চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজু মুন্সির ‘দাপট’ চলছে ১১ বছর

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাজু মুন্সি
ছবি: সংগৃহীত

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন ১১ বছর আগে, তবে পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি, ক্যাম্পাসও ছাড়েননি। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি কখনো শিক্ষককে মারধরের হুমকি দিয়েছেন। কখনো ঠিকাদারের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করেছেন। এখন প্রধান প্রকৌশলীকে মারধর করে নতুন করে আলোচনায় ছাত্রলীগের এই নেতা। তাঁর নাম রাজু মুন্সি।

শিক্ষক-শিক্ষার্থী থেকে কর্মকর্তা–কর্মচারী—সবাই রাজু মুন্সির দাপটে তটস্থ। ছাত্রত্ব না থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তিনি। থাকেন শাহজালাল হলের ২১৮ নম্বর কক্ষটি দখল করে।

শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মচারীরা বলছেন, গত এক দশকে রাজু বহু শিক্ষকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন। শিক্ষার্থীকে পিটিয়েছেন। তবে কোনো শিক্ষার্থী তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ দিতে সাহস পাননি। তাঁর হাত থেকে রেহাই পাননি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। তবে এরপরও তাঁর বিরুদ্ধে শক্ত কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

আরও পড়ুন

সবশেষ গত সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী ছৈয়দ জাহাঙ্গীর ফজলকে রাজু মুন্সি মারধর করেন বলে অভিযোগ ওঠে। একই দিন ১০ হাজার টাকা চাঁদা না দেওয়ায় ভারপ্রাপ্ত প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা শেখ আবদুর রাজ্জাককে লাঞ্ছিত করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ দুই ঘটনার প্রতিবাদে ক্যাম্পাসে গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে তিন ঘণ্টা অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন প্রকৌশল দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাঁদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রাজু মুন্সিকে আসামি করে মামলা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

‘আমার সময়ে রাজু মুন্সি ঠিকভাবে রাজনীতি করতেন। কিন্তু আমি ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর রাজু মুন্সি ভুল পথে পরিচালিত হয়েছেন, অন্তত পত্রপত্রিকার সংবাদ দেখে আমার তাই মনে হচ্ছে।’
আলমগীর টিপু, সাবেক সভাপতি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ

রাজুর বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

নথিপত্র অনুযায়ী, রাজু মুন্সি অ্যাকাউন্টিং বিভাগের ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। ওই বিভাগের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজু মুন্সি স্নাতক শেষ করেননি। প্রথম বর্ষে কয়েক দিন ক্লাসে এলেও দ্বিতীয় বর্ষ থেকে আর আসেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী, কোনো বর্ষে টানা দুবার ফেল করলে বা পরীক্ষা না দিলে ছাত্রত্ব বাতিল হবে। সেই হিসেবে রাজুর ছাত্রত্ব বাতিল হয়েছিল ২০১৬ সালে।

রাজুর বাড়ি ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গার শাত্রাকান্দা গ্রামে। তাঁর বিরুদ্ধে এর আগেও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগ উঠেছিল। গত ১ জুন অনুপস্থিতির কারণে তাঁর দুই কর্মীকে পরীক্ষা দিতে না দেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকে তালা দিয়ে অবরোধ করেছিলেন রাজু মুন্সি। গত বছরের ৪ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক মো. তানবীর হাসানকে ফোন করে মারধরের হুমকি দেন তিনি। এ ঘটনায় প্রক্টরকে লিখিত অভিযোগও দিয়েছিলেন ভুক্তভোগী শিক্ষক।

এর আগে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজু মুন্সির বিরুদ্ধে চাঁদার দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজ বিভাগের নির্মাণাধীন একটি ভবনের কাজ বন্ধে করে দেওয়ার অভিযোগ করেন এক ঠিকাদার।

রাজু মুন্সির বিষয়ে প্রকৌশলী ও ঠিকাদারেরা নাম প্রকাশ করে কিছু বলতে রাজি হননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা বলেন, রাজু মুন্সি চলমান বিভিন্ন প্রকল্পের ঠিকাদারের কাছ থেকে চাঁদা দাবি করছেন। চাঁদা না পেলে কাজ বন্ধ করে দেওয়ারও হুমকি দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী এসব বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁকে মারধর করেন তিনি।

