ব্যবসার স্বার্থে ভাঙা পড়বে কমলাপুর স্টেশন

কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

কমলাপুর স্টেশন এবং এর আশপাশের রেলের জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে। তারা সেখানে কয়েকটি বহুতল ভবন নির্মাণ করবে। এর মধ্যে থাকবে পাঁচ তারকা হোটেল, শপিং মল, অফিস কমপ্লেক্স ও আবাসিক ভবন। এর জন্যই ভাঙা পড়বে ৫৩ বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী কমলাপুর রেলস্টেশন। আর নতুন রেলস্টেশন হবে এই এলাকায়ই, কিছুটা উত্তর দিকে সরে গিয়ে।

নতুন স্টেশন যদি শহরের মাঝখানে এই কমলাপুরেই বানানো হয়, তাহলে কেন হাতুড়ি পড়ছে ঐতিহ্যে? জবাব একটাই—ব্যবসা। সেবা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রেলওয়ে জমি নিয়ে ব্যবসায় নামছে। একে তারা বলছে রেলের আয় বাড়ানোর উদ্যোগ। কিন্তু কত আয় বাড়বে এসব প্রকল্প থেকে, সে বিষয়ে কোনো সমীক্ষা করেনি রেল।

কমলাপুর রেলস্টেশনের স্থপতি ছিলেন দুই মার্কিন নাগরিক। ড্যানিয়েল বার্নহ্যাম এবং বব বুই। বার্নহ্যাম পড়াশোনা করেছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। বব বুই নিউইয়র্কের প্র্যাট ইনস্টিটিউটে ও লন্ডনের এএ স্কুলে। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে বার্নহ্যাম ও বুই তৈরি করতে চেয়েছিলেন আধুনিক স্থাপত্য আর গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আবহাওয়ার উপযোগী নির্মাণশৈলীর সংমিশ্রণে।

কমলাপুর রেলস্টেশন এবং শাহজাহানপুর রেলওয়ে আবাসিক এলাকা ঘিরে যে বাণিজ্যিক পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে রেলপথ মন্ত্রণালয়, তাকে তারা বলছে ‘মাল্টিমোডাল হাব’। আয়বর্ধক এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে সরকারি-বেসরকারি যৌথ বিনিয়োগে (পিপিপি)। জমি দেবে রেল কর্তৃপক্ষ আর অবকাঠামো বানাবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।

সরকারের ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি ২০১৮ সালের অক্টোবরে প্রকল্পটি নীতিগতভাবে অনুমোদনও করেছে।

প্রকল্পটি বাস্তবায়নে জাপানের কাজিমা করপোরেশনের সঙ্গে তিন দফা বৈঠক করেছে রেল কর্তৃপক্ষ। তারা কমলাপুর স্টেশন সরানো এবং আশপাশে এক ডজনের বেশি বহুতল ভবন নির্মাণের প্রাথমিক নকশা তৈরি করেছে। রেলের পিপিপি প্রকল্পসংক্রান্ত নথি অনুসারে, এই ‘মাল্টিমোডাল হাব প্রকল্পে’ প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে ৮০০ কোটি টাকা। বাস্তবায়নকাল ২০২১-২৫ সাল।

উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ চলছে। এটি কমলাপুর পর্যন্ত বর্ধিত করার সিদ্ধান্ত হয় ২০২৯ সালের মাঝামাঝি। আর কাজিমা করপোরেশনের সঙ্গে মাল্টিমোডাল হাব প্রকল্প নিয়ে প্রাথমিক কথাবার্তা শুরু হয় ২০১৮ সালের এপ্রিলে। ২০১৯ সালের মার্চে তারা প্রকল্পের নমুনা নকশা দেয়। এতে কমলাপুর স্টেশন ভাঙার কোনো কথা উল্লেখ করেনি। কাজিমা এখনো বিস্তারিত নকশা করেনি।

স্টেশন সরালে বিদ্যমান রেললাইনের পথও পরিবর্তন করতে হবে। তখন বর্তমান রেলস্টেশন ভবনের আর কোনো ব্যবহার থাকবে না। এখন এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়কে (বুয়েট) যুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

এই বিষয়ে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের সঙ্গে প্রাথমিক যে কথা হয়েছে, তাতে কমলাপুর স্টেশন ভাঙা বা সরিয়ে ফেলার কোনো কথা ছিল না; বরং পাশের কনটেইনার টার্মিনাল সরিয়ে সেখানে একটি দৃষ্টিনন্দন খোলা ময়দান করার কথা ছিল। এর জন্য পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। করোনা সংক্রমণের কারণে বিষয়টি আর এগোয়নি। এর মধ্যে স্টেশন ভাঙার সিদ্ধান্ত কীভাবে এল? তিনি আরও বলেন, কমলাপুর স্টেশন রেখেই এর সঙ্গে সমন্বয় করে বহুতল অবকাঠামো করা সম্ভব।

