ভূমিকম্পের সময় নবজাতকদের যেভাবে আগলে রেখেছিলেন এই চিকিৎসক ও নার্সরা

ভূমিকম্পের সময় হাসপাতালে শিশুদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে নবজাতকদের ধরে রাখেন চিকিৎসক ইব্রাহীম সরদার এবং নার্স নিপা বিশ্বাস ও মুক্তা আক্তারছবি: ভিডিও ফুটেজ থেকে নেওয়া

শুক্রবারের ভূমিকম্পে তীব্র ঝাঁকুনিতে কেঁপে ওঠে ঢাকা শহর। আতঙ্কে যে যে অবস্থায় ছিলেন সেখান থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশে ছুটে গেছেন। আবার কেউ কেউ ঘরেই রয়ে গেছেন, কারণ ঢাকায় খোলা জায়গা কোথায়, যেখানে নিরাপদ আশ্রয় নেওয়া যায়! এই ভূমিকম্পের সময়কার ভিডিও ফুটেজের পাশাপাশি নানা মানুষের অনুভূতির কথায় এখন সয়লাব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। এর মধ্যে নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে একজন চিকিৎসক ও দুজন নার্স নবজাতকদের পাশে যেভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই ভিডিও এখন ভাইরাল।

সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, ভূমিকম্পে কাঁপছে চারপাশ। চিকিৎসক ইব্রাহীম সরদার এক নবজাতককে দুই হাত দিয়ে ধরে রেখেছেন। আরেকজন নার্সও দৌড়ে গিয়ে আরেক নবজাতককে ধরেন। ঘটনাটি রাজধানীর শ্যামলীর ডক্টরস কেয়ার হাসপাতালের।

শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিট ২৬ সেকেন্ডে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এটিকে কম্পনের তীব্রতার দিক থেকে স্মরণকালের নজিরবিহীন বলছেন ভূমিকম্প-বিশেষজ্ঞরা। নরসিংদীর মাধবদীতে ছিল ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল। এ ভূমিকম্পকে ঝুঁকির মাত্রা অনুযায়ী কমলা শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করেছে মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস। এর মানে হলো এমন ভূমিকম্পে উল্লেখযোগ্য প্রাণহানির আশঙ্কা থাকে। সৌভাগ্যবশত সেই বড় ধরনের প্রাণহানির ঘটনা না ঘটলেও শক্তিশালী কম্পন ঢাকাবাসী কাঁপিয়ে দিয়ে গেছে। সবাই ক্ষণিকের জন্য হলেও মৃত্যুর ভয় পেয়েছেন। এই মানুষদের তালিকায় ছিলেন চিকিৎসক ইব্রাহীমও থাকলেও তিনি নিজের জীবনের চেয়ে দায়িত্বকে এগিয়ে রেখেছেন।

শুক্রবার তিনি নিজে এবং তাঁর সঙ্গে দায়িত্বে থাকা দুই নার্স যে কাজটি করেছিলেন, দায়িত্বরত অবস্থায় বেশির ভাগ চিকিৎসকই এমন করেছেন বা করতেন বলে উল্লেখ করেন ইব্রাহীম সরদার।

গতকাল শনিবার বিকেলে কথা হলো ইব্রাহীম সরদারের সঙ্গে। তিনি হাসপাতাল থেকে পাওয়া সিসিটিভি ফুটেজটি ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেন গতকাল। তারপর থেকে তিনি ফেসবুকে এবং ব্যক্তিগতভাবে মানুষের শুভকামনায় ভাসছেন।

আরও পড়ুন

সবাই যখন নিজের প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন, আপনি তা না করে কেন নবজাতককে জড়িয়ে ধরে ছিলেন—জানতে চাইলে ইব্রাহীম সরদার টেলিফোনে বললেন, ‘আমি হাসপাতালটিতে শিশুদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (এনআইসিইউ) মেডিকেল অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। অন্য সময়ও চোখের সামনে বাচ্চাদের মৃত্যু দেখি। গতকাল মনে হয়েছে, আমি মারা গেলে তো মারা গেলাম, বাচ্চাগুলো তো বাঁচবে।’

