বিএসএমএমইউয়ে নতুন উপাচার্য আসছেন, নাকি আগেরজনই থাকছেন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ফাইল ছবি

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) বর্তমান উপাচার্যের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২৮ মার্চ। এরপর নতুন উপাচার্য কে হতে যাচ্ছেন অথবা বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক শারফুদ্দিন আহমেদ দ্বিতীয় মেয়াদে থাকছেন কি না, তা নিয়ে চিকিৎসা–সংশ্লিষ্ট মহলে কৌতূহল রয়েছে। পাশাপাশি নতুন উপাচার্য কে হতে পারেন বা হতে চান—এমন প্রায় এক ডজন অধ্যাপকের নাম শোনা যাচ্ছে।

গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে কথা হয় অধ্যাপক শারফুদ্দিন আহমেদের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি কনফিডেন্ট (আত্মবিশ্বাসী), আমি থেকে যাচ্ছি।’ এ প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হয়, ‘জাতীয় সংসদে সরকারদলীয় একজন প্রভাবশালী সংসদ সদস্য বিএসএমএমইউর ব্যাপারে ব্যাপক সমালোচনা করেছেন। অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির প্রসঙ্গ তুলেছেন। এটা কি এই বার্তা দেয় না যে সরকার আপনার ওপর আস্থা রাখতে পারছে না?’

আরও পড়ুন
বিএসএমএমইউর বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক শারফুদ্দিন আহমেদ
ফাইল ছবি

এর জবাবে শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ওই সংসদ সদস্যকে দিয়ে আমার বিরুদ্ধে কথা বলানো হয়েছে। সংসদকে খাটো না করে আমি সংসদ সদস্যের বক্তব্যের জবাব কী করে দেব, সেই পথ খুঁজছি?’ বর্তমান উপাচার্য আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের একটি গোষ্ঠী তিন বছর ধরে তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। এদেরই কেউ কেউ উপাচার্যের চেয়ারে বসতে চান।

শারফুদ্দিন আহমদের আমলের অনিয়ম–দুর্নীতি–স্বজনপ্রীতি নিয়ে গত এক বছরে বেশ কিছু প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে প্রথম আলোসহ কয়েকটি সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক তিন উপাচার্যের সঙ্গেও বিভিন্ন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তাঁদের দুজন বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় ভালো চলছে না।

গতকাল পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে হৃদ্‌রোগ বিভাগের একজন অধ্যাপক প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট–বল্টু এমনভাবে নষ্ট করা হয়েছে যে সবচেয়ে ভালো একজন উপাচার্য নিয়োগ দিলেও ২৫ বছর সময় লাগবে বিশ্ববিদ্যালয়কে ঠিক পথে আনতে।’

আরও পড়ুন

সাম্প্রতিক সময়ে বিএসএমএমইউতে কোনো অধ্যাপক বা কর্মকর্তার কক্ষে ঢুকলে প্রথমেই এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে—‘ভাই, কে হচ্ছেন ভিসি?’ অথবা ‘দাদা, কাকে এগিয়ে রাখছেন?’ গতকাল সকাল সাড়ে আটটা থেকে বেলা একটা পর্যন্ত তাঁদের সঙ্গে কথা বলে প্রায় এক ডজন অধ্যাপকের নাম পাওয়া গেছে। ধরা নেওয়া হচ্ছে, তাঁদের ভিসি হওয়ার ইচ্ছা আছে অথবা তাঁদের নাম ‘হাওয়ায় ভাসছে’। তাঁদের মধ্যে আছেন, অধ্যাপক ইকবাল আর্সলান। তিনি প্রায় ১৫ বছর আওয়ামী লীগ সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব ও সভাপতি ছিলেন।

বর্তমানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ কোথাও নেই। তাঁর বয়সও সত্তর পেরিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নিয়েছেন বেশ আগেই। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি নিজে কখনো বলিনি উপাচার্য হতে চাই।’

ইকবাল আর্সনালের বক্তব্য পাওয়া গেলেও তাঁর বন্ধু অধ্যাপক কাজী দীন মোহাম্মদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। প্রায় ১০ বছর আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষের পদ থেকে অবসর নেওয়ার পর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। শোনা যায়, স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্বপূর্ণ অনেক সিদ্ধান্তে এই স্নায়ুরোগবিশেষজ্ঞ জড়িত থাকেন, যদিও সাধারণের চোখে তা ধরা পড়ে না।

