পুলিশ কখন গুলি করতে পারবে, গুলির উদ্দেশ্য কী হবে

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে গুলি করছেন পুলিশ সদস্যরা। গত বছরের ১৮ জুলাই রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায়ফাইল ছবি

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় নাশকতার ঘটনা ঘটে। প্রায় এক সপ্তাহে সারা দেশে ৪০টির বেশি যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়। বিভিন্ন স্থানে ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।

এমন পরিস্থিতিতে যাঁরা মানুষ ও পুলিশ সদস্যদের ওপর ককটেল হামলা করবেন, যানবাহনে আগুন দেবেন, তাঁদের লক্ষ্য করে গুলির নির্দেশ দেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী।

গত রোববার বিকেলে সাজ্জাত আলী বেতারবার্তায় এই নির্দেশনা দেন বলে ডিএমপির একাধিক কর্মকর্তা জানান। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসহ ব্যাংক-আর্থিক প্রতিষ্ঠানে হামলা, অগ্নিসংযোগ করতে এলে তাঁদের প্রতিহত করতে গুলি করার নির্দেশনা দেন ডিএমপি কমিশনার।

এর পাঁচ দিন আগে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের কমিশনারও বেতারবার্তায় কর্মকর্তাদের একই ধরনের নির্দেশনা দেন।

এখন প্রশ্ন উঠেছে, পুলিশ কি এভাবে গুলি করতে পারে?

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী
ছবি: ডিএমপি

ডিএমপির কমিশনার সাজ্জাত আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘যাঁরা মানুষ ও পুলিশ সদস্যদের ওপর ককটেল হামলা এবং যানবাহনে আগুন দেবেন, আইনসম্মতভাবেই তাঁদের ওপর গুলির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

সাজ্জাত আলীর এই গুলির নির্দেশনার পর এ নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। অনেকের জিজ্ঞাসা, পুলিশ আসলে কোন পরিস্থিতিতে গুলি করতে পারবে?

আরও পড়ুন

পুলিশ প্রবিধানে কী আছে

পুলিশ প্রবিধানের (পিআরবি) ১৫৩ ধারা অনুযায়ী, এই বাহিনী তিন ক্ষেত্রে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে। এগুলো হলো—ব্যক্তির আত্মরক্ষা ও সম্পদ রক্ষার অধিকার প্রয়োগ, বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করা ও গ্রেপ্তার কার্যকর করা।

দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ১০০ ও ১০৩ ধারা অনুযায়ী, প্রাণহানি, মারাত্মক আঘাত ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে অনিষ্ট করাসহ কয়েকটি ক্ষেত্রে পুলিশকে আক্রমণকারীদের মৃত্যু ঘটানোর ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

পিআরবি ১৫৩-তে বলা হয়েছে, নিজেদের (পুলিশের), জনগণের ও সরকারি সম্পত্তি হামলা থেকে রক্ষার জন্য পুলিশ শক্তি প্রয়োগ করতে পারে।

দণ্ডবিধির ৯৯ ধারায় এই শক্তি প্রয়োগের মাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী, আত্মরক্ষার জন্য যতটুকু প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি শক্তি প্রয়োগ করা যাবে না।

দণ্ডবিধির ১০২ ধারা অনুযায়ী, যখনই ক্ষতির আশঙ্কা শেষ হবে, তখনই আত্মরক্ষার জন্য শক্তি প্রয়োগের অধিকারও শেষ হবে।

পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যক্তির আত্মরক্ষা ও সম্পদ রক্ষার অধিকার প্রয়োগ এবং গ্রেপ্তার কার্যকর করার জন্য গুলি করা যেতে পারে। তবে সব সময় এই গুলির উদ্দেশ্য মৃত্যু ঘটানো হবে—এমন নয়। সবচেয়ে কম ক্ষতিসাধন করে সর্বোচ্চ লক্ষ্য অর্জনেই গুলি চালাতে হবে।

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন আন্দোলনকারীরা। এ সময় তাঁদের লক্ষ্য করে পুলিশকে গুলি করতে দেখা যায়। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায়, ২০ জুলাই, ২০২৪
ফাইল ছবি
আরও পড়ুন

কোন গুলিতে কী হয়

বাংলাদেশে পুলিশ এখন বেশি ব্যবহার করে শটগান। শটগানে রাবার ও সিসার দুই ধরনের গুলি ব্যবহৃত হয়। এটাকে অনেকে ছররা গুলিও বলেন। এর কার্তুজের মধ্যে ছোট ছোট বল (স্প্লিন্টার) থাকে। বিশৃঙ্খলা বা সহিংসতামূলক ঘটনা দমনে প্রথমে লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহারের চর্চা আছে। এতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না এলে শটগানের গুলি ছোড়া হয়। এই গুলিতে মৃত্যুর ঝুঁকি কম থাকে।

তবে বাংলাদেশ পুলিশের কাছে রাইফেল, পিস্তল, এসএমজির (সাবমেশিন গান) মতো অস্ত্রও আছে। এসব অস্ত্রের গুলি বা বুলেট প্রাণঘাতী। রাইফেল ও এসএমজির গুলি মানুষের শরীরের এক পাশ দিয়ে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে।

অনেক সময় আবার ছররা গুলিও কাছ থেকে লাগলে বা মাথা-বুকসহ শরীরের সংবেদনশীল অংশে বিদ্ধ হলে মানুষের মৃত্যু হতে পারে। আবার কার্তুজের ধরনের ওপর শটগানের গুলি ৪০ থেকে ৫০ মিটারের মধ্যে লাগলে প্রাণনাশের কারণ হয়ে উঠতে পারে।