ইব্রাহীম সরদার
ছবি: ইব্রাহীম সরদারের সৌজন্যে

হাসপাতালটির এনআইসিইউতে তখন তিনটি নবজাতক এবং চার বছরের কম বয়সী চারটি শিশু ভর্তি ছিল। ইব্রাহীম সরদার জানালেন, তিনি যে নবজাতককে ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন হাসপাতালের নথিতে মায়ের নাম অনুযায়ী তার নাম ‘বেবি অব সায়মা’। বয়স ছিল মাত্র ৭ দিন। জন্মের পর কান্না না করা, শ্বাসকষ্ট, খিঁচুনিসহ নানা জটিলতা রয়েছে তার।

ইব্রাহীম বললেন, ‘আমার মোবাইলে অ্যাপের মাধ্যমে ভূমিকম্পের আগাম সতর্কতা হিসেবে অ্যালার্ম সেট করা আছে। ভূমিকম্প শুরুর ২-৩ সেকেন্ড আগে অ্যালার্ম বাজলে আমি বসা থেকে দাঁড়িয়ে যাই। কাঁপুনি বাড়লে আমি একজনকে ধরি। দায়িত্বে থাকা নার্স নিপা বিশ্বাস এবং মুক্তা আক্তারও অন্য দুই নবজাতকের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। সিসিটিভিতে অবশ্য একজন নার্সকে দেখা যাচ্ছে।’

আরও পড়ুন

চিকিৎসক ইব্রাহীম সরদার বলেন, ‘আমি বা আমার সঙ্গে থাকা নার্সরা সেই সময় নিজেদের মৃত্যুর চিন্তা করি নাই। শুধু মনে হয়েছে, নবজাতকদের মাথা বা শরীরের ওপর কিছু পড়তে পারে। যেকোনোভাবে হোক ওদের নিরাপদ রাখার চেষ্টা করেছি। ঘটনার পর আমি নিজে দুই নার্সকে এই ভালো কাজের জন্য ট্রিট দিয়েছি।’

ফেসবুকে খুব একটা সরব নন ইব্রাহীম সরদার। তিনি বললেন, ‘আমি ফেসবুকে আলোচিত কেউ না। আমার এ পোস্ট আলোচনার জন্ম দেবে, তা-ও বুঝতে পারিনি। হাসপাতালের ব্যবস্থাপক হাবিবুর রহমান সিসিটিভির ফুটেজটি দেন। হাসপাতালের দুজন ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের একজন চিকিৎসক ফজলে রাব্বি বর্তমানে দেশের বাইরে আছেন। তিনি আমার মেডিকেল কলেজের বড় ভাই। ফজলে রাব্বিকে ট্যাগ করে সিসিটিভি ফুটেজটি ফেসবুকে শেয়ার দিয়েছিলাম।’

আরও পড়ুন

শুক্রবার এই হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করেন ইব্রাহীম সরদার। শনিবার সকালে বাসায় ফেরেন। বিকেলে কথা বলেন প্রথম আলোর সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘ফেসবুকে আমার পোস্টটি আলোচনায় এসেছে, তা এখন বুঝতে পারছি। অনেকেই ফোন দিয়েছেন, ফেসবুকে মন্তব্য করার পাশাপাশি আমার পোস্ট শেয়ার করেছেন। অনেকে ফোন করছেন।’

৪৮তম বিসিএসে সুপারিশপ্রাপ্ত ইব্রাহীম সরদার বলেন, ‘ভূমিকম্পের পর আমার বড় বোন ফোন দিয়ে বাসায় চলে যেতে বলেছিলেন। তাঁকেও বলেছি মারা গেলে তো যেকোনো জায়গাতেই মারা যেতে পারি। বাসায় যাওয়ার পথে বা বাসায় গিয়েও মারা যেতে পারি।’

