কিছু দেশে সীমিত প্রবাসী শ্রমবাজার

কয়েকটি দেশেই সীমিত হয়ে আছে কর্মী পাঠানো। সীমিত দেশের ওপর নির্ভরতায় বড় ঝুঁকি রয়েছে।

বিদেশে পাঠানো মোট কর্মীর ৯৭ শতাংশ গেছেন মাত্র ১০টি দেশেরয়টার্স ফাইল ছবি

সরকারি নথিতে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের তালিকায় আছে ১৬৮ দেশের নাম। যদিও হাতে গোনা কয়েকটি দেশের মধ্যে সীমিত হয়ে আছে বিদেশের শ্রমবাজার। বিদেশে পাঠানো মোট কর্মীর ৯৭ শতাংশ গেছেন মাত্র ১০টি দেশে।

গত পাঁচ বছরে (২০১৯-২০২৩) বিভিন্ন দেশে পাঠানো কর্মীদের তথ্য বিশ্লেষণ করে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। এতে দেখা গেছে, পাঁচ বছরে অন্তত একজন কর্মী পাঠানো হয়েছে, এমন দেশ যুক্ত করলেও কর্মী পাঠানো হয়েছে মোট ১৩৭টি দেশে।

কর্মী পাঠানোর তথ্য সংরক্ষণ করে বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)। কাজ নিয়ে বৈধভাবে বিদেশে যেতে সব কর্মীকে এ সংস্থার কাছ থেকে ছাড়পত্র নিতে হয়। সংস্থাটির তথ্য বলছে, বিএমইটির তালিকায় থাকা দেশের মধ্যে ৩১টি দেশে কোনো কর্মী যায়নি গত পাঁচ বছরে।

মূলত মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশই বাংলাদেশি কর্মীদের প্রধান গন্তব্য। সৌদি আরব, আরব আমিরাত, ওমান ও কাতার—এই চার দেশে কর্মসংস্থান হয়েছে বেশি। এর বাইরে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর বড় কর্মসংস্থান তৈরি করেছে। তবে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় ভালো সম্ভাবনা থাকলেও কর্মী গেছে অনেক কম। ইউরোপের দেশগুলোতেও কর্মী পাঠানো যাচ্ছে না তেমন একটা। তাই নতুন শ্রমবাজার তৈরির চেষ্টা শুধুই মুখে মুখে।

১৯৭৬ সাল থেকে বিদেশে কর্মী পাঠানো শুরু হয়। গত ৪৮ বছরে ১ কোটি ৬০ লাখের বেশি কর্মী পাঠানো হয়েছে বিভিন্ন দেশে। এর মধ্যে শীর্ষে থাকা দেশটির নাম সৌদি আরব। মোট কর্মসংস্থানের ৩৫ শতাংশ হয়েছে দেশটিতে। কয়েক বছর ধরে এটি আরও বেড়েছে। সর্বশেষ পাঁচ বছরের তথ্য বলছে, দেশ ছেড়ে কাজে যাওয়া প্রায় ৫৫ শতাংশ কর্মীর ঠিকানা হয়েছে সৌদি আরব।

শ্রমবাজার মূলত ১০-১১টি দেশে সীমিত। কোনো কোনো বছরে এক দেশের ওপর বড় নির্ভরতা দেখা যায়। সীমিত দেশের ওপর নির্ভরতায় বড় ঝুঁকি আছে। কেননা এসব দেশেরও নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
তাসনিম সিদ্দিকী, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার, রামরু

অভিবাসন খাত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কর্মী বেশি থাকায় সেখানে নতুন করেও বেশি হারে কর্মী যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। প্রবাসী কর্মীরাই নতুন কর্মী পাঠানোর রাস্তা তৈরি করে দেয়। বিদেশ থেকে কর্মীর চাহিদা সংগ্রহ করে দেশে থাকা পরিচিত, স্বজনদের জন্য পাঠান তাঁরা। দেশে প্রায় ৯০ শতাংশ চাহিদাপত্র এভাবেই আসে।

বিএমইটির তথ্য বলছে, দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ কর্মসংস্থান হয়েছে গত দুই বছরে। গড়ে প্রতি মাসে গেছেন লাখের বেশি কর্মী। এর মধ্যেও ছয়টি দেশে গত বছর কর্মী গেছেন একজন করে। এর আগের চার বছরে ওই দেশগুলোতে কোনো কর্মী যাননি। আর ১৬টি দেশে পাঁচ বছরে গেছেন মাত্র ৩৫ জন। বছরে গড়ে একজন করেও কর্মী পাঠানো যায়নি এসব দেশে। বছরে গড়ে ১০০ কর্মী পাঠানো যায়নি, এমন তালিকায় আছে ৯১টি দেশের নাম।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মো. আলমগীর হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, নতুন শ্রমবাজার খুঁজে বের করতে গবেষণা বিভাগ নিয়মিত কাজ করছে। যেসব দেশে কর্মী কম যায়, সেখানেও বাড়ানোর চেষ্টা আছে। তবে বেশি কর্মী পাঠানোর চেয়ে দক্ষ কর্মী পাঠানোর দিকেই জোর দেওয়া হচ্ছে বেশি। অনেক দেশ কম কর্মী পাঠিয়ে বেশি প্রবাসী আয় নিয়ে আসে। তাই দক্ষ কর্মীর শ্রমবাজার নিয়ে পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

গত দেড় দশকে ৯৭টি দেশ থেকে বাড়িয়ে ১৬৮টি দেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে সরকার। এর মধ্যে অধিকাংশ দেশেই কর্মী যাচ্ছে হাতে গোনা। খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, নতুন সম্ভাবনাময় বাজার ধরতে না পারলে বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়বে অভিবাসন খাত।

