জেনারেল নিয়াজি তিন দিন আগেও বলেছিলেন, আত্মসমর্পণের প্রশ্নই ওঠে না

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ : আত্মসমর্পণের দলিলে সই করেন পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজি (ডানে বসা)। পাশে বসা মিত্রবাহিনীর লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরাছবি: সংগৃহীত
পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত মার্কিন সাংবাদিক পিটার আর কান ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় ছিলেন। ওই সময় প্রতিদিন যুক্তরাষ্ট্রে লেখা পাঠানোর সুযোগ না পেয়ে দিনপঞ্জি রাখতে শুরু করেন তিনি। কয়েক দিনের দিনপঞ্জি একসঙ্গে পাঠালে তা প্রকাশ করত ‘দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল তাঁর দিনপঞ্জি প্রকাশ করে। প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য আজ তাঁর ১৩ ডিসেম্বরের দিনপঞ্জি তুলে ধরা হলো।

সকালে একটি পত্রিকায় বড় বড় শিরোনামে ঘোষণা করল, ‘শত্রুর অগ্রসর হওয়া থেমে গেছে’, কিন্তু পত্রিকার সবচেয়ে বড় নিবন্ধটি হলো, ‘দুর্ভিক্ষের ছোবলে আক্রান্ত আপার ভোল্টা’। সকালের খাবার খাওয়ার কক্ষ থেকে দেখা যায় যে হোটেলের কর্মীরা বিমানবিধ্বংসী অস্ত্রের পরিত্যক্ত অবশেষ তুলছে সুইমিংপুল থেকে। তার জন্য একটি দড়িতে চুম্বক বেঁধে সুইমিংপুলে নামানো হচ্ছিল।

কারফিউ উঠিয়ে নেওয়ার পরবর্তী ছয় ঘণ্টা সময়ে গাড়ি চালিয়ে শহরের কেন্দ্রে যাওয়া গেল। বেশির ভাগ বাঙালি শহর ছেড়ে চলে গেছে, কিন্তু অনেক বিহারিকে (সংখ্যালঘু অবাঙালি) রাস্তায় দেখা গেল এবং অবশ্যই ছিল রিকশাওয়ালা। আজ পাকিস্তানের পতাকা কিছুটা কম দেখলাম আমি। কূটনীতিক বললেন, ‘ঢাকায় প্রতিটি সেলাই মেশিন এখন বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে কাজ করতে ব্যস্ত।’

পূর্বাঞ্চলের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডার জেনারেল এ এ কে নিয়াজি হোটেল থেকে রাস্তার পাশে এসে দেখা দিলেন এবং সাক্ষাৎকার দিলেন সেখানেই।

‘যুদ্ধ কেমন চলছে?’

‘যেভাবে আমি পরিকল্পনা করেছি।’

‘আপনি কি শহর রক্ষা করতে পারবেন?’

‘শেষ পর্যন্ত।’

‘কিন্তু এর অর্থ কি এটি নয় যে তাতে ঢাকা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে?’

‘এগুলো স্বাধীনতার মূল্য।’

‘যুদ্ধবিরতি বা আত্মসমর্পণ বিষয়ে ভাবনা কী?’

‘সেনাবাহিনী মরে যাবে। আত্মসমর্পণের প্রশ্নই ওঠে না। প্রত্যাবাসনের জন্য কেউ থাকবে না।’

যদি তাঁর সেনারাও একই আবেগ ধারণ করে, তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হবে।

জেনারেল নিয়াজির চারপাশ ঘিরে ২৫ জনের মতো বিহারির একটি দল চিৎকার করছিল, ‘পাকিস্তান, জিন্দাবাদ, পাকিস্তান, জিন্দাবাদ,’ যার অর্থ হলো, ‘পাকিস্তান দীর্ঘজীবী হোক।’ কিছু লোক কাঁদছিল। কিছু ব্যক্তি আবার লাফাচ্ছিল এবং পাগলের মতো চিৎকার করছিল। রিকশা যাচ্ছিল পাশ দিয়ে এবং বিহারি যাত্রীরা রিকশায় বসে যুদ্ধের বুনো নাচ নাচছিল, তখন মাথা নিচু করে রিকশার প্যাডেলে পা চালাচ্ছিল বাঙালি রিকশাচালক। বিহারিরা যেন নরকের উগ্র আচরণ করার জন্যই ঘরের বাইরে বেরিয়েছিল।

আরও পড়ুন

রেডক্রসের কর্মকর্তাদের পরিচালনায় ‘দ্য প্রেস কোর’ বর্তমানে হোটেলের নিরাপত্তা বিধানের সব দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে, হোটেলটিকে এখন নিরপেক্ষ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তাই দুপুরের পরপরই সেখানকার সব কক্ষে অস্ত্র খোঁজার অভিযান চলে, যার মূল উদ্দেশ্য হলো অস্ত্র জব্দ করা এবং সুনির্দিষ্টভাবে জানা যে হোটেলে কারা কোন কক্ষে আছে এবং তাদের পরিচয় কী।

আরও পড়ুন

পশ্চিম পাকিস্তানের বেসামরিক নাগরিকদের কাছে আরও চারটি বন্দুক পাওয়া গেছে, যাদের অনেকে এক কক্ষে ছয়জন পর্যন্ত থাকত। সন্ধ্যায় হোটেলের অধিবাসীরা যে কক্ষে মিলিত হয়ে দেখা করে, সেটি একসময় ছিল অস্ট্রেলীয় নর্তকীদের দেখার জায়গা। সেখানে কথা হয় প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা ও অগ্নিনির্বাপণ উপকরণ নিয়ে, নিরাপত্তারক্ষীদের দায়িত্ব ও পরিখা তৈরির বিষয়ে।

* ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদনটির একাংশ আবার প্রকাশ করা হলো

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন