পড়াশোনার বয়সেই বিয়ে করা শিক্ষায় ঝরে পড়ার বড় কারণ

হেলেনা বেগম রাজধানীর পশ্চিম শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা। বছর পাঁচ আগে একমাত্র মেয়ে সোনিয়ার বিয়ে দেন তিনি। সোনিয়ার বয়স তখন ১৯ বছর। এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলেন। বিয়ের পর সোনিয়ার আর পড়াশোনা হয়নি। এখন দুই সন্তানের মা তিনি।

হেলেনা বেগম বলেন, তিনি চাইতেন মেয়ে পড়াশোনা করুক। জামাতারও সেই ইচ্ছা ছিল। দুজনে মিলে সোনিয়াকে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু সোনিয়ার পড়াশোনা করার ইচ্ছা নেই।

বছর চার আগে বিয়ে হয় ইসমত আরার (২৫)। তখন বিএ কোর্সে পড়াশোনা করছিলেন। বাড়ি গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বামনডাঙা ইউনিয়নে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর স্বামী ঢাকায় চাকরি করতেন। তাই বিয়ের পরপরই স্বামীর সঙ্গে ঢাকায় চলে আসতে হয়েছে। পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি।

সোনিয়া কিংবা ইসমতের মতো আরও অনেকেই পড়াশোনা থেকে ঝরে পড়েছেন, পড়ছেন। সরকারি তথ্য বলছে, ঝরে পড়ার অনেকগুলো কারণ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণ বিয়ে। মেয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ হার বেশি। তবে অনেক ছেলেশিক্ষার্থীও বলেছেন, বিয়ে করায় আর পড়াশোনা করা হয়নি তাঁদের।

গত ৫ জুন বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) আর্থসামাজিক ও জনমিতি জরিপ–২০২৩–এর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার পেছনে ছয়টি মূল কারণ রয়েছে। সেগুলো হলো বিয়ে করা, কর্মে যুক্ত হয়ে যাওয়া, আর্থিক অস্বচ্ছলতা, পড়ালেখায় অনীহা, কাজ খোঁজা, করোনা মহামারির পর আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না ফেরা।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রায় ৪২ শতাংশ পড়াশোনা বন্ধ করেছেন বিয়ে করার কারণে। ঝরে পড়া মেয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ হার ৭১ শতাংশ। আর ছেলেশিক্ষার্থীদের মধ্যে ৩ শতাংশ।

বিয়ের কারণে যে ৪২ শতাংশ ছেলেমেয়ের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ার কথা বলা হয়েছে, তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমে যুক্ত হওয়ার হারও কমে যায়। তারা ভালো পেশা বা কাজে যুক্ত হতে পারে না। ফলে আয় কম হয়। সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তাদের অবদান কমে যায়।
—মঈনুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংখ্যা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক

শিক্ষার্থী না থাকার কারণ বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়ার সংজ্ঞা হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়, সাধারণত ২৪ বছর বয়সী এক ব্যক্তির শিক্ষার্থী হিসেবে থাকার কথা থাকলেও অনেক সময় চাকরি, আর্থিক অস্বচ্ছলতা, বিয়ে, ইচ্ছার অভাব ইত্যাদি কারণে এমন ব্যক্তিদের অনেকে শিক্ষার্থী থাকেন না।

দেশে জনশুমারি ও গৃহগণনা জরিপের পর প্রতিবার আর্থসামাজিক ও জনমিতিক জরিপ করা হয়। এবার ২০২২ সালে জনশুমারি করার পর এ বছরে এসে আর্থসামাজিক ও জনমিতিক জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। এর আগে ২০০১ সালের জনশুমারির বেশ পর ২০০৪ সালে আর্থসামাজিক ও জনমিতিক জরিপ হয়। তবে তা প্রকাশ হয় ২০০৮ সালে।

এবারের জরিপটি গত বছরের ২১ মে থেকে ২২ জুন পর্যন্ত দেশজুড়ে পরিচালিত হয়। ১৩টি বিষয়ভিত্তিক মডিউলের আওতায় ১২১টি প্রশ্নের মাধ্যমে ১৯৪টি সূচকের তথ্য জরিপে সংগ্রহ করা হয়। ১২ হাজার ৪০টি এলাকার ২ লাখ ৯৮ হাজার ৭৩৪টি পরিবার থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।

মেহেরপুর, পঞ্চগড়, চুয়াডাঙ্গা, নীলফামারী, রংপুর, ঠাকুরগাঁও, ঝিনাইদহ, নড়াইল, শেরপুর, বগুড়া, নওগাঁ, নাটোর, রাজশাহী, গাইবান্ধায় ছেলেমেয়ের বিয়ের পর পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার হার বেশি।

জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ প্রকল্পের পরিচালক মো. দিলদার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তিন থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে শিক্ষার্থী না থাকার কারণগুলো জরিপে তুলে আনা হয়েছে। ফলে বাল্যবিবাহ যাঁদের হয়েছে, তাঁদের তথ্যও এখানে যুক্ত হয়েছে। এ কারণে হয়তো বিয়ের কারণে পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার হার মেয়েদের বেশি এসেছে।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বিয়ে ছাড়া বাকি পাঁচ কারণে পড়ালেখা ছেড়ে দেওয়ার হার মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের অনেক বেশি। যেমন, কাজে যোগ দেওয়ার কারণে ২০ শতাংশের বেশি ছেলেমেয়ে পড়ালেখা ছেড়ে দিয়েছে। ছেলেদের মধ্যে এ হার ৪১ শতাংশ হলেও মেয়েদের মাত্র ৫ শতাংশ।

বিয়ে করে ছেলেরাও পড়াশোনা ছাড়ছে

বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘের (টিএমএসএস) বগুড়া জেলার কর্মসূচি কর্মকর্তা শামীমা আক্তার ২৩৪টি কিশোর–কিশোরী ক্লাব পরিচালনা করেন। একেকটি ক্লাবে সদস্য গড়ে ৩০ জন। বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়ানোর কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, ‘কম বয়সী কিছু ছেলেমেয়ে অনেক সময় নিজেদের পছন্দে বিয়ে করে ফেলে। মা–বাবা বিয়ে মেনে নেন না। সে ক্ষেত্রে দুজনেরই পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়।’

যথাযথ শিক্ষার অভাবে ঝরে পড়া এসব ছেলেমেয়ের চিন্তা–ভাবনার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ ঘটে না। গুণগত বিকাশও হয় না। সচেতনতা কম থাকে। নেতিবাচক প্রভাব পরবর্তী প্রজন্মের ওপরও পড়ে।

শামীমা আক্তার আরও বলেন, কম বয়সে বিয়ে করা ছেলেরা একটা সময় পর্যন্ত বেকার থাকে। কাজ খোঁজে। আবার অনেক পরিবারে দুষ্টু প্রকৃতির ছেলে আছে। বিয়ে দিলে ‘ভালো’ হয়ে যাবে, এমন ভাবনা থেকে অভিভাবকেরা সেই ছেলের বিয়ে দেন। দেখা যায়, এই ছেলেরা বিয়ের পর আর পড়ছে না। কাজও করছে না।

বিয়ের কারণে ছেলেশিক্ষার্থীরা কেন পড়াশোনা ছেড়ে দিচ্ছে, এর সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তর বিবিএসের কর্মকর্তারা দিতে পারেনি। মো. দিলদার হোসেন জানান, বিবিএসের জরিপে শুধু তথ্য তুলে আনা হয়েছে। এখন বিশ্লেষকেরা কারণ ব্যাখ্যা করবেন।

