আত্মীয়স্বজন বলতেন, ‘এই মেয়ে কোনো কাজে আসবে না, ডাস্টবিনে ফেলে দাও’

সেরিব্রাল পালসির সঙ্গে বসবাস সর্মি রায়ের। তবে থেমে নেই তিনি। ঘরোয়া পরিবেশে তৈরি খাবার বিক্রি করেন তিনি
ছবি: প্রথম আলো

জন্মের পর থেকেই শিশুটি তেমন একটা নড়াচড়া করত না। একপর্যায়ে সে টুকটাক কথা বলতে শুরু করে। তবে তার নড়াচড়া ছিল আগের মতোই একেবারে অল্প। সবাই বলত, ‘শান্ত বাচ্চা’।

দুই বছর বয়সের পর মা–বাবার সন্দেহ হয়। তাঁরা শিশুটিকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় শনাক্ত হয়, শিশুটি ‘সেরিব্রাল পালসি’ নামের রোগে আক্রান্ত।

শিশু সর্মি রায়ের চিকিৎসা নিয়ে শুরু হয় বাবা সুশীল কুমার রায় ও মা শেফালি রানি রায়ের লড়াই-সংগ্রাম। পাশাপাশি তাঁদের প্রতিকূল পারিপার্শ্বিকতা, আশপাশের মানুষের কটু কথার সঙ্গেও লড়তে হয়। সর্মি বড় হয়ে মা–বাবার কাছ থেকে তা শুনেছেন। সেসব ঘটনা স্মরণ করে তিনি বলেন, আত্মীয়স্বজনের মধ্যে কেউ কেউ তাঁর মা–বাবাকে এমন কথাও বলেছিলেন, ‘এই মেয়ে কোনো কাজে আসবে না, ডাস্টবিনে ফেলে দাও।’

আরও পড়ুন

সর্মির বয়স এখন ৩৫ বছর। তাঁর বাবা ১৩ বছর আগে মারা যান। সর্মির দুই বোন আছেন। তাঁদের আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। এক বোন রাজধানীর মিরপুরের একটা স্কুলের শিক্ষক। আরেকজন থাকেন ভারতের কলকাতায়।

রাজধানীর পূর্ব রামপুরায় মাকে নিয়ে থাকেন সর্মি। তিনি ঘরোয়া পরিবেশে তৈরি করা খাবার বিক্রি করেন।

গত সোমবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ের রোলিং মিলের মোড়ে বটগাছের নিচে ভ্যানে দুপুরের খাবার নিয়ে বিক্রির জন্য ক্রেতার অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিলেন সর্মি। ভ্যানের পাশে তাঁর স্টিলের ওয়াকার। ভ্যানের সামনে থাকা ব্যানারে লেখা—পিসিপিএফ। প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংগঠন।

সর্মির সঙ্গে সেখানেই কথা হয়। ঝিরঝির করে বৃষ্টি ঝরছিল। বটগাছের ঘন ডাল-পাতা গলে বৃষ্টির পানি ভিজিয়ে দিচ্ছিল সর্মিকে। তাঁকে বেশ উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল। তাঁর এই উদ্বেগের কারণ বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়ার জন্য নয়। বৃষ্টির কারণে ক্রেতা আসছে না। তাই তখন পর্যন্ত কোনো খাবার বিক্রি করতে পারেননি তিনি। খাবার বিক্রি না হওয়ার ক্ষতি নিয়ে ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছিলেন তিনি।

অবশ্য এমন অভিজ্ঞতা সর্মির জন্য নতুন কিছু নয়। নানা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত লড়াই-সংগ্রাম করে দিন কাটে তাঁর। সর্মির ভাষ্যমতে, পাটিগণিতের তৈলাক্ত বাঁশের বানরের মতো এক ধাপ এগোন, তো দুই ধাপ পিছিয়ে পড়েন। তবু লড়ে যান তিনি।

সেরিব্রাল পালসির সঙ্গে বসবাস করা সর্মি প্রথম আলোর এই প্রতিবেদককে শোনালেন নিজের লড়াই-সংগ্রামের গল্প।

আরও পড়ুন

সেরিব্রাল পালসি কী

যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের (এনএইচএস) তথ্যমতে, সেরিব্রাল পালসি (সিপি) মস্তিষ্কের ক্ষতি বা মস্তিষ্কের অস্বাভাবিক বিকাশের ফলে সৃষ্ট স্নায়বিক অবস্থার একটি ধরন। গর্ভে থাকাকালে, জন্মের সময়, জন্মের পর ও বেড়ে ওঠার পর্যায়ে মস্তিষ্কে ক্ষতি হলে, কোনো সংক্রমণ হলে সেরিব্রাল পালসি দেখা দেয়।

