প্রথমটির কাজ হয়েছে মাত্র ৩০%, এরপরও ৫ প্রকল্প চট্টগ্রাম ওয়াসার

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকল্পের অগ্রগতি ৩০ শতাংশ হওয়ার বিষয়টি সন্তোষজনক নয়। এ বিষয়ে ওয়াসাকে জবাবদিহির মধ্যে আনা উচিত।

পয়োনিষ্কাশন প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে বেশ ধীরগতিতে। সম্প্রতি চট্টগ্রামের হালিশহরে
ছবি: প্রথম আলো

নগরবাসীকে দূষণ থেকে রক্ষায় পয়োনিষ্কাশন প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। প্রথম প্রকল্পের নির্ধারিত মেয়াদ গত জুনে শেষ হলেও কাজ হয়েছে মাত্র ৩০ শতাংশ। প্রথম প্রকল্প শেষ না করেই একই ধরনের আরও পাঁচটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে ওয়াসা।

এর মধ্যে প্রথম প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়ানো হয়েছে। বর্ধিত সময়েও সংস্থাটি বাকি কাজ সম্পন্ন করতে পারবে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। সংস্থাটির প্রকৌশলীরাও বলছেন একই কথা। তাঁদের মতে, বর্তমানে কাজের যে গতি, তাতে কাজ শেষ করতে অন্তত তিন বছর সময় লাগবে।

নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে না পারার জন্য করোনা মহামারিকে দায়ী করেছেন ওয়াসার প্রকৌশলীরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) তৈরিতেই গলদ ছিল। এখন কাজে দেরির কারণে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। তবে কত টাকা বাড়ছে, তা চূড়ান্ত হয়নি। ৩ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা ব্যয়ে সরকারি ও ওয়াসার নিজস্ব তহবিলে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। ওয়াসা দিচ্ছে ৫০ কোটি টাকা।

চট্টগ্রাম নগরকে দূষণের কবল থেকে বাঁচাতে পয়োনিষ্কাশন প্রকল্পটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সংস্থাটির এ উদ্যোগ নিয়ে নাগরিকেরা আশাবাদী ছিলেন; কিন্তু প্রকল্পের অগ্রগতি ৩০ শতাংশ হওয়ার বিষয়টি সন্তোষজনক নয়। এ বিষয়ে ওয়াসাকে জবাবদিহির মধ্যে আনা উচিত সরকারের।
মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান, বিভাগীয় প্রধান, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, চুয়েট

২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) ‘চট্টগ্রাম মহানগরের পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। প্রকল্পের ডিপিপিতে বলা হয়, ২০২৩ সালের মধ্যে চট্টগ্রামে পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা তৈরি হবে; কিন্তু সেটি হয়নি। প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিতেই এক বছর সময় পার করে দেয় সংস্থাটি। ২০১৯ সালের ৪ নভেম্বরে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া হয়। ঠিকাদার নিয়োগে দরপত্র আহ্বান করা হয় ২০২০ সালের অক্টোবরে। এ ছাড়া ২০২২ সালের জানুয়ারিতে দক্ষিণ কোরিয়ার তাইয়ং ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডকে ঠিকাদার হিসেবে নিয়োগ দেয় ওয়াসা। ওই মাসেই অর্থাৎ অনুমোদনের প্রায় তিন বছর পর কাজ শুরু হয়।

ওয়াসা করোনার অজুহাত দিলেও মহামারিকালে চট্টগ্রামে বড় কয়েকটি প্রকল্পের কাজ চলেছে। এর মধ্যে আছে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের নির্মাণকাজ। বর্তমানে কাজটির প্রায় ৯৮ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইনের নির্মাণকাজও করোনাকালে চলেছে।

কাজ শুরু দেরিতে, গতিও কম

প্রকল্পের নথিতে বলা হয়, দৈনিক ১০ কোটি লিটার পরিশোধনের ক্ষমতাসম্পন্ন একটি পয়ঃশোধনাগার, দৈনিক ৩০০ ঘনমিটার পরিশোধনের ক্ষমতাসম্পন্ন একটি সেপটিক ট্যাংকের বর্জ্য শোধনাগার, ২০০ কিলোমিটার পয়োনালা নির্মাণ করা হবে। এতে চট্টগ্রাম নগরের ২২টি ওয়ার্ডের ৩৬ বর্গকিলোমিটার এলাকা প্রকল্পের আওতায় আসবে। আর উন্নত পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থার সুফল পাবেন ২০ লাখ মানুষ।

তবে প্রকল্পের অগ্রগতি প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই প্রকল্পের অধীনে এখন পর্যন্ত বসানো হয়েছে মাত্র দুই কিলোমিটার পয়োনালা। এ ছাড়া পয়ঃশোধনাগারের নির্মাণকাজও শেষ হয়নি। শুধু পাইলিংয়ের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

