বয়স হারিয়ে বয়স্ক ভাতার আশায়

জাতীয় পরিচয়পত্রে বয়স কম থাকায় বয়স্ক ভাতা পাননি টঙ্গীর ফুলমালা। ভাতা পেয়ে জমিরান খুশি, তবে পরিমাণ বড় কম। ২২ বছরে ভাতার পরিধি অনেক বেড়েছে, কিন্তু চাহিদা আরও বেশি। আছে বাছাইয়ের রাজনীতি, বয়সের বেহিসাব।

ফুলমালার (ডানে) আকুতি একটি বয়স্ক ভাতা কার্ডের জন্য। কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্রে বয়স কম। বয়স্ক ভাতার টাকায় খাবার ও ওষুধ কেনেন জমিরান (বাঁয়ে)। কিন্তু টাকাটা দ্রুত ফুরিয়ে যায়। ৩ অক্টোবর, মরকুন পশ্চিমপাড়া বস্তি, টঙ্গী, গাজীপুরছবি: প্রতিবেদক

তাঁর যত সমস্যা বয়স নিয়ে। আমাকে দাঁড়াতে বলে হনহনিয়ে তিনি জাতীয় পরিচয়পত্র আনতে চললেন।

ডুগডুগে হলুদ জমিনে টকটকে লাল ফুল-পাতা ছাপা ত্রাণে পাওয়া শাড়ির ঘোমটার নিচে সাদা-কালো চুলের রেখা। দাঁত পড়া ভাঙাচোরা মুখ। তাঁর একটি বয়স্ক ভাতার কার্ড চাই।

গত ৩ অক্টোবর গাজীপুরের মরকুন পশ্চিমপাড়া বস্তিতে আমার পথ আটকে ফুলমালা বলেছিলেন, ‘বয়স্ক ভাতার একটা কার্ড কইরা দিয়েন। আমারে দেয় নাই। কইছে, আপনের বয়স কম। আমারে দিছে ৫০ বছর, কার্ডের মইদ্যে। হের লাইগা আমার হয় নাই।’

বয়স কম দেখাচ্ছে জাতীয় পরিচয়পত্র, অর্থাৎ এনআইডি কার্ডে। ঘরে তাঁর সম্পদের সিন্দুক আইসক্রিমের বাক্সটিতে সেটাই খুঁজতে গেলেন ফুলমালা।

এদিকে নানা বয়সী প্রতিবেশী নারীরা তাঁর বয়স আর বয়স্ক ভাতা নিয়ে বাহাস জুড়লেন:
‘৬১-৬২ বছর লাগব। তোমাগেরে কইলেই দিয়া দিব? ...বয়স হওন লাগব না? খালি কইলেই হইব?’

‘না, বয়স হইছে না?’ ‘দাঁত দেহি একটাও নাই!’

‘দাঁত বয়সে পড়ে নাই!’ ‘দাঁত তো জোয়ানকালেও পইড়া যায়।’

‘আমার উপরমুহি দুইটা দাঁত পইড়া গেছে অহনই!’

এ দেশে গরিবঘরের বৃদ্ধারা অসহায়ের মধ্যে আরও অসহায়। প্রবীণদের নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক হেল্পএজের ২০১৬ সালের একটি গবেষণা বলছে, তাঁদের প্রায় ৭০ ভাগই বিধবাও বটে।

চাকরিহারা পোশাকশ্রমিকদের এই বস্তিতে ‘বুড়ি’ নাকি আরও অনেক ছিল। বসতিটায় শিশু অনেক। করোনার আকালের আগে পোশাক কারখানায় বাবা–মায়েদের কাজ ছিল। তাঁরা ঘর-বাচ্চা সামলাতে মা-খালা-নানি-দাদিদের এনে রাখতেন।

চাকরিহারা পোশাকশ্রমিকদের এই বস্তিতে শিশু অনেক
ছবি: প্রতিবেদক

তারপর করোনা এল। বাবা–মায়েরা কাজ হারালেন। বেশ কিছু বৃদ্ধাকে গ্রামে ফিরতে হলো। তারপরও বয়স্ক ভাতার দাবিদার এখনো অনেক।

