সংস্কার কমিশনের সুপারিশ
পুলিশের আশু বাস্তবায়নযোগ্য প্রস্তাব আটকে আছে ৪ কারণে
১৮ সুপারিশের মধ্যে ১১টি বাস্তবায়িত। বাকিগুলো অর্থাভাব, বাস্তবতা, মন্ত্রণালয়গত জটিলতা ও পদ্ধতিগত দীর্ঘসূত্রতায় আটকে আছে।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত পুলিশ সংস্কার কমিশন শতাধিক সংস্কারের সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে আশু বাস্তবায়নযোগ্য হিসেবে সরকারের দেওয়া ১৮টি সুপারিশের মধ্যে ১১টি বাস্তবায়ন করেছে পুলিশ। বাকিগুলো আটকে আছে চার কারণে।
পুলিশ সদর দপ্তর সংস্কার প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। সেখানে দেখা গেছে, চারটি সুপারিশের পুরোপুরি বাস্তবায়ন আটকে আছে অর্থের অভাবে। একাধিক মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টতা থাকায় আটকে আছে পাঁচটি বিষয়। চর্চার ঘাটতির কারণে কিছু সুপারিশ পুরোপুরি বাস্তবায়ন সময়সাপেক্ষ।
আদালতের আদেশ ছাড়া কোনোভাবেই এজাহারবহির্ভূত আসামি গ্রেপ্তার করা যাবে না—এই সুপারিশ বাস্তবায়নযোগ্য নয়। এ ক্ষেত্রে পুলিশের যুক্তি হলো, সাধারণত মামলা দায়েরের সময় অপরাধের সঙ্গে জড়িত সন্দেহভাজন সব আসামির নাম এজাহারে দেওয়া সম্ভব হয় না। পরে তদন্তের সময় নতুন করে অনেকের সম্পৃক্ততা সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়। এমন আসামিকে তাৎক্ষণিক গ্রেপ্তার না করলে পালিয়ে যেতে পারে। এ কারণে সুপারিশটি বাস্তবসম্মত নয়।
গত ১৩ মার্চ অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে পুলিশের আশু বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলো কার্যকর করার সিদ্ধান্ত হয়। পরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ পুলিশের সুপারিশগুলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। জুনের শেষ দিকে মন্ত্রণালয় থেকে পুলিশ সদর দপ্তরকে সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, আশু বাস্তবায়নযোগ্য সংস্কারের সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট ইউনিটগুলোকে বলা হয়েছে। কিছু বিষয় পুরোপুরি বাস্তবায়নের জন্য সদস্যদের প্রশিক্ষিত করে তোলা এবং চর্চার প্রয়োজন। সেগুলো করা হচ্ছে। অন্য সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের এক বছর পরেও স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন হয়নি। এ ক্ষেত্রে সরকারের আন্তরিকতার ঘাটতি দেখা গেছে।মোহাম্মদ নুরুল হুদা, সাবেক আইজিপি
প্রয়োজন অর্থ বরাদ্দ
আর্থিক কারণে আটকে আছে সংস্কারের চারটি সুপারিশ। এর মধ্যে একটি আংশিক আটকে আছে। সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ছিল আটক ব্যক্তি বা রিমান্ডে নেওয়া আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রতিটি থানায় অবশ্যই স্বচ্ছ কাচের ঘেরা একটি আলাদা জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষ থাকবে। এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের মূল্যায়ন হলো, এটি আশু বাস্তবায়নযোগ্য নয়। ইতিমধ্যে প্রতিটি থানায় স্বচ্ছ কাচের ঘেরা দেওয়া জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষ স্থাপনের লক্ষ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
আরেকটি সুপারিশ ছিল—পুলিশের তত্ত্বাবধানে থানাহাজত ও আদালতের হাজত পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন রাখা। পাশাপাশি বন্দীদের আদালত থেকে আনা-নেওয়ার সময় ব্যবহার করা যানবাহনগুলোতে মানবিক সেবার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিচ্ছন্নতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা।