‘রাজু ভুল পথে পরিচালিত’

ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১২ সালে ভর্তি হয়েই রাজু মুন্সি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের উপপক্ষ ‘সিক্সটি নাইন’-এ নাম লেখান। পরের বছর ২০১৩ সালে আলোচনায় আসেন তিনি। ওই বছরের ২৪ জুন রেলওয়ের কোটি টাকার দরপত্রের ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী ওরফে বাবর এবং ছাত্রলীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় নেতা সাইফুল আলম ওরফে লিমনের অনুসারীদের মধ্যে চট্টগ্রামের সিআরবি (রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সদর দপ্তর) এলাকায় সংঘর্ষ হয়।

এ সময় গুলিতে প্রাণ হারান যুবলীগের কর্মী সাজু পালিত (২৮) ও মো. আরমান (৮) নামের এক শিশু। এ ঘটনায় প্রথমে পুলিশ বাদী হয়ে ও পরে সাজু পালিতের মা মিনতি পালিত মামলা করেন। রাজু মুন্সি এ মামলায় জেল খেটে জামিনে মুক্তি পান। মামলাটি বিচারাধীন।

আরও পড়ুন

ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে রাজু মুন্সি শাহ জালাল হলে উঠেছিলেন। হলটি সিক্সটি নাইনের দখলে। সিক্সটি নাইনের সঙ্গে অন্য পক্ষের সংঘর্ষ ও মারধরে রাজু মুন্সি সামনের কাতারে থাকতেন। এভাবেই ছাত্রলীগে তাঁর প্রভাব বাড়তে থাকে। তবে দাপট বহুগুণ বেড়েছে ছাত্রলীগের পদ পাওয়ার পর। ২০২২ সালের ৩১ জুলাই তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ পান।

রাজু মুন্সি যখন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন, তখন সিক্সটি নাইনের নেতৃত্বে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি আলমগীর টিপু। তিনি বর্তমানে চট্টগ্রাম নগরে যুবলীগের রাজনীতিতে সক্রিয়। আলমগীর টিপু বলেন, ‘আমার সময়ে রাজু মুন্সি ঠিকভাবে রাজনীতি করতেন। কিন্তু আমি ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর রাজু মুন্সি ভুল পথে পরিচালিত হয়েছেন, অন্তত পত্রপত্রিকার সংবাদ দেখে আমার তাই মনে হচ্ছে।’

পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে

রাজু মুন্সি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। ইকবাল হোসেন আবার সাবেক সিটি মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারী হিসেবে ক্যাম্পাসে পরিচিত।

রাজু মুন্সির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, এমন প্রশ্নে ইকবাল হোসেন গৎবাঁধা উত্তরই দিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রধান প্রকৌশলীকে মারধরের বিষয়ে তিনি শুনেছেন। বিষয়টি যাচাই করে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবেন। রাজু মুন্সি তাঁর প্রশ্রয়ে মারধর করেছেন, এমন অভিযোগের বিষয়ে ইকবাল হোসেন দাবি করেন, কাউকে তিনি প্রশ্রয় দেন না।

আরও পড়ুন

বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য নিতে শাহ জালাল হলে গিয়ে রাজু মুন্সিকে পাওয়া যায়নি। মামলা হওয়ার পর থেকে তাঁর মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। নেতা-কর্মীরাও তাঁর অবস্থান জানাতে পারেননি। তবে গত মঙ্গলবার তিনি প্রথম আলোর কাছে লিখিত বক্তব্য পাঠিয়েছিলেন। এতে তিনি বলেন, ‘ক্যাম্পাসে শিক্ষকেরা ক্লাস নিচ্ছেন না। দায় নিচ্ছেন না কোনো কিছুর। আর প্রধান প্রকৌশলীর সনদপত্রই নেই। নিয়োগের বাণিজ্য হয়েছে। এগুলো নিয়ে কেউ কথা বলে না। আমিই বলি।’

জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর নূরুল আজিম সিকদার প্রথম আলোকে বলেন, রাজু মুন্সির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।