সেরিব্রাল পালসির কারণে চলাচলে কষ্ট হয়। শরীরে ভারসাম্য থাকে না। অনেকে হাঁটতেই পারে না।

খাওয়াদাওয়ায় কষ্ট হয়। অনেকে চোখে কম দেখেন। শরীরে ব্যথা অনুভূত হয়। অবসাদ দেখা দেয়। ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে। মুখ দিয়ে লালা ঝরতে পারে। মাংসপেশি ও হাড়ে জড়তা দেখা দেয়।

চিকিৎসকদের ভাষ্যমতে, বেশির ভাগ শিশুর সেরিব্রাল পালসি শনাক্ত হয় জন্মের দুই বছর বয়সের মধ্যে। সেরিব্রাল পালসি হলে তার ভার সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হয়। তাই আক্রান্ত ব্যক্তিকে আজীবন খাপ খাইয়ে চলতে হয়। চিকিৎসাসহ থেরাপি নিতে হয়। তাঁদের শারীরিক-মানসিক সহায়তার প্রয়োজন হয়।

আরও পড়ুন

জন্ম থেকে লড়াই

সর্মিদের গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরে। রাজধানীর চানখাঁরপুলে তাঁর বাবা সুশীল কুমার রায়ের তারের দোকান ছিল। সেই সুবাদে স্ত্রী ও তিন মেয়েকে নিয়ে তিনি চানখাঁরপুল এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন।

তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট সর্মি। দুই বছর বয়সে তার সেরিব্রাল পালসি ধরা পড়ে। তারপর তাকে রাজধানীর তোপখানার একটি শিশু প্রতিবন্ধী হাসপাতালে থেরাপির জন্য নিয়মিত নিয়ে যেতেন মা শেফালি।

সর্মি বলেন, চিকিৎসক বলেছিলেন, এটা (সেরিব্রাল পালসি) এখন তাঁর জীবনের অংশ। তিনি যত দিন বেঁচে থাকবেন, থেরাপি নিতে হবে। সেরিব্রাল পালসির জন্য কাউকে দায়ী করা যায় না বলে চিকিৎসকই বলেছেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, সবাই একতরফাভাবে তাঁর মায়ের ওপর দোষ চাপাত। এ কারণে তাঁর মাকেও নানান কটু কথা শুনতে হয়েছে।

১৯৯৭ সালে সর্মিকে ভর্তি করা হয় সাভারের পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে (সিআরপি)। মাসে ফি ছিল দুই হাজার টাকা। বেশ কিছুদিন পর সিআরপির বিশেষজ্ঞরা বললেন, সর্মিকে সাধারণ স্কুলে পড়ানো উচিত। পরে সাভারের রেডিও কলোনি স্কুলে ভর্তি করা হয় তাঁকে। সিআরপির আয়া স্কুল থেকে তাকে আনা-নেওয়া করতেন।

পড়ালেখা সম্পর্কে বলতে গিয়ে সর্মি বলেন, ‘লেখার ক্ষেত্রে আমি খুবই ধীর ছিলাম। তাই পরীক্ষায় নম্বর কম পেতাম।’

তবে সর্মির পড়াশোনা বেশি দূর এগোয়নি। বাবার অসুস্থতাসহ ব্যবসায় ধসের কারণে ২০০১ সালে অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হয়। সর্মি বলেন, বাড়িতে ফেরার পর তিনি চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী হয়ে পড়েন। নিজেকে বোঝা মনে হতে থাকে।

আরও পড়ুন

‘অহনা রন্ধনশালা’

২০১০ সালে সর্মির বাবার মৃত্যু হয়। তারপর আত্মীয়স্বজন আর এই পরিবারের খোঁজ নেয়নি। সর্মির বাবার দোকানও বন্ধ হয়ে যায়। তা ছাড়া পৈতৃক সম্পত্তির ভাগও পাননি তিনি। ফলে অনটনে পড়েন মা-মেয়ে। সর্মি বলেন, সে সময় বাবার এক বন্ধু পাশে এসে দাঁড়ান।

রাজধানীর শেওড়াপাড়ায় সর্মির বাবার বন্ধু ইমতিয়াজ আলম খানের আইপিএসের কারখানা ছিল।

২০০৯ সালে গ্রাফিক ডিজাইনের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন সর্মি। বাবার মৃত্যুর পর ইমতিয়াজ তাঁর কারখানায় সর্মিকে গ্রাফিক ডিজাইনার পদে চাকরি দেন। কারখানার ভেতরে একটি বাসায় মা-মেয়েকে বিনা মূল্যে থাকার ব্যবস্থা করেন তিনি। তবে করোনার কারণে কারখানাটি বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ে। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে চাকরিটা ছেড়ে দেন সর্মি।