জটলার মধ্যে থেকে তীক্ষ্ণ ক্ষুব্ধ একটা গলা ঝনঝন করে ওঠে, ‘সাবিনার মায়ে পায় না। রোকসানার মায়ে পায় না।’ তারপর গলার পর গলা—অনেকে পান না।

ইতিমধ্যে ভাতা-দাবিদার বেচইন ফুলমালা ফেরত আসেন। এনআইডিটি কার্ডটি খুঁজে পাননি। আবারও বলেন, ‘ওই কার্ডের মইদ্যে আমার বয়স কম দিছে।’ কে দিয়েছে? ‘যেহানো ছবি দিছে, হেহানো।’

ফুলমালা বোঝেন না, কেন তিনি বয়স্ক ভাতা পাবেন না?
ছবি: প্রতিবেদক

ফুলমালা কিঞ্চিৎ দিশেহারা। তাঁর চোখ দুটি বড় বড়। সে চোখে যত না রাগ-ক্ষোভ, তার চেয়ে বেশি আছে নিপাট না-বোঝা। কেন তিনি বয়স্ক ভাতা পাবেন না?

ব্যাখ্যা করতে এগিয়ে আসেন মমিনুর রহমান। তিনি পোশাকশ্রমিক–নেতা, স্বেচ্ছাসেবী, এনজিওকর্মী। বলেন, ‘যখন আইডি কার্ডগুলো করে, এমনও দেখা গেছে, মায়ের বয়স আর মেয়ের বয়স দুইটা কাছাকাছি।’ এই দুঃখের কথা বলতে গিয়ে তাঁর হাসিই আসে।

মমিনুর বলেন, তিনি এমনও দেখেছেন, হয়তো কারও বয়স ৭০, কিন্তু এনআইডি কার্ড অনুযায়ী দাঁড়ায় ৫০ বা ৪০-৪৫ বছর। তাঁর বয়স্ক ভাতা চাওয়ার সুযোগটুকুও থাকছে না।

‘যখন আইডি কার্ডগুলো করে, এমনও দেখা গেছে, মায়ের বয়স আর মেয়ের বয়স দুইটা কাছাকাছি।’
মমিনুর রহমান, পোশাকশ্রমিক–নেতা ও স্বেচ্ছাসেবী

ফুলমালা থাকেন মেয়ের সঙ্গে। মেয়ে এককালে পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। এখন রোজ টঙ্গী সেতু পেরিয়ে ঢাকার উত্তরায় ঠিকা ঝিয়ের কাজ করতে যান। মেয়ের জামাই টং দোকানে চা বেচেন।

ফুলমালা ঘরসংসার সামলান। রান্না করতে গিয়ে গরম পানি পড়ে হাতটা পুড়েছে। সংসার চলে কেমন করে? ‘আল্লায় চালায়! টুকটাক এই চলি।’

গরম পানি পড়ে ফুলমালার হাতটা পুড়েছে
ছবি: প্রতিবেদক

বয়স্ক ভাতা হলে কত টাকা পাবেন, ফুলমালা কি জানেন? তিনি শরম পান। আঁচলে মুখের ঘাম মুছে ফোকলা দাঁতে হেসে বলেন, ‘আমি জানি না এডি। আমি তো পাই নাইক্যা কোনো দিন।’

ভাতার বরকত

ওদিকের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ থেকে রঙ্গ দেখছিলেন আরেক বৃদ্ধা। এবার তিনি এগিয়ে আসেন। ডান হাত সামনে মেলে বলেন, ‘আমাগোরে আধা করি দেয়!’

ঘোমটার নিচে তাঁর সব চুলই সাদা, তাতে মেহেদির আভাস। পুরু কাচের চশমাটি নাকের ডগায় ঝোলে। দাঁত আছে, তবে চামড়া-কোঁচকানো কোমর-নোওয়ানো পুরোদস্তুর বৃদ্ধা। নাম বললেন, ‘জমিরান’।

জমিরান বয়স্ক ভাতা পান
ছবি: প্রতিবেদক

জমিরান বয়স্ক ভাতা পান। ভাতা আসে ব্যাংকে, কিস্তিতে। শেষ পেয়েছেন রোজার আগে, তিন হাজার টাকা! কত দিন পরপর পান? কে একজন বলেন, তিন মাস পরপর।

জমিরান প্রতিবাদ করেন, ‘হ্যাঁ! তিন মাস পরে? পাঁচ মাস পরে না? পাঁচ মাস পরে!’ চশমার ওপর দিয়ে চোখ আমার দিকে ঘোরে। মুখে হাসি ফোটে, ‘হ! ছয় মাস পরে!’

