ব্যক্তির সঙ্গে কথা হলো, যিনি এখন মুক্তি পুলিশের পরিদর্শক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। জানা গেল, ৯ মাস ধরে তিনি ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের কর্মীদের মুক্তি শাখার নেতা ছিলেন। তিনি শার্টের ভেতরে পরার গেঞ্জিকে সংকেত হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। যদি কোনো এজেন্ট তাকে শার্টের নিচে পরার জন্য একটি গেঞ্জি সরবরাহ করে, তবে বুঝতে হবে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে চারটি কাজ সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। দুটি গেঞ্জির অর্থ হলো তিনটি সফলতা, তিনটি গেঞ্জির মানে বোঝায় দুটি সফলতা এবং চারটি গেঞ্জির অর্থ হলো মাত্র একটি সফলতা। এখন আর কোনো কিছুই অসম্ভব মনে হচ্ছে না!
বিকেল ৫টা ৫৫ মিনিটে দুই সোভিয়েত সাংবাদিক এসে পৌঁছালেন। তাঁরা বললেন, ‘আমরা তাস ও প্রাভদা। আমরা মাত্রই এসে পৌঁছেছি। খবর কী?’
দুই ঘণ্টা পর, হোটেলের কক্ষে বসে স্কচে চুমুক দিতে দিতে এক প্রতিবেদক বললেন, ‘আরে, বাতি জ্বালানো আছে।’ এবং একই অবস্থা তাঁদেরও। গত প্রায় দুই সপ্তাহের মধ্যে এই প্রথম কোনো রাত মোমবাতির আলোয় পার করতে হলো না।
পরে তিনজন ভারতীয় এসে জানালেন, ‘শহর এখন সম্পূর্ণ শান্ত আছে, কারফিউ আরোপ করা হয়েছে, সব ধরনের রক্তক্ষয়ী গোলাগুলি আমরা বন্ধ করে দিয়েছি এবং...।’ বাকি কথাগুলো স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলি ছোড়ার শব্দের নিচে চাপা পড়ে গেল।
কিন্তু গতকালের চেয়ে আজ অনেক শান্ত পরিবেশ।
১৮ ডিসেম্বর, শনিবার
বেশ গোলাগুলি হলো এবং কিছু হত্যার ঘটনা এখনো চলছে, বিশেষ করে বিহারিদের। বাংলাদেশের বিজয়ের উদ্যাপন পরিণত হয়েছে রক্তগঙ্গায়, পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি সহানুভূতিশীল চার ব্যক্তিকে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়েছে। আজকের দিনের প্রথমভাগে মুক্তিরা বিখ্যাত বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের গণকবর খুঁজে পায়, যাঁদের স্থানীয় সামরিক বাহিনীর সদস্যরা জিম্মি করেছিল এবং গত দিনের আগের রাতে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ঐতিহ্যগতভাবে এটি একটি রক্তরঞ্জিত সমাজ, যেটি সদ্যই ৯ মাসের রক্তগঙ্গার মধ্য দিয়ে গেছে। রক্তঝরা হুট করে বন্ধ হবে কেন?
বিমানবন্দরের টার্মিনাল এলাকায় একজন ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার ঘুরছিলেন এবং রানওয়ে সংস্কার করার বিষয়টি সংগঠিত করছিলেন। রানওয়ের বিভিন্ন জায়গা ছিল গর্তে ভরা। সংস্কারকাজ চালাতে তিনি বাঙালিদের চাইছিলেন, ভারতীয় সেনা নয়। যেকোনো ত্রাণমূলক কাজে অবশ্য সেই চাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। হতাশ কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘কিন্তু বাঙালি তরুণেরা শুধু চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং সারা দিন উদ্যাপনেই কাটিয়ে দিচ্ছে।’ এখন ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার করাটা বাঙালিদের কাছে খাবারের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
মনে হচ্ছে, ঢাকা ক্রমান্বয়ে শান্ত হয়ে আসছে। কিছু মানুষ তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে বাংলাদেশে প্রথম ঘুরতে বেরিয়েছে। এক বাঙালি বললেন, তাঁর তিন বছর বয়সী ছেলে অপু গত কয়েক মাসে বাইরে বের হয়নি। কারণ হলো, গত মার্চে যখন পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দমন-পীড়ন শুরু করে এবং পুরো পূর্ব পাকিস্তানে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে, তার ঠিক আগে শিশুটি ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার করতে শিখেছিল। কিন্তু ৯ মাস ধরে মা–বাবা ভয় পাচ্ছিলেন এই ভেবে যে বাইরে বের হলেই শিশুটি হয়তো সবার সামনে ‘জয় বাংলা’ বলে বসতে পারে এবং তাতে পুরো পরিবারই হত্যার শিকার হতে পারে।
আজ বাবা ও ছেলে দুজনই রাস্তায় নেমেছে এবং চিৎকার করে বলছে, ‘জয় বাংলা!’