চট্টগ্রাম নগরের হালিশহরের চৌচালা প্রকল্প এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বড়সড় বেশ কিছু পয়োনালা সারি বেঁধে রাখা। শ্রমিকেরা কেউ লোহার রড বাঁধছেন, কেউ কার্পেটিংয়ের কাজ করছেন। প্রকল্পে কর্মরত প্রকৌশলীরা জানান, পয়োবর্জ্য এসে জমা হবে পাম্পিং স্টেশনে। ওই স্টেশনের নির্মাণকাজ এখনো শুরু হয়নি। পাম্পিং স্টেশন থেকে বর্জ্য যাবে বায়োলজিক্যাল ট্রিটমেন্ট ফ্যাসিলিটিজ (বিটিএফ) নামের প্ল্যান্টে। এই প্ল্যান্টের ঢালাইকাজ শেষ হয়েছে। দেয়াল তৈরির কাজ চলছে। এরপর বিটিএফ প্ল্যান্ট থেকে বর্জ্য চলে যাবে সেকেন্ডারি ক্লারিফায়ার নামের আরেকটি প্ল্যান্টে। ওই প্ল্যান্টের নির্মাণকাজও শুরু হয়নি এখনো।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) তৈরিতেই গলদ ছিল। এখন কাজে দেরির কারণে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। তবে কত টাকা বাড়ছে, তা চূড়ান্ত হয়নি। ৩ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা ব্যয়ে সরকারি ও ওয়াসার নিজস্ব তহবিলে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। ওয়াসা দিচ্ছে ৫০ কোটি টাকা।

জানা গেছে, প্রকল্প এলাকা ঠিকাদারকে বুঝিয়ে দিতেও সময় নষ্ট করেছে সংস্থাটি। এমনকি ওই এলাকা নিয়ে আইনি জটিলতা ছিল। এলাকাবাসীর সঙ্গে দফায় দফায় বসতে হয়েছে। উচ্ছেদ করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়তে হয়েছে।

ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম দাবি করেন, করোনা মহামারির কারণে প্রকল্পের কাজ ঠিক সময়ে শুরু করা যায়নি; তাই অগ্রগতি কম। করোনার সময় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান জেভি অব এরিনকোর কর্মকর্তারা মালয়েশিয়ায় চলে যান। এ ছাড়া উত্তর কাট্টলী ও পতেঙ্গা ক্যাচমেন্টের পাম্পস্টেশনও হালিশহরে নির্মাণ করা হবে। বাড়তি কাজ যুক্ত হওয়ার কারণে বর্তমান প্রকল্পের প্ল্যান্টের আকার ছোট করতে হয়েছে। এসব করতে গিয়ে সময় গেছে। এখন কাজ পুরোদমে চলছে বলে জানান তিনি।

ওয়াসা করোনার অজুহাত দিলেও মহামারিকালে চট্টগ্রামে বড় কয়েকটি প্রকল্পের কাজ চলেছে। এর মধ্যে আছে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের নির্মাণকাজ। বর্তমানে কাজটির প্রায় ৯৮ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইনের নির্মাণকাজও করোনাকালে চলেছে।

আরও পড়ুন

আরও ৫ প্রকল্প

পয়োনিষ্কাশন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য পুরো শহরকে ছয়টি অঞ্চল বা ক্যাচমেন্টে ভাগ করেছে সংস্থাটি। ক্যাচমেন্টগুলো হলো হালিশহর, কালুরঘাট, ফতেয়াবাদ, পূর্ব বাকলিয়া, উত্তর কাট্টলি ও পতেঙ্গা। হালিশহর ক্যাচমেন্টের নির্মাণকাজ নিয়ে ওয়াসা ধুঁকছে। তবে এর মধ্যে আরও পাঁচটি ক্যাচমেন্ট তৈরি করার জন্য ঋণ নিচ্ছে সংস্থাটি। ইতিমধ্যে বিভিন্ন দাতা সংস্থা ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে। পাঁচটি ক্যাচমেন্টে খরচ হবে প্রায় ১৬ হাজার ৯৭২ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে দুটিতে অর্থায়ন করবে জাইকা। ইতিমধ্যে জাইকার আমন্ত্রণে পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা দেখতে এমডিসহ ওয়াসার আট প্রকৌশলী জাপানে গেছেন। বাকি তিনটিতে অর্থায়ন করবে দক্ষিণ কোরিয়ার উন্নয়ন সহযোগিতা তহবিল (ইডিসিএফ), ফ্রান্স সরকারের অর্থায়নকারী সংস্থা এজেন্সি ফ্রান্সেস ডেভেলপমেন্ট (এএফডি) ও জাপানের মারুবিনি করপোরেশন।

ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম বলেন, বাকি পাঁচ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ হয়েছে। এখন ডিপিপি তৈরির কাজ চলছে।

নির্ধারিত সময়ে গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পের কাজ শেষ করতে না পেরে আরও প্রকল্প নেওয়াকে অগ্রহণযোগ্য বলে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম নগরকে দূষণের কবল থেকে বাঁচাতে পয়োনিষ্কাশন প্রকল্পটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সংস্থাটির এ উদ্যোগ নিয়ে নাগরিকেরা আশাবাদী ছিলেন; কিন্তু প্রকল্পের অগ্রগতি ৩০ শতাংশ হওয়ার বিষয়টি সন্তোষজনক নয়। এ বিষয়ে ওয়াসাকে জবাবদিহির মধ্যে আনা উচিত সরকারের। এরপর নতুন কোনো প্রকল্পের অনুমোদনের বিষয়টি ভাবা যায়।

আরও পড়ুন