ঘাটতির দায় পুরোটাই ভোক্তার ওপর চাপল

ভর্তুকি দিতে রাজি নয় সরকার। মুনাফার টাকা জমা হয়েছে সরকারি কোষাগারে। খরচ হচ্ছে বিপিসির বিভিন্ন প্রকল্পে।

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ঘোষণার পর গত শুক্রবার রাতে রাজধানীর পরীবাগে পেট্রলপাম্পে তেল নিতে ভিড় করেন গাড়িচালকেরাছবি: সেলিম জাহিদ

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমছে। বছর শেষে এটি আরও কমতে পারে বলে পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। এমন সময় দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দামে বড় উল্লম্ফন হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অর্থনৈতিক চাপে পড়ে এ খাতে আর ভর্তুকি দিতে রাজি নয় সরকার। তাই বেশি দামে কিনে কম দামে বিক্রির ফলে যে ঘাটতি থাকে, তার পুরোটাই সমন্বয় করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে ভোক্তার ওপর।

জ্বালানি বিভাগের দুজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, টানা ছয় মাস ধরে লোকসান করছে জ্বালানি তেল আমদানি ও বিপণনকারী রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। এর মধ্যে সংস্থাটি নিজস্ব তহবিল থেকে ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি বাড়তি খরচ করেছে তেল আমদানির জন্য। চাপ সামলাতে অর্থ বিভাগ থেকে সহায়তা চেয়ে পাওয়া যায়নি। শুল্ক ও কর কমাতে রাজি নয় রাজস্ব বিভাগ (এনবিআর)। তাই বাধ্য হয়েই একবারে বেশি করে দাম বাড়াতে হয়েছে।

দাম বাড়ানোর সরকারি ব্যাখ্যা বলছে, প্রতি মাসে বিপিসির গড় আয় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। জুলাইয়ে খরচ দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৩১২ কোটি টাকা।

নির্বাহী আদেশে দাম বাড়ানোর মধ্য দিয়ে জ্বালানি তেল খাতে অনিয়ম, দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। আয়-ব্যয়ের যৌক্তিকতাও যাচাই করা হচ্ছে না। একলাফে ঘাটতি সমন্বয় করতে গিয়ে ভোক্তার জন্য সহনীয় কি না, তা ভাবা হয়নি।
এম শামসুল আলম, জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি, ক্যাব

জ্বালানি তেল আমদানিতে দুই মাসের সমপরিমাণ টাকা চলতি মূলধনে রাখতে হয়। এতে করে ২০ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। কিন্তু বিপিসির হিসাবে জমা আছে ২২ হাজার কোটি টাকা। যার ফলে আগস্টের পর আর জ্বালানি তেল আমদানি করা সম্ভব হবে না। জাতীয় বাজেটেও বিপিসির জন্য কোনো অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়নি।

বিপিসি সূত্র বলছে, ২০১৪-১৫ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরে টানা সাত বছরে বিপিসি মুনাফা করেছে ৪৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। এরপর গত বছর বিশ্ববাজারে দাম বাড়তে থাকলে নভেম্বরে ডিজেলের দাম এক দফা বাড়ায় সরকার। এতে জানুয়ারি পর্যন্ত মুনাফায় ছিল বিপিসি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গত ফেব্রুয়ারি থেকে লোকসান শুরু হয়। আগের মুনাফা দিয়ে একাধিক প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে বিপিসি। এ ছাড়া প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন একটি জ্বালানি তেল শোধনাগার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এর আগে ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে বিপিসির তহবিল থেকে উদ্বৃত্ত অর্থ হিসেবে ১০ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে সরকার।

জ্বালানি তেলের দাম হুট করে বেড়ে যাওয়ায় মাদারীপুরের ফিলিং স্টেশনগুলোয় দেখা যায় মোটসাইকেলের ভিড়। শুক্রবার রাত ১১টায় শহরের ইটেরপুল এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

মুনাফায় ফিরছে বিপিসি

দাম বাড়ানোর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, জুলাই মাসে ডিজেল সরবরাহ করতে তাদের লিটারপ্রতি খরচ হয়েছে ১২২ টাকা। নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১১৪ টাকা। এতে বিপিসির ঘাটতি পুরোপুরি পূরণ হবে না। তবে বিপিসির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত কয়েক দিনে ডিজেলের দাম আরও কমেছে বিশ্ববাজারে। নতুন দামে ডিজেল বিক্রি করে বিপিসির আর লোকসান হবে না। আর কেরোসিন, পেট্রল ও অকটেন বিক্রি করে নতুন দামেই মুনাফা করবে বিপিসি।