ভরসা মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার দুই দেশ

বছরে গড়ে ১০ হাজারের বেশি কর্মী পাঠানো গেছে মাত্র আটটি দেশে। ৯৫ শতাংশের বেশি কর্মী গেছেন এসব দেশে। এ দেশগুলো হচ্ছে সৌদি আরব, ওমান, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর, কাতার, কুয়েত ও জর্ডান। এর মধ্যে ছয়টি দেশ মধ্যপ্রাচ্যের। এর বাইরে ইতালি ও রোমানিয়ায় দুই বছর ধরে কর্মী যাওয়া বেড়েছে। আর বছরে গড়ে পাঁচ হাজারের বেশি কর্মী পাঠানো হয়েছে, এমন দেশ মোট ১৭টি।

শীর্ষে থাকা এসব দেশের কোনো একটিতে হোঁচট খেলেই কমে যায় বিদেশে কর্মী পাঠানো। মাঝখানে টানা চার বছর বন্ধ ছিল আরব আমিরাতের বাজার। শেষ দুই বছর ধরে দেশটিতে কর্মী যাওয়া বেড়েছে। গত বছরের শেষ দিকে বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে ওমান। মালদ্বীপে একসময় নিয়মিত কর্মী যেত। অবৈধ কর্মীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় দেশটির শ্রমবাজার বন্ধ করে দেওয়া হয়। গত চার বছর সেখানে নতুন করে কর্মী পাঠানো যায়নি। এ বছর থেকে আবার মালদ্বীপে কর্মী পাঠানো শুরু হয়েছে। তবে দুই বছর ধরে মালয়েশিয়ায় কর্মী যাচ্ছে। এর মধ্যে গত বছরই গেছে সাড়ে তিন লাখের বেশি। এর আগে টানা তিন বছর দেশটির শ্রমবাজার বন্ধ ছিল।

বিদেশে কর্মী পাঠানো রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকদের সংগঠন বায়রার মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ইউরোপের বেশ কিছু দেশে দক্ষ কর্মীর চাহিদা মেটাতে পারলে প্রবাসী আয় বাড়বে। কিন্তু দূতাবাস না থাকায় ভারতে গিয়ে ভিসার আবেদন করা একটি জটিল প্রক্রিয়া। এতে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কূটনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে ঢাকায় দূতাবাস বা কনস্যুলার সেবা চালু করার উদ্যোগ নিতে পারে সরকার।

আরও পড়ুন

নতুন শ্রমবাজারের দেখা নেই

প্রবাসী আয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভালো ভূমিকা রাখতে পারে জাপান ও কোরিয়া। এ দুটি দেশে ভালো আয়ের সুযোগ বেশি। কোরিয়ায় চাহিদা বাড়ছে প্রতিবছর। দেশটিতে মূলত কর্মী পাঠানো হয় সরকারি ব্যবস্থাপনায়। চাহিদা থাকলেও ছাড়পত্র না পাওয়ায় কর্মী পাঠাতে পারছে না বেসরকারি খাতের রিক্রুটিং এজেন্সি। শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভিয়েতনাম, চীন, ফিলিপাইন, ভারতসহ কয়েকটি দেশ থেকে কর্মী যাচ্ছে কোরিয়ায়। ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ইতালিতে প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা বেশি। যদিও এর মধ্যে অধিকাংশই গেছেন অনিয়মিত উপায়ে। এখনো অনেকে যাচ্ছেন ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে। দুর্ঘটনায় মারাও যাচ্ছেন নিয়মিত। তবে গত দুই বছর দেশটিতে বৈধভাবে কর্মী পাঠানো বেড়েছে। এতে গত পাঁচ বছরে বেশি কর্মী পাঠানো দেশের তালিকায় শীর্ষ দশে উঠে এসেছে ইতালির নাম। এ সময় ২৫ হাজারের বেশি কর্মী গেছে দেশটিতে।

বিএমইটির পক্ষ থেকে ৫৩টি দেশের শ্রমবাজারে কর্মী পাঠানোর সম্ভাবনা নিয়ে একটি গবেষণা করা হয়েছে ২০১৮ সালে। যদিও অনেক বছর ধরে নতুন কোনো শ্রমবাজার তৈরি করতে পারছে না সরকার। গত দেড় দশকে ৯৭টি দেশ থেকে বাড়িয়ে ১৬৮টি দেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে সরকার। এর মধ্যে অধিকাংশ দেশেই কর্মী যাচ্ছে হাতে গোনা। খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, নতুন সম্ভাবনাময় বাজার ধরতে না পারলে বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়বে অভিবাসন খাত।

আরও পড়ুন

অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রামরু বলছে, গত বছর ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় কনস্যুলার সেবা চালু করেছিল রোমানিয়া। প্রভাবশালী মহলের নিজস্ব লোকদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভিসা করার চাপে এক মাসের মাথায় এটি বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। অথচ ৬ মাসে ১৫ হাজার কর্মী নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল তাদের।

রামরুর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার তাসনিম সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, ১৬৮ দেশে কর্মী পাঠানোর দাবি যৌক্তিক নয়। শ্রমবাজার মূলত ১০-১১টি দেশে সীমিত। কোনো কোনো বছরে এক দেশের ওপর বড় নির্ভরতা দেখা যায়। সীমিত দেশের ওপর নির্ভরতায় বড় ঝুঁকি রয়েছে। কেননা এসব দেশেরও নানা সীমাবদ্ধতা আছে। নতুন শ্রমবাজার তৈরি করতে না পারলে কর্মী পাঠানো কমে যেতে পারে। মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা ও কাজে রয়েছে সমন্বয়হীনতা।