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সরকার নির্দিষ্ট বয়সী দুস্থ ও অসহায় প্রবীণদের মাসে ৫০০ টাকা হিসাবে বছরে চার কিস্তিতে ভাতা দেয়। করোনাকালে একবারে দুই কিস্তির টাকা দিয়েছে। তাই এবার জমিরান হাতে একসঙ্গে তিন হাজার টাকা পেয়েছিলেন।

টাকা পেলে জমিরান কী করেন? হাত উল্টে বলেন, ‘খাই! খাইয়া আবার কিছু থুই!’ মিষ্টি করে হাসেন জমিরান। হাত ঘুরিয়ে বলেন, ‘জামাই (স্বামী) মইরা গেছে, মা। জামাই নাই, পোলা নাই।’

‘জামাই (স্বামী) মইরা গেছে মা। জামাই নাই, পোলা নাই।’—জমিরান
ছবি: প্রতিবেদক

জমিরানের আছে এক মেয়ে। বাড়ি জামালপুর জেলার ইসলামপুরে, নদীভাঙা এলাকার এক গ্রামে। মেয়ে সেখানে থাকেন। জমিরান এখানে নাতনির ঘর-সংসার দেখেন, ‘নাতিনে চাকরি করে গার্মেনসে।’

কাজহারা পোশাকশ্রমিকদের এই বস্তিতে জমিরানের নাতনি ভাগ্যবান। তাঁর চাকরিও চলে গিয়েছিল, আবার হয়েছে।

টাকা পেলে আনন্দ লাগে? জমিরান কানে কম শোনেন। অন্যরা প্রশ্নটা বুঝিয়ে দিলে হাসিমুখে বলেন, ‘হ!...খাই! কাপড়টাপড় কিনি। ওষুধ খাই।’ নাতনিকে দেন না? জমিরান প্রবল বেগে হাত নেড়ে বলেন, ‘না!’

বিড়বিড় করে চলেন, ‘ওষুধবড়ি লাগে...তো তিন হাজার ট্যাহা তো কয় মাসে গেলই গিয়া খাইয়া!’ টাকা পেলে বড় খুশি তিনি, ‘তা আপনারা কিছু দিয়া যান!’

সমাজসেবা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট বলছে, সরকার চলতি অর্থবছরে ৪৯ লাখ দুস্থ নারী-পুরুষকে বয়স্ক ভাতা দিচ্ছে। বৃদ্ধারা ৬২ আর বৃদ্ধরা ৬৫ বছরে পৌঁছালে ভাতা পাওয়ার যোগ্য হন।

বয়স নির্ণয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র অথবা জন্মসনদ লাগে। সুস্থতা আর সহায়হীনতারও মাপকাঠি আছে। আছে অযোগ্যতার মাপকাঠি। আবেদনপত্র বাছাই করে তালিকা চূড়ান্ত করে দুই ধাপের স্থানীয় কমিটি।

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সরকার নির্দিষ্ট বয়সী দুস্থ ও অসহায় প্রবীণদের মাসে ৫০০ টাকা হিসাবে বছরে চার কিস্তিতে ভাতা দেয়। বৃদ্ধারা ৬২ আর বৃদ্ধরা ৬৫ বছরে পৌঁছালে ভাতা পাওয়ার যোগ্য হন। চলতি অর্থবছরে ভাতাভোগীর সংখ্যা ৪৯ লাখ।

কমিটিগুলোয় স্থানীয় সরকার ও সাংসদের প্রতিনিধিরাই মূল। প্রশাসনের প্রতিনিধিও থাকেন। সাংসদের সম্মতিক্রমে বিতরণের সূচনা হয়।

বয়স্কভাতা কর্মসূচি বাস্তবায়ন নীতিমালা ২০১৩ (সংশোধিত) পিডিএফ.pdf

কিন্তু ফুলমালার বয়স কত?

