জন্মনিবন্ধন সংশোধনে সাড়ে ৩ লাখ আবেদন

  • জন্মসালের ভুল সংশোধনে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ে আবেদন ৩৯,২২৯টি।

  • জন্মতারিখ ও মাসের ভুল সংশোধনে ইউএনওর কার্যালয়ে আবেদন ৩,০৫,৮৯০টি।

নিবন্ধন ফি ৫০ টাকা। জন্মতারিখ সংশোধনে ১০০ টাকা হলেও অন্য সব সংশোধনেও ফি ৫০ টাকা। তবে একেকটি নিবন্ধনে দেড় হাজার টাকা নেওয়াও অভিযোগ আছে

ফয়সাল হোসেনের (২৫) জন্মনিবন্ধন হয়েছিল চার বছর আগে। ওই জন্মনিবন্ধন সনদে তাঁর নাম লেখা হয়েছিল হোসেন ফয়সাল। ইতালিপ্রবাসী এই ব্যক্তির পাসপোর্টে নাম ফয়সাল হোসেন। ইতালিতে সন্তান জন্ম নেওয়ার পর পাসপোর্টের সঙ্গে মিল রেখে তাঁর নির্ভুল জন্মসনদের প্রয়োজন এখন।

ফয়সালের বড় বোন আজহারুন্নেসা কানন গত সোমবার রাজধানীর শেওড়াপাড়ায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ১৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ে নাম সংশোধনের আবেদন জমা দেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাংলা ও ইংরেজি দুটি নামই সংশোধন করতে হচ্ছে।

জন্মসাল ভুলের বেশির ভাগই ইচ্ছাকৃত। বয়স কমানোর জন্য জন্মসনদ সংশোধন করতে চান অনেকে।
আবু নছর মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, উপরেজিস্ট্রার জেনারেল

রওশন আরা বেগম নামের এক নারী মারা যান ২০২২ সালের ১৩ নভেম্বর। তাঁর মৃত্যুসনদে স্বামী সেকান্দার আলী ভুঁইয়ার নামের জায়গায় বড় ছেলে খসরু আলমের নাম লেখা হয়েছে। গত বছরের ২০ নভেম্বর ১৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ে সংশোধনের জন্য আবেদন করা হয়। তবে সচিব বদলির কারণে সনদ প্রিন্ট করতে না পারায় সনদের বিষয়ে খোঁজ করতে গত ১০ জানুয়ারি ‘রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন’–এ এসেছিলেন সুজন মাহমুদ নামে এক ব্যক্তি। সেখানে প্রথম আলোকে তিনি এ তথ্য জানান।

সারা দেশ থেকে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনে নাম, নামের বানান, জন্মতারিখের দিন, মাস ও বছর ইত্যাদি সংশোধনের এমন কয়েক লাখ আবেদন জমা পড়েছে। রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের তথ্য অনুসারে, ২ জানুয়ারি পর্যন্ত সংশোধনের জন্য মোট আবেদন জমা পড়েছে ৩ লাখ ৪৮ হাজার ২৪৫টি। গত কয়েক মাসে এ আবেদনগুলো জমেছে।

সংশোধনের আবেদনের মধ্যে বেশির ভাগই জন্মনিবন্ধন–সংক্রান্ত বলে জানিয়েছেন রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের কর্মকর্তারা। মৃত্যুনিবন্ধন কম হয়ে থাকে বলে সংশোধনও কম। গত বছর সারা দেশে ৮২ লাখের বেশি জন্মনিবন্ধন হয়েছে। আর মৃত্যুনিবন্ধন হয়েছে ৭ লাখ ৩৩ হাজারের বেশি।

আরও পড়ুন

বানান, বয়স, জাতীয়তা সংশোধন

বয়সের ক্ষেত্রে দিন ও মাস সংশোধন করতে হলে বিভাগীয় শহর ও সিটি করপোরেশনের বাসিন্দাদের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আবেদন করতে হয়। আর ইউনিয়ন, উপজেলা ও পৌরসভার বাসিন্দাদের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে আবেদন করতে হয়। আর নামের বানানসহ ছোটখাটো ভুল সংশোধনের ক্ষমতা স্থানীয় নিবন্ধক কার্যালয় যেমন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের হাতে রয়েছে।

সংশোধনের মোট আবেদনের মধ্যে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে সংশোধনের জন্য জমা রয়েছে ২ হাজার ৯৭২টি। ইউএনও কার্যালয়ে জমা রয়েছে ৩ লাখ ৫ হাজার ৮৯০টি। বয়সের ক্ষেত্রে সাল অর্থাৎ জন্মের বছর সংশোধনের একমাত্র এখতিয়ার রেজিস্ট্রার জেনারেলের। এ কার্যালয়ে শুধু সাল সংশোধনের জন্য আবেদন জমা পড়েছে ৩৯ হাজার ২২৯টি।

গত বছরের ১ অক্টোবর জন্ম বছর সংশোধনের আবেদন করেন লুৎফর রহমান নামে একজন স্নাতক শিক্ষার্থী। জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট ও সব শিক্ষাসনদে তাঁর জন্মতারিখ ২০০২ সালের ২৬ জানুয়ারি। তবে জন্মনিবন্ধন সনদে এ তারিখ লেখা ১৯৯৮ সালের ১৬ মার্চ। ভিসার আবেদনের প্রয়োজনে জন্মনিবন্ধনে থাকা বয়স সংশোধনের প্রয়োজন হয় তাঁর।