এ বিষয়ে পুলিশের মূল্যায়নে বলা হয়, বিদ্যমান জনবল দিয়ে সামর্থ্য অনুযায়ী কাজটি করা হচ্ছে এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তদারকি জোরদার করা হয়েছে। থানাহাজত ও আদালতের হাজতের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কাজ আউটসোর্সিং জনবল দিয়েই করা হচ্ছে। পুলিশের ২ হাজার ৮০৯টি পদের আউটসোর্সিং সেবা অনুমোদনের জন্য ৬৫টি প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে অপেক্ষমাণ রয়েছে। অনুমোদন মিললে কমিশনের সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। এ ছাড়া বন্দীদের আনা-নেওয়ার মানবিক সেবা উন্নয়নে প্রিজনার্স ভ্যানের চাহিদাপত্র শিগগিরই পাঠানো হবে।
মামলার এফআইআর গ্রহণে কোনো ধরনের অনীহা বা বিলম্ব করা যাবে না—এমন একটি সুপারিশ ছিল কমিশনের। এ বিষয়ের সঙ্গে আর্থিক সংশ্লেষ আছে উল্লেখ করে পুলিশের মূল্যায়নে বলা হয়েছে, নির্দেশনাটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ ছাড়া অনলাইন এফআইআর চালুর সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে পুলিশ সদর দপ্তর অনলাইন এফআইআর চালুর প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে ফৌজদারি কার্যবিধিতে সংশোধনীর প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।
সংস্কার কমিশনের সুপারিশে বলা হয়—মামলা প্রদানের ক্ষেত্রে বডিওর্ন ক্যামেরাসহ উন্নত প্রযুক্তির সন্নিবেশ করা যেতে পারে। এ বিষয়ে পুলিশ বলছে, এটি আশু বাস্তবায়নযোগ্য নয়। এ–সংক্রান্ত প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
রাস্তায় যানবাহনে নিয়মিত তল্লাশি বা চেকপোস্টের মাধ্যমে তল্লাশির ক্ষেত্রে বডিওর্ন ক্যামেরা বা সিসি ক্যামেরার সন্নিবেশ ও প্রয়োগ নিশ্চিত করা যেতে পারে—এমন সুপারিশও করে কমিশন। এটি বাস্তবায়নের বিষয়ে পুলিশের মূল্যায়নে বলা হয়, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় বডিওর্ন ক্যামেরাসহ উন্নত প্রযুক্তির সন্নিবেশ–সংক্রান্ত প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
দীর্ঘসূত্রতায় আটকে আছে
আশু বাস্তবায়নযোগ্য পাঁচটি সুপারিশ বাস্তবায়ন একাধিক মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত হওয়ায় এবং চর্চার অভাবে দীর্ঘসূত্রতায় আটকে আছে। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব ছিল, নারী আসামিকে যথেষ্ট শালীনতার সঙ্গে নারী পুলিশের উপস্থিতিতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে।
পুলিশ বলছে, বর্তমানে নারী আসামিকে নারী পুলিশের উপস্থিতিতে শালীনতা বজায় রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এ–সংক্রান্ত প্রশিক্ষণও চলছে। তবে এই সুপারিশ পুরোপুরি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আরও জনবল প্রয়োজন। এ জন্য এক হাজার নারী পুলিশ সদস্য নিয়োগের প্রস্তাব ছিল পুলিশের। এ ছাড়া চার হাজার এএসআই পদ সৃষ্টির যে প্রজ্ঞাপন হয়েছে, সেখান থেকে ৬৬৪টি থানার প্রতিটিতে একজন নারী এএসআই পদ সৃষ্টির পরিকল্পনা আছে।
থানায় জিডি গ্রহণ বাধ্যতামূলক, কেউ জিডি করতে চাইলে না করা যাবে না—সুপারিশে এমন কথা বলা হয়েছে। এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, শতভাগ থানায় অনলাইন জিডি ব্যবস্থা চালুর জন্য কার্যক্রম চলমান আছে। এ বিষয়ে জনসাধারণের সচেতনতার জন্য ব্যাপক প্রচার চলছে।
১১ প্রস্তাব বাস্তবায়ন
পুলিশ সদর দপ্তরের সর্বশেষ মূল্যায়নে বলা হয়েছে, পুলিশ সংস্কার কমিশনের আশু বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলোর মধ্যে ১১টি বাস্তবায়িত হয়েছে। এর মধ্যে আছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দ্বারা বা তাদের প্ররোচনায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠলে সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রধান নিজেই তদন্তের নির্দেশ দিতে পারবেন। এ জন্য সংস্থাপ্রধানের কার্যালয়ে সেল চালু আছে।