ভূমিকম্পের সময় হাসপাতালে শিশুদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে নবজাতকদের ধরে রাখেন চিকিৎসক ইব্রাহীম সরদার এবং নার্স নিপা বিশ্বাস ও মুক্তা আক্তার
ছবি: ভিডিও ফুটেজ থেকে নেওয়া

ইব্রাহীম সরদার জানালেন, গতকাল হাসপাতালটিতে ভূমিকম্পের পর এনআইসিইউতে ভর্তি থাকা সন্তানদের অভিভাবকেরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। সবাই তাঁদের সন্তানকে একনজর দেখতে চান। অন্যদিন নির্দিষ্ট সময় ছাড়া সে সুযোগ না পেলেও শুক্রবার অভিভাবকদের গাউন পরিয়ে ভেতরে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হয় এবং একটু বেশি সময় যাতে সন্তানের পাশে থাকতে পারেন, সে সুযোগও দেওয়া হয়। তিনি বললেন, অভিভাবকদের অনেকেই ভূমিকম্পের পর ভবনটি (২০ তলা ভবনের চারতলায় হাসপাতাল) যদি ধসে পড়ে সে ভয়ে সন্তানকে বাড়ি নিয়ে যাবেন বলতে থাকেন। ফলে কাউন্সেলিংও করতে হয়।

শুক্রবার তিনি নিজে এবং তাঁর সঙ্গে দায়িত্বে থাকা দুই নার্স যে কাজটি করেছিলেন দায়িত্বরত অবস্থায় বেশির ভাগ চিকিৎসকই এমন করেছেন বা করতেন বলে উল্লেখ করেন ইব্রাহীম সরদার। তিনি বলেন, ‘আমাদের সব সময়ই নানান চাপ মোকাবিলা করেই দায়িত্ব পালন করতে হয়। আমার পোস্টটি ফেসবুকে আলোচনায় এসেছে বলে অনেকেই আমার কথা বলছেন। আসলে এমন পরিস্থিতিতে থাকা সবাইকেই ধন্যবাদ দিতে হবে।’

আরও পড়ুন

‘বেবি অব সায়মা’র মায়ের নাম সিনথিয়া ইসলাম সায়মা। সন্তান জন্ম দেওয়ার পর থেকে তিনি নিজেও অসুস্থ। তাঁকে ঢাকায় আনা হয়নি, নরসিংদীতে বাড়িতে আছেন বলে জানান স্বামী ফাহাদ শাকিব। তিনি টেলিফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ভূমিকম্পের সময় তিনি হাসপাতালের বাইরে ছিলেন। তিনি বললেন, ‘হাসপাতালে আসার পর শুনি এক ডাক্তার আমার বাচ্চাকে ধইরা ছিলেন। এইটা শোনার পর কেমন যে লাগছে, তা ভাষায় বোঝাতে পারব না। মন থেকে ডাক্তারের জন্য দোয়া করছি।’

ইব্রাহীম সরদার সিসিটিভি ফুটেজটি শেয়ার করে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আজকের ভূমিকম্পটা মনে করিয়ে দিল—আমরা যারা হেলথকেয়ারে কাজ করি, আমাদের দায়িত্ব কখনো থেমে থাকে না। কম্পন শুরু হতেই অনেকে দৌড়াচ্ছিল বাইরে, কিন্তু আমি একজন ডাক্তার হিসেবে আর আমার সঙ্গে থাকা নার্সরা সবাই মিলে বাচ্চাগুলোকে শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সিস্টেম নড়ছে, বিল্ডিং কাঁপছে, কিন্তু আমাদের হাতের ছোট্ট জীবনটা যেন নিরাপদ থাকে—এই চিন্তা ছাড়া আর কিছু মাথায় আসেনি। হয়তো এইটাই আমাদের পেশার সবচেয়ে বড় শিক্ষা—নিজের ভয়কে পেছনে রেখে অন্যের জীবনকে সামনে রাখা। আজ আবার বুঝলাম হেলথকেয়ার শুধু চাকরি নয়—এটা এক প্রতিশ্রুতি। সবাই নিরাপদে থাকবেন। প্রার্থনা সবার জন্য।’