আরও পড়ুন
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গত বছরের ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদের মৃত্যু হয় পুলিশের গুলিতে
ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গত বছরের ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদের মৃত্যু পর দেখা যায়, ছররা গুলিতে তাঁর বুক ও পেট ঝাঁঝরা হয়ে গেছে।

আবু সাঈদের মরদেহের ময়নাতদন্ত করেন রংপুর মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যাপক রাজিবুল ইসলাম। তিনি গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, পুলিশের ছররা গুলিতে আবু সাঈদের মৃত্যু হয়েছে। ১০ মিটারের মধ্যে গুলি করায় তাঁর (সাঈদ) শরীরের ভেতরের কিছু অঙ্গ ফুটো হয়ে গিয়েছিল। ফলে তাঁর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়।

প্রাণঘাতী বুলেটেরও নানা ধরন আছে। যেমন—৯ এমএম পিস্তলের গুলির কার্যকর সীমা (ইফেক্টিভ রেঞ্জ) ৫০ মিটার। তবে অবস্থাভেদে কয়েক শ মিটার দূরত্বে আঘাত করলেও তা প্রাণঘাতী হতে পারে।

আধা স্বয়ংক্রিয় (সেমি-অটোমেটিক) ৭ পয়েন্ট ৬২ এমএম চায়নিজ রাইফেলের গুলি ৩০০ মিটারের মধ্যে কারও শরীরে লাগলে তা প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় এমন ঘটনা ঘটে। তখন ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। এলোপাতাড়ি সেসব গুলিতে দূরের বাসার ভেতর, ছাদে কিংবা বারান্দায় থাকা মানুষও গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান। তখন ক্ষতচিহ্ন দেখে বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, এগুলো রাইফেল বা এসএমজির গুলির আঘাত।

আরও পড়ুন

পুলিশের কাছে কী ধরনের অস্ত্র আছে

পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানায়, সাধারণত বেশি বল প্রয়োগ করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে শটগান ব্যবহার করা হয়। অস্ত্রধারী অপরাধীকে মোকাবিলার ক্ষেত্রে পুলিশ প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে। তবে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় এই অস্ত্রের ব্যবহারে অপপ্রয়োগের ঘটনা ঘটে।

বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে ৭ পয়েন্ট ৬২ এবং ৯ এমএম ক্যালিবারের অস্ত্র রয়েছে। তবে ৯ এমএম পিস্তলই বেশি। পুলিশের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, তাদের কাছে ৭ পয়েন্ট ৬২ এমএম চায়নিজ রাইফেল, সাব মেশিনগান (এসএমজি) ও লাইট মেশিনগান (এলএমজি) রয়েছে। একসময় পুলিশের কাছে থ্রি নট থ্রি রাইফেল ছিল। অবশ্য এখন আর এই অস্ত্রের ব্যবহার নেই বললেই চলে।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দমাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করে
ফাইল ছবি
আরও পড়ুন

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালে ছাত্র-জনতার ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে নির্বিচার গুলি করেছে, সে ক্ষেত্রে শটগান, পিস্তল ও রাইফেলের ব্যবহার বেশি ছিল। এসএমজি ও এলএমজির মতো অস্ত্রও ব্যবহৃত হয়েছে কোথাও কোথাও।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর পুলিশের হাতে প্রাণঘাতী অস্ত্র না রাখার দাবি ওঠে। গত ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনেও পুলিশের হাতে প্রাণঘাতী অস্ত্র না রাখার সুপারিশ এসেছিল।

এই প্রেক্ষাপটে গত ১২ মে আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির নবম সভায় পুলিশের হাতে চায়নিজ রাইফেল, সাব মেশিনগান, ৯ এমএম পিস্তলের মতো অস্ত্র না রাখার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।

আরও পড়ুন

গুলির উদ্দেশ্য কী হবে

পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এই বাহিনীর গুলির উদ্দেশ্য সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। তাঁরা বলছেন, পুলিশের উদ্দেশ্য সাধারণত কারও মৃত্যু ঘটানো নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তারা এমন অস্ত্র ব্যবহার করে, যা দিয়ে বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করা যায়, কিন্তু মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি কম থাকে।

পুলিশ প্রবিধান ১৫৪-তে উল্লেখ করা হয়েছে, গুলি সব সময় নির্ধারিত লক্ষ্যে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হতে হবে। একেবারে অপরিহার্য ব্যতীত কোনোরূপ বড় রকম ক্ষতি সাধন করা যাবে না। উদ্দেশ্য পূরণ হওয়ামাত্রই গুলি বন্ধ করতে হবে।

তা ছাড়া কোনো সমাবেশ যদি বেআইনিও হয়, তাহলে তা ছত্রভঙ্গ করার জন্য গুলি করার আগে হুঁশিয়ারি (ওয়ার্নিং) দেওয়ার বিধান রয়েছে পুলিশ প্রবিধানে।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আইন ও সনদে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহারের ক্ষেত্রে নানা ধরনের বিধিনিষেধ আছে। এ জন্য পুলিশের গুলি চালানোর নির্দেশ ও উদ্দেশ্য নিয়ে চলছে নানা আলোচনা।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, জানমালের ক্ষতি বা নাশকতা থেকে নগরবাসীকে রক্ষার জন্যই গুলির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। গুলি করে কেবল কারও মৃত্যু ঘটানো এর উদ্দেশ্য নয়। মানুষের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আইন অনুযায়ী যতটুক প্রয়োজন, ততটুকু বলপ্রয়োগ করা হবে। তবে নাশকতা বন্ধে পুলিশের অবস্থান অত্যন্ত কঠোর থাকবে।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন