এলএনজি সরবরাহ শুরু, তবে লোডশেডিং এখনই কমছে না

ফাইল ছবি

টানা তিন দিন বন্ধ থাকার পর আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহ আংশিকভাবে শুরু হয়েছে। এতে সার্বিক গ্যাস সরবরাহ কিছুটা বেড়েছে। চট্টগ্রামেও গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়েছে। তবে গতকাল সোমবারও অনেক সিএনজি ফিলিং স্টেশন যানবাহনে গ্যাস দিতে পারেনি।

গ্যাসের অভাবে ভুগছে শিল্পকারখানা। বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস সরবরাহ বাড়েনি। এ কারণে লোডশেডিং পরিস্থিতিরও উন্নতি নেই।

বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) তথ্য বলছে, দিনে গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৪০০ কোটি ঘনফুট। সর্বোচ্চ সরবরাহ করা হয় গড়ে ২৮০ থেকে ২৮৫ কোটি ঘনফুট। আর গতকাল সকালে সরবরাহ করা হয় ২১৭ কোটি ঘনফুট। দুপুরের আগে সামিটের ভাসমান টার্মিনাল থেকে ২৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়।

বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি করে মহেশখালীর ভাসমান টার্মিনালের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়। পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, সমুদ্রে ভাসমান দুটি টার্মিনালের একটি পরিচালনা করে মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জি। আরেকটি পরিচালনা করে সামিট গ্রুপ। ঘূর্ণিঝড় মোখার কারণে গত শুক্রবার রাত ১১টায় ভাসমান দুটি এলএনজি টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করা হয়। এরপর এক্সিলারেট তাদের টার্মিনালটি গভীর সমুদ্রে সরিয়ে নেয়। এটি ফিরতে শুরু করেছে। আবার চালু করতে দুই সপ্তাহ লাগতে পারে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পেট্রোবাংলার একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, মহেশখালীতে এখন একটি এলএনজিবাহী জাহাজ আছে। এটি থেকে আপাতত সরবরাহ আর বাড়ানো যাবে না। ১৮ মে এলএনজি নিয়ে নতুন একটি জাহাজ আসার কথা রয়েছে। এরপর সরবরাহ বাড়বে। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে দিনে গ্যাসের চাহিদা ২১৭ কোটি ঘনফুট। গতকাল সরবরাহ করা হয়েছে ৮০ কোটি ঘনফুটের কম। গত সপ্তাহেও এ খাতে সরবরাহ করা হয় ১১১ কোটি ঘনফুট।

আরও পড়ুন

তবে একদিন পুরোপুরি বন্ধ থাকার পর গতকাল চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ শুরু করেছে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, দিনে তাঁদের চাহিদা ৩০ কোটি ঘনফুট। গতকাল গ্যাস সরবরাহ চালু হয়েছে। ১৫ কোটি ঘনফুট করে পাওয়া যাচ্ছে। এতে আবাসিক, বাণিজ্যিক ও কিছু শিল্প গ্রাহক গ্যাস পাচ্ছেন। তবে বিদ্যুৎ ও ভারী শিল্পে সরবরাহ শুরু হয়নি।

ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, ময়মনসিংহ এলাকায় গ্যাস সরবরাহ করে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। তারা বলছে, গ্যাস সরবরাহ নিয়ে গত তিন ধরেই তিতাসের অভিযোগ কেন্দ্রে ফোন করছেন বিভিন্ন এলাকার গ্রাহকেরা। আবার কোনো কোনো এলাকায় গ্যাস থাকলেও চাপ কমে যাওয়ায় রান্না করা মুশকিল হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় সিএনজি স্টেশনও গ্যাস পাচ্ছে না।

সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত সিএনজি স্টেশনে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকে। তাই সকাল থেকেই সিএনজি নিতে স্টেশনে যায় যানবাহন। গতকাল সকাল থেকেই ঢাকার বিভিন্ন সিএনজি স্টেশনে যানবাহনের ভিড় দেখা গেছে। কোনো কোনো স্টেশনে গ্যাসের চাপ না থাকায় ‘গ্যাস নাই’ লিখে ব্যানার ঝুলিয়ে দিয়েছে। সিএনজি স্টেশন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফারহান নূর প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাসের চাপ কম। শিল্প এলাকার সিএনজি স্টেশন গ্যাস পাচ্ছে। শহরের মধ্যে অধিকাংশ স্টেশন সিএনজি দিতে পারছে না।