গত ৫ অক্টোবর আবার পশ্চিমপাড়া বস্তিতে গিয়েছিলাম। খুঁজে পাওয়া এনআইডি কার্ডটি হাতে হন্তদন্ত হয়ে ফুলমালা হাজির। পরনে ত্রাণে পাওয়া একই শাড়িটা।

আবারও ফুলমালা বলেন, ‘বয়স্ক ভাতার ট্যাহা পাই না। আমারে দেয় না তো! আমার বয়স দিছে ৫০ বছর। আপনে একটা ব্যবস্থা কইরা আমারে দিয়েন।’

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া আইডি কার্ডটি বলছে, মৃত রফিকুল ইসলামের স্ত্রী ও মৃত কাজলী বানুর কন্যা মোসাম্মাত ফুলমালা বেগমের জন্মতারিখ ১০ মে ১৯৬৬। তাঁর বয়স দাঁড়াচ্ছে ৫৪ বছর।

সেটাই কি ফুলমালার বয়স? তিনি ধন্দে পড়েন। পাশের জনকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আমার বয়স কত? ৬০? ৬০ হইব! আট্টু বেশিও হইতাম পারে।’

কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্রে ফুলমালার জন্মতারিখ এল কীভাবে?
ছবি: প্রতিবেদক

ফুলমালার মুখে কুণ্ঠিত হাসি, ‘আমি কইতা পারি না তো! আমার মা মারা গেছে তো আমারে ছুটো থুইয়া, বুঝেন না?’ দেশ স্বাধীনের বছরে তিনি কত বড় ছিলেন? মাথা নেড়ে হেসে বলেন, ‘আমি কইতা ফারুম না।’

তখন প্রশ্ন করি, ‘ওই যে পাকিস্তানের লগে যুদ্ধ হইল, কত মেলেটারি আসল, কত মানুষ মারা গেল...’ এবার তিনি বোঝেন,‘ও!’ কোমরের কাছে হাত দিয়ে দেখান, ‘তখন আমি এতটুকু।’

বয়স কত ছিল? ‘১০ বছরই হইব। ...আমি তো অত বুঝি নাইক্যা। ছুটো আছিলাম না?’ তখনো ‘সাবালক’ হননি।

ফুলমালা প্রতি–কথায় বলেন, ছোটকালে মা মারা গেছেন। যেন মা থাকলে তাঁর বয়সের হিসাবও থাকত। কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্রে তাঁর জন্মতারিখ এল কীভাবে?

ফুলমালা একটু দিশেহারা হয়ে যান। পাশ থেকে রেখা বলেন, ‘এই তারিখটা খালা তো বলতে পারব না। এই জন্য আইডিয়া কইরা দিসে।’

আর ফুলমালা বলেন, ‘আমারে জিগাইছে বয়স কত? আমি কইছি ৬০ দ্যান। তখন আরও একজন কইছে, না, ৫০ দ্যান।’

কার্ড কত বছর আগে করেছেন, সেটাও ফুলমালার মনে নেই। তবে তখন ‘হাসিনা আছিল, নৌকা আছিল।’ বিস্তর কথা বলে বুঝি, কার্ডটা ২০০৮ সালে জাতীয় পরিচয় ও ভোটার কার্ডের আদিপর্বে করানো।

স্রোতে ভেসে বয়স খোয়ানো

ফুলমালার দাঁতফোকলা হাসি মন থেকে মোছে না। ফোনে প্রতিবেশীদের কাছে আর মমিনুরকে পাঠিয়ে খোঁজখবর করতে থাকি। আর এভাবেই তাঁর জীবনের টুকরো কিছু গল্প মুখফেরতা জানতে পাই।

স্বাধীনতার দু-তিন বছর পর জামালপুরের কোনো এক গ্রামে পেটখারাপের মড়কে পরপর তাঁর মা-বাবা মারা যান। বাবার জমিসম্পত্তি ছিল। শিশু ফুলমালার জীবনের ঝুঁকি টের পেয়ে দাদি তাকে একদিন টঙ্গীর ট্রেনে তুলে দেন।