গ্রেপ্তার, তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদ–সংক্রান্ত বিষয়ে আপিল বিভাগের নির্দেশনা বাস্তবায়নে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। রাতের বেলা (সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয়ের মধ্যে) গৃহ তল্লাশি করতে হলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি বা স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তির উপস্থিতি নিশ্চিত করার নির্দেশনা মানা হচ্ছে। থানায় মামলা দায়ের ও তদন্তের কার্যক্রম সার্কেল অফিসার ও পুলিশ সুপার নিয়মিত তদারক করছেন।
ভুয়া বা গায়েবি মামলায় অনিবাসী, মৃত বা নিরপরাধ ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য করার সুপারিশ করে কমিশন। পুলিশ জানিয়েছে, নির্দেশনাটি মানা হচ্ছে।
সুপারিশ অনুযায়ী, অজ্ঞাতনামা আসামির নামে মামলা দেওয়ার অপচর্চা রোধে তদারকি জোরদার করা হয়েছে। তবে পুলিশ বলছে, অনেক ক্ষেত্রে সব আসামির নাম জানা সম্ভব হয় না, তবু নিরপরাধ কাউকে হয়রানি ঠেকাতে তদারকি কর্মকর্তারা সজাগ রয়েছেন।
সংস্কারের সুপারিশ অনুযায়ী, আদালতে অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে মিডিয়ার সামনে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন না করার নির্দেশ কার্যকর করা হয়েছে। মামলা দায়ের, রেকার বিল ও চার্জ–সংক্রান্ত কার্যক্রমে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তদারকি জোরদার করা হয়েছে।
চাকরির ভেরিফিকেশন
সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, চাকরিপ্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা, সনদ বা নম্বরপত্র যাচাইয়ের দায়িত্ব এখন থেকে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের। এটি পুলিশ ভেরিফিকেশনের অংশ হবে না।
পুলিশ জানিয়েছে, সুপারিশ অনুযায়ী রাজনৈতিক মতাদর্শ যাচাইয়ের প্রথাও বাতিল করা হয়েছে। তবে কেউ স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব বা অখণ্ডতার বিরুদ্ধে কার্যক্রমে জড়িত থাকলে কিংবা আদালতে দোষী সাব্যস্ত হলে তা ভেরিফিকেশন প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকবে।
চাকরির জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশন সর্বোচ্চ এক মাসের মধ্যে শেষ করার নির্দেশও অনুসরণ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।
গঠন হয়নি পুলিশ কমিশন
সংস্কারপ্রক্রিয়ার শুরু থেকেই পুলিশের দাবি ছিল—পুলিশে নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা এবং বাহিনীকে কার্যকর স্বায়ত্তশাসন দেওয়া। আর এ জন্য দরকার ছিল একটি স্বাধীন পুলিশ কমিশন। অথচ এখনো সেই কমিশন হয়নি। এতে আশু বাস্তবায়নযোগ্য সংস্কারের সুপারিশসহ অনেকগুলো সংস্কার প্রস্তাবের বাস্তবায়ন আটকে আছে।
অবশ্য আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুলের নেতৃত্বে উপদেষ্টাদের সমন্বয়ে একটি কমিটি এখন পুলিশ কমিশনের কাঠামো ও কার্যক্রমের খসড়া তৈরি করেছে। খসড়ায় প্রস্তাব করা হয়েছে আপিল বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে ৯ সদস্যের একটি স্বশাসিত কমিশন গঠনের। তবে পুলিশের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি আগের মতোই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকবে। কমিশন শুধু এসব বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়ন ও সুপারিশ করবে। তবে এই প্রক্রিয়ায় কমিশন হলে পুলিশ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হতে পারবে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
প্রয়োজন দ্রুত পদক্ষেপ
সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের মূল সংস্কারের জায়গাটি হলো কার্যকর স্বায়ত্তশাসন। এ জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন করা দরকার। এই কমিশন হয়ে গেলে বাকি সংস্কারপ্রক্রিয়াগুলো সহজ হয়ে যাবে।
নুরুল হুদা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের এক বছর পরও স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন হয়নি। এ ক্ষেত্রে সরকারের আন্তরিকতার ঘাটতি দেখা গেছে। এ জন্য সবার আগে নিয়োগ, পদোন্নতি, পদায়নসহ মূল সমস্যাগুলো বিবেচনায় রেখে পুলিশ কমিশন গঠন করতে হবে।