গত মার্চে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি (১৫৮ দশমিক ৯৯ লিটার) ১৪০ মার্কিন ডলারে পৌঁছায়। একই সময়ে ডিজেলের দাম ১৭০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। এরপর ধাপে ধাপে কমতে থাকে। যদিও বিশ্ববাজারে জুলাইয়ে ডিজেলের গড় দাম ১৩৯ ডলার ধরে দেশে নতুন দাম নির্ধারণ করেছে সরকার। গতকাল শনিবার ব্যারেলপ্রতি অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ছিল ৯৫ ডলার। আর ডিজেলের দাম ছিল ১৩৫ ডলার। এ দামে কিনলে ডলারের বর্তমান বিনিময় হার ধরে এক লিটার ডিজেল কিনতে বিপিসির খরচ হয় ৮০ টাকা। এর সঙ্গে যোগ হয় পরিবহন ভাড়া ও শুল্ক–করসহ অন্যান্য খরচ।

আরও পড়ুন

বাড়তি দামের সঙ্গে বোঝা

গোটা বিশ্বই এখন অর্থনৈতিক চাপ সামলাচ্ছে। কেউ দাম বাড়িয়ে, কেউ সাশ্রয় করে পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে। দেশেও সরকার সাশ্রয়ের উদ্যোগ নিয়ে পরিকল্পিত লোডশেডিং শুরু করে গত মাসে। জ্বালানি তেলের বাড়তি চাহিদা নিয়ন্ত্রণেরও চেষ্টা করা হয়। এখন জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে সরকার। দাম বাড়ানোর পেছনে তিনটি কারণ কাজ করতে পারে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। এগুলো হলো ভর্তুকি না দিয়ে রাজস্বের ওপর চাপ কমানো, ঋণ পেতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণ ও তেলের চাহিদা কমিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়। তবে পুরো চাপ ভোক্তার ওপর না দিয়ে দাম সহনীয় রেখে সরকার কিছুটা ভর্তুকি দিতে পারত বলে তাঁরা মনে করেন।

আরও পড়ুন

জ্বালানিবিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, সহনীয় পর্যায়ে দাম বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও তা রক্ষা করা হয়নি। মানুষ এমনিতেই মূল্যস্ফীতির চাপে আছে। নতুন করে এ সংকট আরও কয়েক গুণ বাড়বে। গত জুনে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া শেষের দিকে। গত মাস থেকে শুরু হয়েছে লোডশেডিং। আবারও গ্যাসের দাম বাড়ানো হতে পারে। এর মধ্যে দেশের ইতিহাসে রেকর্ড জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে বাড়তি খরচের বোঝা চাপল মানুষের ওপর।

আরও পড়ুন

মূল্যবৃদ্ধির বিকল্প ভাবা হয়নি

বিপিসির পুরো ঘাটতি জ্বালানি তেলের দামে সমন্বয় না করতে চাইলে সরকারের কাছে আরও একটি উপায় ছিল। সেটি হলো কর কমিয়ে দেওয়া। বিপিসি সূত্র জানিয়েছে, এখন জ্বালানি তেল আমদানিতে মোট করভার প্রায় ৩২ শতাংশ। বিপিসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, এক লিটার ডিজেলে এখন কর ও ভ্যাট দাঁড়ায় ২৪ টাকার মতো।

দাম বাড়ানো নিয়ে জ্বালানি বিভাগের ব্যাখ্যায় তুলনা হিসেবে প্রতিবেশী ভারতে জ্বালানি তেলের উচ্চ দামের কথাও বলা হয়েছে। যদিও ভারতে প্রতিদিন সকাল ছয়টায় বিশ্ববাজারের সঙ্গে মিল রেখে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হয়। তাই যখন বিশ্ববাজারে দাম কমে, সঙ্গে সঙ্গে ভারতেও কমে যায়।

আরও পড়ুন

২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর পর বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম অনেক কমে যায়। ওই সময় দেশে দাম কমানো হয়নি। জ্বালানিবিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের সঙ্গে জ্বালানি তেলের দামের পার্থক্য সব সময়ই ছিল। পাচারের বিষয়টি আনা হয়েছে দাম বাড়ানোর অজুহাত হিসেবে, এটি যৌক্তিক নয়।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাহী আদেশে দাম বাড়ানোর মধ্য দিয়ে জ্বালানি তেল খাতে অনিয়ম, দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। আয়-ব্যয়ের যৌক্তিকতাও যাচাই করা হচ্ছে না। একলাফে ঘাটতি সমন্বয় করতে গিয়ে ভোক্তার জন্য সহনীয় কি না, তা ভাবা হয়নি।