২০১৬ সালে নিজের মতো ব্যক্তিদের নিয়ে ‘পারসন্স উইথ সেরিব্রাল পালসি ফাউন্ডেশন’ (পিসিপিএফ) গড়ে তুলেছিলেন সর্মি। এই ফাউন্ডেশনে বাংলাদেশ রেলওয়ের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক আফসান চৌধুরীর মতো কয়েক ব্যক্তি দান করেন।

২০২১ সালে ‘অহনা রন্ধনশালা’ নামের খাবারের অর্ডার নেওয়ার উদ্যোগ গড়ে তোলেন সর্মি।

ফাউন্ডেশনে আসা দানের অর্থসহ সর্মির মতো সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত কয়েকজনের ব্যক্তিগত টাকায় রন্ধনশালাটি পরিচালিত হয়।

চাকরি ছাড়ার পর টিকে থাকার তাগিদে এই রন্ধনশালা নিয়েই জোরেশোরে অগ্রসর হন সর্মি। রন্ধনশালার জন্য পশ্চিম রামপুরায় একটি স্থান ভাড়া নেওয়া হয়। সেখানে রান্নার কাজ চলে। কাজের জন্য আছেন চারজন সহকারী।

‘অহনা রন্ধনশালা’ থেকে একটি বেসরকারি ব্যাংকে দুপুরের খাবার দেন সর্মি। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অনুমতি নিয়ে সন্ধ্যায় রামপুরা ব্রিজের পাশে ভ্যানে করে নুডলস, পাস্তা ইত্যাদি বিক্রি করেন তিনি।

সপ্তাহখানেক ধরে তেজগাঁওয়ে একই ভ্যানে করে ৫০ থেকে ৭৫ টাকায় দুপুরের খাবার—ভাত, ডিম, খিচুড়ি, মুরগির মাংস, মুরগির তেহারি বিক্রি করে আসছেন সর্মি।

প্রতিদিন ভ্যানে করে খাবার বিক্রির সময় নিজে দাঁড়িয়ে থাকেন কি না, জানতে চাইলে সর্মি বলেন, তাঁকে স্টিলের ওয়াকার নিয়ে হাঁটতে হয়। বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারেন না। এ কারণে সব সময় ভ্যানের কাছে তিনি থাকেন না। এ জন্য সহকারী রেখেছেন। যে বেসরকারি ব্যাংকে দুপুরের খাবার সরবরাহ করেন, বেশির ভাগ সময় তিনি সেখানে উপস্থিত থাকেন।

তবে এত কষ্ট করেও সর্মিদের আয় খুব বেশি হয় না। খরচ সামলে উঠতে হিমশিম খেতে হয়। এর মধ্যে ফাউন্ডেশন নিয়েও ভাবতে হয়। খাবার বিক্রির আয় দিয়ে নিজেরা চলার পাশাপাশি ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থান করতে চান সর্মিরা; চান অন্য কার্যক্রম চালাতে।

ফাউন্ডেশন ও অহনা রন্ধনশালার সঙ্গে যুক্ত আরেক তরুণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে সর্মির সঙ্গে এই প্রতিবেদকের আলাপচারিতা শুনছিলেন। এই তরুণের দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ। দিন দিন তা আরও কমে যাচ্ছে। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ করেছেন। বললেন, একজন দক্ষ শ্রুতলেখকের অভাবে সরকারি চাকরি পাননি। এখন ফ্রিল্যান্সিংও করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই তরুণ বলেন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দুপুরের খাবারের অর্ডারের জন্য গেলে তাঁদের অনেক সময় ফিরিয়ে দেওয়া হয়। কারণ, তাঁদের রান্নার জায়গাটি ছোট। যাদের বড় পরিসরের রান্নার ব্যবস্থা আছে, তাদের অর্ডার দেন অনেকে। সুযোগ পেলে তাঁরা যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েই অহনা রন্ধনশালাকে দাঁড় করাতে পারবেন।

সর্মি বলেন, তাঁরা প্রত্যেকেই কিছু না কিছু করতে চান। সরকার যদি তাঁদের খাবার বিক্রি করার জন্য অন্তত একটু জায়গার ব্যবস্থা করে দিত, তাহলে চলার পথটা কিছুটা সহজ হতো। তাঁরা কারও বোঝা হয়ে থাকতে চান না। তাঁদের লড়াইয়ে দরকার একটু সহায়তা। এই সহায়তাই তাঁদের জন্য অনেক বড় কিছু হয়ে আসবে বলে তাঁর বিশ্বাস।