আরও পড়ুন

এমন কথাও শোনা গেছে, বিএসএমএমইউর উপচার্যের পদে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বর্তমান মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলমকে বসানো হতে পারে। কাজী দীন মোহাম্মদ যদি কারও কথা বলেন, তাহলে তিনি আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলমের কথাই বলবেন। বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনসে (বিসিপিএস) এই দুজন একে অন্যের সমর্থক। তবে সমস্যা একটাই— তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো পদে কোনো দিন কাজ করেননি। বাইরের কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে টিকতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। এখানে রাজনীতি প্রবল।

বিএসএমএমইউর চিকিৎসকেরা বিশেষ করে অধ্যাপকেরা প্রায় সবাই স্বাচিপের সদস্য। স্বাচিপ বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা উপদলে বিভক্ত। এসব উপদলের পেছনে আছেন আওয়ামী লীগের কোনো না কোনো বড় নেতা। তবে সব ছাপিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বি ব্লকের দ্বিতীয় তলায় কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহাম্মদ আতিকুর রহমানের কক্ষ। ওই কক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা শ্রেণির মানুষের আনাগোনা লেগেই থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ কেউ মনে করেন, উপাচার্য হওয়ার দৌড়ে তিনি সামনের দিকে আছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ইচ্ছাই যথেষ্ট নয়। নেত্রী যা চাইবেন তা–ই হবে।’

আরও পড়ুন

একই কথা বলেছেন দৌড়ে সামনের দিকে থাকা স্নায়ুরোগ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু নাসের রিজভী। নাম শোনা যাচ্ছে সহ–উপাচার্য (একাডেমিক) অধ্যাপক একেএম মোশাররফ হোসেন ও  নিউরোসার্জারি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ হোসেনেরও।

তবে কৌশলে একটি পদের অধিকারী হওয়ার ব্যাপারে বক্তব্য দিয়েছেন অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক আবু জাফর চৌধুরী। তিনি নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। আবু জাফর চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ শর্তহীনভাবে আমার পাশে আছে। আমি সহ–উপাচার্য ও উপাচার্য দুটি পদেরই যোগ্য।’

বিএমএমএমইউতে কখনো কোনো নারী উপাচার্যের চেয়ারে বসেননি। এবার একজনের নাম শোনা যাচ্ছে। তিনি শিশু বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সাহানা আখতার রহমান। একসময় তিনি সহ–উপাচার্যের দায়িত্বও পালন করেছেন। তবে এই শিশুরোগবিশেষজ্ঞের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা বলার সুযোগ হয়নি।

আরও পড়ুন

উপাচার্য পদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক আরও তিনজন অধ্যাপকের নামও শোনা যাচ্ছে। তাঁদের একজন বিএসএমএমইউর সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল প্রকল্পের পরিচালক অধ্যাপক জুলফিকার রহমান খান। আর একজন হচ্ছেন চর্মরোগবিশেষজ্ঞ শহিদুল্লাহ শিকদার। বাকিজন শিশুরোগবিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ সহিদুল্লা। শেষের দুজন ভিন্ন ভিন্ন সময়ে সহ–উপাচার্যের দায়িত্বে ছিলেন।

বিএসএমএমইউ হচ্ছে চিকিৎসকদের রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র। ১৫ বছর আগে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীপন্থী চিকিৎসক ও শিক্ষকেরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কোণঠাসা অবস্থায় চলে যান। তাঁদের অনেকের অভিযোগ—গত ১৫ বছরে তাঁরা নানা বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। ঠিক সময়ে পদোন্নতি পাননি। যোগ্য হয়েও উপযুক্ত পদে বসতে পারেননি। বিএনপি ও জামায়াতপন্থী কোনো অধ্যাপক উপাচার্যের চেয়ারে বসার চিন্তায় সময় নষ্ট করছেন না। তবে উপাচার্য পদ নিয়ে তাঁদেরও আগ্রহ আছে।

আরও পড়ুন

গতকাল এবং তারও আগে বিভিন্ন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক, শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা প্রসঙ্গ ও পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। তাঁদের একটি অংশের বক্তব্য এমন যে রাজনৈতিক প্রতিপত্তিশালী উপাচার্যের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা, গবেষণা ও চিকিৎসাসেবা বাধাগ্রস্ত হয়েছে বেশি।

বেশি দেখা দিয়েছে অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি। দলীয় বা গোষ্ঠী রাজনীতি থেকে দূরে আছেন উপাচার্য পদের জন্য এমন অধ্যাপকের নামও শোনা গেছে। যেমন অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান। তিনি ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান। তবে উপাচার্য পদে বসার বিষয়টি কোনো দিন ভেবে দেখেননি বলে জানিয়েছেন এই অধ্যাপক।