সেই হৃদয় সরকার এখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইন্টার্ন করছেন

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইন্টার্ন করছেন হৃদয় সরকারছবি: সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা দিতে বিজয় একাত্তর হল থেকে মা সীমা রানী সরকারের কোলে চড়ে পরীক্ষার হলে গিয়েছিলেন হৃদয় সরকার। ২০১৮ সালের মা-ছেলের সেই ছবি বেশ সাড়া ফেলেছিল। সেই হৃদয় সরকার এখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইন্টার্ন (শিক্ষানবিশ) করছেন।

১২ মে থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড টেকনোলজি উইংয়ে কাজ করছেন হৃদয়। গতকাল রোববার সন্ধ্যায় কথা হলো হৃদয়ের সঙ্গে। জানালেন, তিন মাসের জন্য তিনি ইন্টার্ন করছেন।

হৃদয় অল্প কিছুদিন হলো কাজ করছেন। তিনি কাজে বেশ দক্ষ। তিনি শারীরিক প্রতিবন্ধী কি না, সেটা বিবেচ্য নয়। তাঁর কোনো সহায়তা প্রয়োজন হলে উইংয়ের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহায়তা করা হবে।
সৈয়দ মুনতাসির মামুন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড টেকনোলজি উইংয়ের মহাপরিচালক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী হৃদয়। ইন্টার্ন চলাকালে বিভাগের পরীক্ষা বা অন্যান্য কাজে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ছুটি নিতে পারবেন তিনি।

রাজধানীর আজিমপুরে থাকেন হৃদয়। বাসা থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিয়মিত যাতায়াত করেন। জানালেন, হুইলচেয়ারে করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির কাছে মেট্রোস্টেশন থেকে মেট্রোতে চড়েন। এরপর সচিবালয় স্টেশনে নামেন। তারপর আবার হুইলচেয়ারে মন্ত্রণালয়ে যান।

হৃদয় বলেন, বাসা থেকে একা ছাড়তে চায় না। তাই শান্ত নামের এক সহায়তাকারী সঙ্গে থাকে। সে–ই মন্ত্রণালয়ের গেট পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। মন্ত্রণালয়ের নতুন ভবনে হুইলচেয়ার নিয়ে যাতায়াতে কোনো সমস্যা হয় না।

২০১৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা দিতে বিজয় একাত্তর হল থেকে মা সীমা রানী সরকারের কোলে চড়ে পরীক্ষার হলে গিয়েছিলেন হৃদয়। মা-ছেলের এই ছবি সে সময় সাড়া ফেলেছিল
ছবি: সংগৃহীত

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো এবার ইন্টার্নশিপ চালু করেছে। লিখিত, মৌখিক পরীক্ষাসহ বিভিন্ন ধাপ পার হয়ে এতে নির্বাচিত হতে হয়, এমনটাই জানালেন হৃদয়।

এ বিষয়ে হৃদয় বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকেই ইচ্ছা ছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাজ করব। এখন ইন্টার্ন করার সুযোগ পেলাম। ফরেন ক্যাডারের মতোই সকাল নয়টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করছি। আমার আশা, এই মন্ত্রণালয়ে নিজের যোগ্যতায় একদিন পূর্ণকালীন চাকরি পাব।’

আরও পড়ুন
সুন্দরবন ঘুরতে গিয়ে শিক্ষক-সহপাঠীর সঙ্গে হৃদয় সরকার
ছবি: সংগৃহীত

ইন্টার্ন হিসেবে এ কয় দিনের কাজের অভিজ্ঞতা কেমন? জানতে চাইলে হৃদয় বললেন, ‘মন্ত্রণালয়ে প্রবেশগম্যতা নিয়ে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে কেউ বাজে ব্যবহার করেন না। কাজে সবার কাছ থেকে সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে।’

হৃদয়ের ছোট ভাই অন্তর সরকার এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেবে। দুই ভাই একসঙ্গে আজিমপুরের ভাড়া বাসায় থাকে। বাবা সমীরণ সরকার ও মা সীমা রানী সরকার থাকেন নেত্রকোনার বাড়িতে। মাঝেমধ্যে ঢাকায় এসে দুই ছেলের সঙ্গেও কিছুদিন থাকেন মা–বাবা।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকেই ইচ্ছা ছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাজ করব। এখন ইন্টার্ন করার সুযোগ পেলাম। ফরেন ক্যাডারের মতোই সকাল নয়টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করছি। আমার আশা, এই মন্ত্রণালয়ে নিজের যোগ্যতায় একদিন পূর্ণকালীন চাকরি পাব।
হৃদয় সরকার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী

শিক্ষানবিশ হৃদয় সরকার ‘বেশ কর্মদক্ষ’ বলে মন্তব্য করলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড টেকনোলজি উইংয়ের মহাপরিচালক সৈয়দ মুনতাসির মামুন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘হৃদয় অল্প কিছুদিন হলো কাজ করছেন। তিনি কাজে বেশ দক্ষ। তিনি শারীরিক প্রতিবন্ধী কি না, সেটা বিবেচ্য নয়। তাঁর কোনো সহায়তা প্রয়োজন হলে উইংয়ের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহায়তা করা হবে।’

আরও পড়ুন

ছোটবেলা থেকে একা হাঁটতে বা চলাফেরা করতে পারেন না হৃদয়। একটি ইলেকট্রিক, আরেকটি ম্যানুয়াল হুইলচেয়ার আছে তাঁর। সেগুলো ব্যবহার করে চলাফেরা করেন। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা জয় করেই তিনি এত দূর এসেছেন। ২০২২ সালে তিনি বিভাগের বন্ধুদের সঙ্গে সুন্দরবন ঘুরতে গিয়েছিলেন।

২০১৮ সালের ২১ সেপ্টেম্বর হৃদয় ও তাঁর মায়ের সেই আলোচিত ছবিটি তুলেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী এম এ আল মামুন। তিনি নিজের ফেসবুকে ওই ছবি পোস্ট করেছিলেন। পরে তা ভাইরাল হয়।

হৃদয় সরকার ও তাঁর মা সীমা রানী সরকার
ছবি: সংগৃহীত

হৃদয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ১২০ দশমিক ৯৬ নম্বর পান। ৩৭৪০তম হন তিনি। প্রতিবন্ধী কোটায় ভর্তির আবেদন করেছিলেন হৃদয়। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবন্ধী কোটার বিধিমালা অনুযায়ী, শুধু দৃষ্টি, শ্রবণ ও বাক্‌প্রতিবন্ধীদের জন্য এই কোটা প্রযোজ্য ছিল। ফলে হৃদয়ের ভর্তি নিয়ে তৈরি হয় অনিশ্চয়তা।

এরপর প্রথম আলোসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম হৃদয়ের ভর্তির অনিশ্চয়তার বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ভর্তির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী কোটার বিধিমালায় সংস্কার আনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। শারীরিক প্রতিবন্ধীদেরও যুক্ত করা হয়। এর মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পান হৃদয়।

একই বছরের নভেম্বরে হৃদয়ের লড়াকু মা সীমা রানী সরকার বিবিসির ১০০ প্রভাবশালী নারীর তালিকায় জায়গা পান।

আরও পড়ুন