‘আজি দখিন–দুয়ার খোলা’

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর আজ ২৫ জুন উদ্বোধন হচ্ছে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের পদ্মা সেতুর। নিজেদের টাকায় তৈরি এই সেতু দেশের উন্নয়নে নতুন দিগন্তের সূচনা করবে
ছবি: সাজিদ হোসেন

‘আজি দখিন-দুয়ার খোলা—/ এসো হে...।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১১২ বছর আগে লিখেছিলেন এই গান।

আজ ২০২২ সালের ২৫ জুন সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা বহুমুখী সেতুর উদ্বোধন করতে যাচ্ছেন। মাওয়া প্রান্তে সুধী সমাবেশে ভাষণ শেষে তিনি উদ্বোধনী ফলক উন্মোচন করবেন। অমনি খুলে যাবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯টি জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অপরাপর অংশের জন্য সংযোগ, যোগাযোগ এবং সম্ভাবনার অনন্ত দুয়ার।

অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জীবনমানের উন্নয়নের যাত্রা শুরুর এই শুভক্ষণকে রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘... বাজায়ে ব্যাকুল বেণু মেখে পিয়ালফুলের রেণু’ উদ্‌যাপন করাই যায়। আর যখন আমরা মনে রাখি যে এই সেতুর নির্মাণ ব্যয় কোনো উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার কাছ থেকে আসেনি, এই সেতু হয়েছে বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে, কৃষক-শ্রমিক-দেশবাসী-প্রবাসীর মাথার ঘাম পায়ে ফেলা অর্থে; তখন গেয়ে উঠতে পারি রবীন্দ্রনাথের গান: মৃদু মধুর মদির হেসে এসো পাগল হাওয়ার দেশে,/ তোমার উতলা উত্তরীয় তুমি আকাশে উড়ায়ে দিয়ো—/ এসো হে, এসো হে, এসো...আজি দখিন-দুয়ার খোলা—/এসো হে।

আরও পড়ুন

এভাবে বলা যায় কারণ, এই সেতু শুধু একটা স্থাপনা নয়, বাংলাদেশের আত্মমর্যাদা, সামর্থ্য এবং সক্ষমতার উজ্জ্বল প্রমাণ।

৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু। মাওয়া থেকে জাজিরা। পদ্মা সেতু সড়ক, রেল, গ্যাস, বিদ্যুতের সংযোগ ঘটাবে উত্তরের সঙ্গে দক্ষিণের। নির্মাণের বিশাল কর্মযজ্ঞের সঙ্গে আছে সংযোগ সড়ক, রেলসংযোগ, নদীশাসন, পুনর্বাসন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা—নানা প্রকল্প ও কর্মকাণ্ড।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২২ জুনের সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, পদ্মা সেতুর প্রকল্প ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। ২১ জুন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২৭ হাজার ৭৩২ কোটি ৮ লাখ টাকা।

এই টাকা বাংলাদেশের মানুষ দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ থেকে উদ্ধৃতি দেওয়াই যায়, ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।’

পদ্মা সেতু নির্মাণের সুফল আসবে নানাভাবে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তা বিরাট অবদান রাখবে। ট্রান্সএশিয়ান হাইওয়ে ও ট্রান্সএশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। এ দেশের সঙ্গে ভারত, ভুটান ও নেপালের যোগাযোগ নিবিড় হবে। মোংলা বন্দর হবে রাজধানীর নিকটতম সমুদ্রবন্দর। এক সমীক্ষায় বলা হচ্ছে, পদ্মা সেতু জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) বৃদ্ধি করবে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বৃদ্ধি পাবে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর আগের আর পরের উত্তরবঙ্গের মানুষের জীবনযাত্রার মানের পার্থক্য থেকেই এই আশা বাস্তব ভিত্তি পায়।

১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার পদ্মা সেতুর প্রাক্-সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষার কাজ শুরু করে। এরপর সম্ভাব্যতা যাচাই হয়েছে, প্রকল্পের ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) হয়েছে, কিন্তু কাজ শুরু হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২২ জুনের সংবাদ সম্মেলনে জানান, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে পদ্মা সেতুকে অগ্রাধিকার তালিকায় যুক্ত করে আওয়ামী লীগ সরকার।