তবে জন্মসাল সংশোধন সহজে করে দেয় না রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়। যাচাই-বাছাইয়ে ভুল প্রমাণিত হলেই সাল সংশোধন করা যায়। লুৎফর রহমানেরটা ‘ইচ্ছাকৃত ভুল’ উল্লেখ করে ফেরত পাঠানো হয়। এ ছাড়া একাধিক জন্মনিবন্ধন থাকা ব্যক্তিদের একটি রেখে বাকিগুলো বাতিলের মতো সমস্যা সমাধানে এই কার্যালয়ের দ্বারস্থ হয়ে থাকেন ভুক্তভোগীরা।

তেমনই একজন রাজধানীর উত্তরার বাসিন্দা ফারজানা মাহমুদা। জন্মনিবন্ধনে তাঁর নিজের ও বাবার পুরো নাম ভুল ছিল। পরবর্তী সময়ে সেই ভুল সংশোধন না করে তিনি আরও দুটি জন্মনিবন্ধন করেন। অনলাইনে একাধিক জন্মনিবন্ধন সনদ রয়েছে এমন ব্যক্তি নিজের ইচ্ছেমতো যেকোনো একটি রেখে অপরটি বাতিল করতে পারেন। ৯ জানুয়ারি তিনি একটি রেখে বাকিগুলো বাতিলের আবেদন করেন রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ে।

২ জানুয়ারি মহাখালীতে ডিএনসিসি অঞ্চল-৯ কার্যালয়ে জাতীয়তা সংশোধনের জন্য এসেছিলেন এক ব্যক্তি। নিবন্ধক কার্যালয়ে গিয়ে তাঁর ছেলের জন্মনিবন্ধন করছিলেন। তাঁর নিজের জাতীয়তা ‘বাংলাদেশি’র পরিবর্তে ভিন্ন একটি দেশের নাম দেওয়া হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রথম আলোকে বলেন, নিবন্ধক কার্যালয় থেকে ভুল করেছে, এখন তাঁকে ভুগতে হচ্ছে। ওই নিবন্ধন কার্যালয় থেকে তাঁকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, এই ভুল তাঁরা সংশোধন করতে পারবেন না। তাঁকে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ে যেতে হবে।

রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের তথ্য অনুসারে, জাতীয়তা নিয়ে সমস্যা খুব কমই ঘটে। জাতীয়তা ভুল করা নিয়ে সংশোধনের আবেদন জমা পড়েছে ১৫৪টি।

আরও পড়ুন

কেন এত ভুল

নিজে আবেদন না করাই ভুলের মূল কারণ বলে মনে করেন ডিএনসিসির ১৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. হুমায়ুন রশীদ (জনি)। গত সোমবার প্রথম আলোকে তিনি বলেন, বেশির ভাগ মানুষ টাকার বিনিময়ে দোকান থেকে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের আবেদন করেন। সার্ভার ডাউন সমস্যা, কম সময়ে বেশি আবেদন করার তাগিদে দোকানের কর্মী অনেক সময় তাড়াহুড়ো করে আবেদন করতে গিয়ে টাইপে ভুল করেন।

এই ওয়ার্ড কাউন্সিলর বলেন, যিনি আবেদন করেন, তিনিও ভালোভাবে পরীক্ষা করেন না। আবার অল্প পড়াশোনা জানা লোক ভুল ধরতে পারেন না। ফলে আবেদনে ভুল থেকে যায়।

নিবন্ধক কার্যালয়গুলোতে সেখানকার কর্মীদের দিয়েও অনেকে নিবন্ধন আবেদন করে থাকেন। নিবন্ধন ফি ৫০ টাকা। জন্মতারিখ সংশোধনে ১০০ টাকা হলেও অন্য সব সংশোধনেও ফি ৫০ টাকা। তবে একেকটি নিবন্ধনে দেড় হাজার টাকা নেওয়া এবং আরও বেশি টাকা নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টিতে ইচ্ছা করে ভুল করার অভিযোগ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে হুমায়ুন রশীদ বলেন, অনেকে অযথাই দালালের মাধ্যমে নিবন্ধন করান। তাঁদের ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে।

উপরেজিস্ট্রার জেনারেল আবু নছর মোহাম্মদ আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, জন্মসাল ভুলের বেশির ভাগই ইচ্ছাকৃত। বয়স কমানোর জন্য জন্মসনদ সংশোধন করতে চান অনেকে। অন্য ভুলগুলো প্রতিরোধে স্থানীয় পর্যায়ে পর্যবেক্ষণ–ব্যবস্থা জোরদার করা প্রয়োজন।

আবেদন জমা পড়ে থাকার বিষয়ে আবু নছর বলেন, আবেদন যাচাইয়ে পর্যবেক্ষণ বাড়াতে অন্তত উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের নিজস্ব জনবল থাকা উচিত। এখানে জনবলের বড় ঘাটতি রয়েছে।