বাবা-মা মারা যাওয়ার পর জামালপুরের গ্রাম থেকে একা টঙ্গীতে চলে আসেন। মেয়ে পেটে থাকতে স্বামী মারা যান। দুঃখ-ধান্দার ঠেলা-ধাক্কায় নিজের বয়সটা ফুলমালা হারিয়েই ফেলেছেন।

তিন দিনের না-খাওয়া ফুলমালাকে টঙ্গী স্টেশনে কুড়িয়ে পান বস্তিবাসী জায়েদা। তিনি বলছেন, সেটা বঙ্গবন্ধু হত্যার পরের সময়। তিনিই ফুলমালাকে ১১ বছর পেলেপুষে বিয়ে দেন। দুই বছরের মধ্যে মেয়ে পেটে থাকতে সেই স্বামী মারা যান।

সেই মেয়ের বয়স এখন ৩২। আর দুঃখ-ধান্দার ঠেলা-ধাক্কায় নিজের বয়সটা ফুলমালা হারিয়েই ফেলেছেন।

বয়স আর বয়স্ক ভাতার ফের

২০১৩ সালের জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা বলছে, কারও বয়স ৬০ বছর হলে তিনি প্রবীণ হবেন। তিনি ‘জ্যেষ্ঠ নাগরিক’-এর স্বীকৃতি এবং নানান সুযোগ-সুবিধা পাবেন।

জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা ২০১৩ পিডিএফ.pdf

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর স্যাম্পল ভাইটাল রেজিস্ট্রেশন সার্ভে (এসভিআরএস, ২০১৯) বলছে, প্রবীণেরা জনসংখ্যার ৮ শতাংশ। সংখ্যা দাঁড়ায় ১ কোটি ৩৫ লাখের মতো।

জনসংখ্যায় ৬৫ বা তার বেশি বয়সীদের হার ৫ শতাংশ। দেশে প্রবীণ জনগোষ্ঠী দ্রুত বাড়ছে।

এনজিও রিসোর্স ইন্টিগ্রেশন সেন্টার (রিক) তিন দশকের বেশি হলো প্রবীণদের নিয়ে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক আবুল হাসিব খান আমাকে বললেন, ওই প্রজন্মের বয়স জানার জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র যথেষ্ট নয়। জন্মনিবন্ধনের তো প্রশ্নই নেই।

প্রতিবেশী প্রবীণ মানুষজন আর ঐতিহাসিক ঘটনার কথা মিলিয়ে তাঁদের বয়সটা বের করতে হয়। রিক দেখেছে, গ্রামের প্রবীণদের সংগঠিত করলে বয়সসহ ভাতাপ্রাপ্তির যোগ্যতা যাচাই তাঁরা নিজেরাই ভালো করতে পারেন।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো জুলফিকার আলীর স্ত্রীর এনআইডি কার্ডে জন্মসাল ১০ বছর এগোনো ছিল। তিনি বললেন, বিতর্ক উঠলে যোগ্য প্রার্থীর বয়স সংশোধন করিয়ে তাঁকে ভাতা পাওয়ানোর দায়িত্ব স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের।

সম্প্রতি একটি গবেষণায় মাঠে কাজের সূত্রে বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো নাজনীন আহমেদ এনআইডিতে বয়স বাড়ানোরও বেশ কিছু অভিযোগ পেয়েছেন। তিনি বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা নেই—এমন মানুষের বয়স নির্ণয়ের যথোপযুক্ত পদ্ধতি ঠিক করা দরকার।

আরও পড়ুন

বয়সই সব নয়

সর্বশেষ আদমশুমারিসহ একাধিক জরিপ ও গবেষণা বলছে, প্রবীণদের কমবেশি দুই-তৃতীয়াংশ আয়রোজগারহীন, নারীরা বিশেষভাবে। বয়স্ক ভাতার যোগ্য বয়সের শুরু নারীর ক্ষেত্রে ৬২ এবং পুরুষের ক্ষেত্রে ৬৫ বছরে। যোগ্য বয়সী এবং নিঃসহায় হলেই অবশ্য ভাতা পাওয়া যায় না।