২০১১ সালে এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়নের বিষয়ে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাইকা ও ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) সঙ্গে ঋণচুক্তি সই করা হয়। পরে বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে অর্থায়ন বন্ধ করে। বাকি দাতা সংস্থাগুলোও পিছিয়ে যায়। সেই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে ঘোষণা করেন, বাংলাদেশ নিজেদের সামর্থ্যেই গড়ে তুলবে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। উন্নয়ন–সহযোগীদের জানিয়ে দেওয়া হয়, তাদের অর্থায়নের দরকার নেই।

সেতুর মূল কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের শেষের দিকে। এই সেতু বাস্তবায়নে দেশি-বিদেশি বহু বিশেষজ্ঞ, প্রযুক্তিবিদ, প্রতিষ্ঠান, কারিগর, কয়েক হাজার শ্রমিক দিনরাত পরিশ্রম করেছেন। জামিলুর রেজা চৌধুরী, এম শামীম জেড বসুনিয়া, আইনুন নিশাত, এ এম এম সফিউল্লাহ, এম ফিরোজ আহমেদের মতো দেশি বিশেষজ্ঞরা সর্বক্ষণ পরামর্শ দিয়েছেন, মানের প্রশ্নে একচুলও ছাড় দেননি। তেমনি পুনর্বাসনের কাজ, পরিবেশ রক্ষা কিংবা বনায়নের কাজও হয়েছে বিশ্বমানের। বিশ্বব্যাপী কোভিড মহামারির ধাক্কাও কাজের গতি মন্থর করতে পারেনি। এই প্রকল্পের পরিচালকসহ অন্য কর্মকর্তারাও দক্ষতা ও যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন।

তবে প্রকৌশলগত চ্যালেঞ্জ ছিল অনেকগুলো। আমাজনের পর পৃথিবীর সবচেয়ে খরস্রোতা নদীতে পাইল বসাতে গিয়ে নিত্যনতুন সমস্যায় পড়তে হয়েছে। ভূমিকম্পসহ সেতু বানানোর জন্য পৃথিবীর বৃহত্তম বিয়ারিং বসাতে গিয়ে পড়তে হয়েছে বাস্তব অসুবিধায়। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হ্যামার ব্যবহার করা হয়েছে পদ্মা সেতুতে।

হাজার হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক-কারিগর নিজেদের উজাড় করে দিয়ে কাজ করেছেন। যুক্ত ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও। কাজ করেছেন চীনসহ বিভিন্ন দেশের কারিগর ও বিশেষজ্ঞরাও। পদ্মাপারে চীনা আর বাংলাদেশি শ্রমিকেরা মিলেমিশে কাজ করতে গিয়ে পরস্পরের ভাষাও শিখে ফেলেছিলেন।

কোলা কোলা মানে বড় ভাই, তিতি মানে ছোট ভাই, চীনা শব্দগুলো বাঙালিরা ব্যবহার করতে শিখে গিয়েছিলেন। তেমনি চীনা প্রকৌশলীরাও তাঁদের আবাসস্থলে পালংশাক, লালশাক আবাদ করতেন। বাংলাদেশি শ্রমিকেরা অকুতোভয়, নেমে পড়তেন নদীর মধ্যে শত শত ফুট গভীর অন্ধকার কূপে।

এঁদের বেশির ভাগই বিদায় নিয়েছেন। চীনা ঠিকাদারের কাছ থেকে সেতু কর্তৃপক্ষ সেতু বুঝে নিয়েছে।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ উদ্বোধনী ফলকের পর্দা উন্মোচন করবেন, তা খুলে দেবে আমাদের উন্নয়নের, এগিয়ে যাওয়ার, যোগাযোগের, আত্মবিশ্বাসের এক সোনালি দখিন দরজা, সামনে দেখাবে আশাবাদের অনন্ত দিগন্ত। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সেই গানটাও বোধ হয় আজ গাওয়া চলে: ও পৃথিবী এবার এসে বাংলাদেশ নাও চিনে।