ভাঙার মূল কারণ ব্যবসায়িক

রেলওয়ে ও ডিএমটিসিএল সূত্র বলছে, মেট্রোরেলের স্টেশনগুলো হবে মাটি থেকে কমবেশি ১৩ মিটার ওপরে। এর জন্য কমলাপুর স্টেশনের কিছুই ভাঙার দরকার হবে না। তবে মেট্রোরেলের শেষ স্টেশনটি বিদ্যমান কমলাপুর রেলস্টেশন ভবনের সামনের অংশ ঢেকে ফেলবে। এতে কমলাপুর স্টেশনের সৌন্দর্যহানি ঘটবে, ব্যবসায়িকভাবে গুরুত্ব হারাবে বলে মনে করছে কাজিমা করপোরেশন।

এ জন্য কাজিমা করপোরেশন গত বছরের মাঝামাঝি দুটি বিকল্পের সুপারিশ করে। ১. মেট্রোরেলের পথ (রুট) পরিবর্তন করা এবং ২. কমলাপুর স্টেশন ১৩০ মিটার উত্তরে সরিয়ে নেওয়া।

রেলওয়ে সূত্র বলছে, রেল কর্তৃপক্ষ প্রথমে মেট্রোরেলের রুট পরিবর্তনের দাবি তোলে। কিন্তু মেট্রোরেলের বাস্তবায়নকারী সংস্থা ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) রুট পরিবর্তন করতে চাইছিল না। কারণ, এতে লাইনের দৈর্ঘ্য দুই কিলোমিটারের মতো বেড়ে যেতে পারে। ফলে ব্যয়ও বেড়ে যাবে। পরে কমলাপুর স্টেশন সরানোর আলোচনা শুরু হয়। গত বছরের নভেম্বরে রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম তাতে সায় দেন। ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেও স্টেশন ভাঙার বিষয়ে সম্মতি দেওয়া হয়।

কমলাপুর রেলস্টেশন ভাঙা হবে—এমন তথ্যে নিজের উদ্বেগ জানিয়ে সম্প্রতি প্রথম আলোতে এ নিয়ে লিখেছেন স্থপতি, নগরবিদ কাজী খালিদ আশরাফ। তিনি মনে করেন, মেট্রোরেলের লাইন যে কমলাপুর স্টেশনের সঙ্গে যুক্ত হবে, এটা তো সাধুবাদ পাওয়ার মতো সিদ্ধান্ত। তার মানে এই নয় যে অ্যালাইনমেন্টের নাম করে বিদেশি পরামর্শকদের কথাতেই জলজ্যান্ত নিদর্শনকে (কমলাপুর স্টেশন) বিলুপ্ত বা বিকৃত করতে হবে।

ঐতিহ্যহানি ও বাড়তি ব্যয়

রেলের তিনজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, কমলাপুর স্টেশন ভবনটি ১৯৬৮ সালে নির্মিত রেলের আইকনিক ভবন। বিস্তীর্ণ ধানখেত থেকে জায়গাটিকে রূপান্তর করা হয় এশিয়ার অন্যতম সুন্দর ও আধুনিক রেলওয়ে স্টেশনে। এর সঙ্গে সংস্থাটির এবং সাধারণ মানুষেরও আবেগ জড়িয়ে আছে। এটি রাজধানী ঢাকারও একটি আইকনিক স্থাপনা। এটি মেট্রোরেলের আড়ালে পড়ে যাক, তা তারা চান না। আবার স্টেশনটি ভেঙে ফেলার বিষয়টিও পীড়াদায়ক। তিনি বলেন, মেট্রোরেলের আড়ালে স্টেশনের সৌন্দর্যহানি হলেও ঐতিহ্য তো টিকে থাকত। নতুন স্টেশন নির্মাণে যে ব্যয়, সেটাও হতো না।

রেলের সূত্র বলছে, প্রাথমিকভাবে মাল্টিমোডাল হাব প্রকল্পে যে ৮০০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে, তা আরও বাড়বে। কারণ, স্টেশন ভেঙে নতুন নির্মাণের খরচ যুক্ত হবে।

কমলাপুর স্টেশনটা শুধু একটা ভবন নয়, এর সঙ্গে অনেক জটিল কারিগরি বিষয় যুক্ত। হুট করে চাইলে সরানো সম্ভব নয়। ঐতিহ্য নষ্টের পাশাপাশি এর জন্য বিপুল অর্থও ব্যয় করতে হবে।
আবু তাহের, রেলের সাবেক মহাপরিচালক