বিবিএসের এই কর্মকর্তা বলেন, জেলাভিত্তিক তথ্য থেকে দেখা যায়, দরিদ্রপ্রবণ এলাকায়, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এবং ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ছেলেদের মধ্যে বিয়ের পর পড়ালেখা ছেড়ে দেওয়ার হার কিছুটা বেশি। সেসব জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছেলেদের কম বয়সে বিয়ে করার প্রবণতা রয়েছে। সেটাও পড়ালেখা ছেড়ে দেওয়ার একটা কারণ হতে পারে।

জেলা–বিভাগভিত্তিক পরিস্থিতি কেমন

আর্থসামাজিক ও জনমিতি জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের আট বিভাগের মধ্যে রাজশাহীতে বিয়ের কারণে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা ছাড়ার হার সবচেয়ে বেশি ৫৫ শতাংশ, সিলেটে সবচেয়ে কম ২২ শতাংশ। খুলনায় এ হার ৫৩ শতাংশ, রংপুরে ৫০ শতাংশ, বরিশালে ৪৫ শতাংশ, চট্টগ্রামে ৪১ শতাংশ, ঢাকা ও ময়মনসিংহে ৩৮ শতাংশ।

অন্যদিকে, ছেলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার হার সবচেয়ে বেশি রাজশাহী বিভাগে, ৮ শতাংশ। প্রায় একই হার রংপুরে। সবচেয়ে কম সিলেটে, ১ শতাংশের কিছু বেশি। ঢাকা ও চট্টগ্রামেও এই হার কমের দিকে। আর বরিশাল, ময়মনসিংহ ও খুলনায় এ হার যথাক্রমে ৩, ৪ ও ৫ শতাংশ।

জেলাভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কোনো জেলায় মেয়েদের বিয়ের কারণে পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার হার বেশি থাকলেও ছেলেদের ক্ষেত্রে তা সামান্য। যেমন কুমিল্লায়। সেখানে মেয়েদের ক্ষেত্রে এ হার ৯০ শতাংশ, ছেলেদের ১ শতাংশের কম।

আবার, কোনো জেলায় ছেলেমেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রেই এ হার তুলনামূলক কম। যেমন সিলেট বিভাগের চারটি জেলায় মেয়েদের বিয়ের পর পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার হার কম, ছেলেদের মধ্যে নেই বললেই চলে। অন্যদিকে, জয়পুরহাটে ছেলেমেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রে এ হার বেশি। মেয়েদের ক্ষেত্রে ৮৯ শতাংশ ও ছেলেদের ১৫ শতাংশ।

মেহেরপুর, পঞ্চগড়, চুয়াডাঙ্গা, নীলফামারী, রংপুর, ঠাকুরগাঁও, ঝিনাইদহ, নড়াইল, শেরপুর, বগুড়া, নওগাঁ, নাটোর, রাজশাহী, গাইবান্ধায় ছেলেমেয়ের বিয়ের পর পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার হার বেশি দেখা গেছে।

ঝরে পড়ার প্রভাব

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংখ্যা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মঈনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বাল্যবিবাহ আর অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতার কারণে দরিদ্র পরিবারের অনেক ছেলেমেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়ে। জীবনভর এই ছেলেমেয়েরা সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

মঈনুল ইসলাম আরও বলেন, জরিপে যে ৪২ শতাংশ ছেলেমেয়ের বিয়ের কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ার কথা বলা হয়েছে, তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমে যুক্ত হওয়ার হারও কম। তারা ভালো পেশা বা কাজে যুক্ত হতে পারে না। ফলে আয় কম হয়। সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তাদের অবদান কমে যায়।

এ ছাড়া যথাযথ শিক্ষার অভাবে ঝরে পড়া এসব ছেলেমেয়ের চিন্তা–ভাবনার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ ঘটে না। গুণগত বিকাশ হয় না। সচেতনতা কম থাকে। নেতিবাচক প্রভাব পরবর্তী প্রজন্মের ওপরও পড়ে বলে মনে করেন মঈনুল ইসলাম।