আরও পড়ুন

দিনে লোডশেডিং ৫ ঘণ্টা

গ্যাসের অভাবে চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা অঞ্চলের গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করতে পারেনি বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে দিনে সাড়ে ছয় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হলেও এখন তা সাড়ে চার হাজার মেগাওয়াটে নেমে গেছে। দিনে তিন হাজার মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং করতে হচ্ছে। ঢাকাতেও আগের দিনের চেয়ে গতকাল লোডশেডিং বেড়েছে।

বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) বলছে, গতকাল দিনে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে দুপুর ১২টায় ৯ হাজার ৯৮৪ মেগাওয়াট। ওই সময় লোডশেডিং হয়েছে ২ হাজার ১১৬ মেগাওয়াট। এর আগে গত শনিবার রাতে বিভিন্ন সময় আড়াই থেকে তিন হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং করতে হয়েছে।

গ্যাস–সংকটের কারণে সিএনজি স্টেশনগুলোতে গাড়ির দীর্ঘ লাইন। গতকাল বেলা সাড়ে তিনটায় ঢাকা–নারায়ণগঞ্জ মহাসড়কের শনির আখড়ায়
ছবি: দীপু মালাকার

দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) দিনে দুই হাজার মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং করছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ বিভাগের অধিকাংশ গ্রাম এলাকায় গড়ে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। খুলনা, সিলেট, রংপুর ও ময়মনসিংহে বিদ্যুৎ বিতরণকারী কোম্পানি ও স্থানীয় গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত কয়েক দিনে কোথাও কোথাও লোডশেডিং বেড়েছে।

ঢাকায়ও গতকাল গড়ে পাঁচ ঘণ্টা লোডশেডিং করেছে দুই বিতরণ সংস্থা ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো) ও ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি)। ডেসকো বলছে, গতকাল বেলা তিনটায় তাদের চাহিদা ছিল ১ হাজার ১২০ মেগাওয়াট। এ সময় সরবরাহ করা হয়েছে ৮১২ মেগাওয়াট। ৯৭টি ফিডার (নির্দিষ্ট এলাকায় একটি ফিডার থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়) বন্ধ রেখে ৩০৮ মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হয়।

সিদ্ধিরগঞ্জ, আশুগঞ্জ, হরিপুর, ঘোড়াশালের গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখা হচ্ছে। গ্যাসের চাপ কম থাকায় এগুলো চালানো যাচ্ছে না। কয়লার অভাবে গত ২৪ এপ্রিল থেকে বন্ধ আছে বাগেরহাটের রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র।

ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমির কাউসার আলী প্রথম আলোকে বলেন, সরবরাহ কমায় গত রোববারের চেয়ে গতকাল পরিস্থিতি একটু খারাপ হয়েছে।

ডিপিডিসি বলছে, বেলা তিনটার দিকে তারা বিদ্যুৎ সরবরাহ পেয়েছে ১ হাজার ২৬১ মেগাওয়াট। একই সময়ে তাদের চাহিদা ছিল ১ হাজার ৭১৪ মেগাওয়াট। লোডশেডিং করে বাকি ৪৫৩ মেগাওয়াট ঘাটতি সমন্বয় করা হয়েছে। ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, বেশির ভাগ এলাকায় দিনে তিন ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। কোথাও কোথাও একটু বেশি হতে পারে।

আরও পড়ুন

এখনই লোডশেডিং কমবে না

পিডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহের একটি বড় অংশ আসে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে। সিদ্ধিরগঞ্জ, আশুগঞ্জ, হরিপুর, ঘোড়াশালের গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখা হচ্ছে। গ্যাসের চাপ কম থাকায় এগুলো চালানো যাচ্ছে না। কয়লার অভাবে গত ২৪ এপ্রিল থেকে বন্ধ আছে বাগেরহাটের রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র। আগামী তিন দিনে গ্যাস সরবরাহ তেমন বাড়বে বলে মনে হচ্ছে না। তবে আজ মঙ্গলবার রামপাল উৎপাদন শুরু করতে পারে। এতে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হতে পারে।

পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) এস এম ওয়াজেদ আলী সরদার গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করার মতো গ্যাস সরবরাহ চট্টগ্রামে শুরু হয়নি। তাই বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না। চাহিদা ও উৎপাদনের ঘাটতি সমন্বয়ে আরও সময় লাগবে।