কমলাপুর রেলস্টেশনের স্থপতি ছিলেন দুই মার্কিন নাগরিক। ড্যানিয়েল বার্নহ্যাম এবং বব বুই। বার্নহ্যাম পড়াশোনা করেছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। বব বুই নিউইয়র্কের প্র্যাট ইনস্টিটিউটে ও লন্ডনের এএ স্কুলে। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে বার্নহ্যাম ও বুই তৈরি করতে চেয়েছিলেন আধুনিক স্থাপত্য আর গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আবহাওয়ার উপযোগী নির্মাণশৈলীর সংমিশ্রণে। অনেক গবেষণার পর তাঁরা প্রস্তাব করলেন ছাতার মতো একটি স্থাপনা। এটা মূলত কংক্রিটের অনেকগুলো প্যারাবলিক ডোমের সমন্বয়। তার নিচে স্টেশনের সব কর্মকাণ্ড চলবে। ১৫৬ একর জায়গায় নির্মিত স্টেশনটি ঢাকা নগরের আধুনিকায়নের অন্যতম প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। এতে ১০টি প্ল্যাটফর্ম, ২২টি টিকিট কাউন্টার, রেস্তোরাঁ, গুদাম, যাত্রী ও রেলওয়ে কর্মীদের আলাদা বিশ্রামাগার রয়েছে।

কমলাপুর স্টেশনের নির্মাণশৈলীতে ডেনমার্কের স্থপতি জন উটজনের ডিজাইন করা সিডনির বিখ্যাত অপেরা হাউসের অনুপ্রেরণা আর নিউইয়র্কে অবস্থিত এরও সারিনেনের টিডব্লিউএ টার্মিনালে কবিতার মতো গতিময় স্থাপত্যের ভাষা আছে। আরও আছে মোগল স্থাপত্যের প্যাভিলিয়ন ধাঁচের স্থাপনার প্রতিচ্ছবি, শুধু ছাদ আর চারদিকে খোলামেলা। কোনো প্রাচীর নেই। একটি গণতান্ত্রিক স্থাপত্য।

এসব তথ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী স্থপতি, স্থাপত্য ইতিহাসবিদ ও নগর চিন্তাবিদ আদনান জিল্লুর মোর্শেদ সম্প্রতি প্রথম আলোয় লিখেছিলেন, একটি অত্যাধুনিক গণপরিবহন কেন্দ্র উন্নয়ন সবারই প্রয়োজন। কিন্তু সে উন্নয়নের সামাজিক ও ঐতিহাসিক মূল্য কত দিতে হবে? উন্নয়ন কি ইতিহাস আর প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রতি সংবেদনশীল হতে পারে না?

অতীতে স্টেশন সরানোর বিরোধী ছিল রেল

রেলওয়ে সূত্র জানায়, ঢাকার যানজট নিরসনে এক দশক আগে কমলাপুর স্টেশন গাজীপুরে সরিয়ে নেওয়ার আলোচনা শুরু হয়েছিল। কিন্তু কারিগরি ও যাত্রী পরিবহনের তথ্য বিশ্লেষণ করে তখন সিদ্ধান্ত হয়, স্টেশনটি সরালে মূল শহরে আসতে মানুষের অসুবিধা হবে। তবে এখন গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত বাসের বিশেষ লেন বা বিআরটি (বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট) হচ্ছে। বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত পাতালপথে মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এখন রেল চাইছে স্টেশন সরাতে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এসব কর্মকর্তা বলছেন, এই স্টেশন ভবন ঘিরে গড়ে উঠেছে রেলের নিয়ন্ত্রণকক্ষ (কন্ট্রোল রুম)। এখান থেকে সারা দেশের ট্রেন চলাচল কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এর সঙ্গে রেলের সংকেত ব্যবস্থাও যুক্ত। এই স্টেশনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথ। আছে আরেকটি স্টেশন প্ল্যাটফর্ম। ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত রেললাইন নির্মিত হচ্ছে। এর শুরু ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথের গেন্ডারিয়ায়। এর বাইরে নারায়ণগঞ্জ থেকে কুমিল্লার লাকসাম হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত নতুন একটি উচ্চ গতির ট্রেন লাইন নির্মাণে ১০০ কোটি টাকায় সম্ভাব্যতা যাচাই হচ্ছে। এসব নতুন উদ্যোগকে কীভাবে সমন্বয় করা হবে, সেটিও একটা বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দেবে।

এ বিষয়ে রেলের সাবেক মহাপরিচালক আবু তাহের প্রথম আলোকে বলেন, কমলাপুর স্টেশনটা শুধু একটা ভবন নয়, এর সঙ্গে অনেক জটিল কারিগরি বিষয় যুক্ত। হুট করে চাইলে সরানো সম্ভব নয়। ঐতিহ্য নষ্টের পাশাপাশি এর জন্য বিপুল অর্থও ব্যয় করতে হবে। ফলে অন্য কোনো বিকল্প আছে কি না, সেটা ভালোভাবে ভেবে দেখা দরকার বলে মনে করছেন তিনি।

আগামীকাল পড়ুন: মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবসায় রেল