প্রবীণ ও বয়স্ক ভাতা: জরিপ, গবেষণা ও মূল্যায়ন আছে অনেক
ছবি: প্রতিবেদক

এ কদিন মেলা গবেষণাপত্র, সরকারের জরিপ, মূল্যায়ন আর কৌশলপত্র ঘেঁটেছি। দারিদ্র্য, প্রবীণদের সমস্যা, সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম অথবা বয়স্ক ভাতা নিয়ে কাজ করেন—এমন ছয়জনের সঙ্গে কথা বলেছি।

এই গবেষক এবং সমাজকর্মীরা বলেছেন, সরকারি-বেসরকারি জরিপ-গবেষণাও দেখেছে, ভাতাভোগী বাছাইয়ে জনপ্রতিনিধিসহ প্রভাবশালীদের পছন্দ অগ্রাধিকার পায়, ভৌতিক বা অযোগ্য নাম ওঠে, যোগ্যজন বাদ পড়েন, টাকা নয়ছয় হয়, ঘুষ দিতে হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের ২০১৫-১৬ সালের একটি গবেষণায় জরিপভুক্ত ৯০ শতাংশ প্রবীণ বলেছিলেন, তাঁরা ভাতা পাওয়ার যোগ্য।পেতেন চারজনে একজন। গবেষক দলের সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলছেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় ভাতাভোগী বাছাই হওয়া এক বড় সমস্যা।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের ভাতা ব্যবস্থাপনায় যুক্ত একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বললেন, সমস্যাগুলো অনেকটা দূর হয়েছে। চলতি অর্থবছরে ভাতাভোগী বেড়ে প্রায় ৪৫ শতাংশ যোগ্য বয়সী প্রবীণ ভাতার আওতায় এসেছেন। তবে কার্যত কত, সে প্রশ্ন কিন্তু রয়ে যায়।

২০১৭ সালে সরকারের একটি প্রকল্প বয়স্ক ভাতা ও বিধবা ভাতার একটি মূল্যায়ন করিয়েছিল। সেটা বলছে, অযোগ্য বয়সী ভাতাভোগী যথেষ্ট থাকে। সেটা আমলে নিয়ে তখন অন্তর্ভুক্তির হারটা অনেকখানি কমে ২৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছিল। সচ্ছল প্রবীণের অন্তর্ভুক্তিও ছিল।

দেশের ৮ শতাংশ মানুষের জন্য এক-দেড় শতাংশ জিডিপি কি সরকার খরচ করবে না?
শরীফা বেগম

দারিদ্র্য দূর করার লক্ষ্যে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বার্ষিক বাজেট থেকে মাসে ১০০ টাকা করে দিয়ে বয়স্ক ভাতা কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ১৯৯৮ সালে। ৫০০ টাকায় উঠতে প্রায় দুই দশক লেগেছে। ভুল বাছাইসহ সমস্যাগুলোর কারণে সুফল বড় কম।

সরকারের জন্য ২০১৩ সালে বয়স্ক ভাতা কর্মসূচির জরিপভিত্তিক মূল্যায়ন করেছিলেন বিআইডিএসের অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র রিসার্চ ফেলো শরীফা বেগম। বললেন, অন্য সমস্যাগুলো তো আছেই, যাচাই-বাছাইয়েও প্রচুর খরচ আর অব্যবস্থাপনা হয়।

আরও পড়ুন

এই গবেষক ও সমাজকর্মীরা যেমনটা বলছেন, জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্রেও (২০১৫) আছে, ক্রমে ৬০ বা তার বেশি বয়সী সবার জন্য পেনশন চালু করাটাই হবে সঠিক সমাধান। প্রবীণদের বড় অংশটিই রাষ্ট্রের সহায়তা পান না। টাকাটাও বড় কম।

চলতি অর্থবছরে বয়স্ক ভাতার জন্য বরাদ্দ ৩ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। বাজেটের সেটা দশমিক ৫১ শতাংশ, আর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) শূন্য দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। এতে মোট প্রবীণের এক-তৃতীয়াংশ বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন।

শরীফা বেগম বললেন, সব প্রবীণকে ৫০০ টাকা করে দিলেও জিডিপির অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশই লাগবে। টাকার অঙ্কটা দ্বিগুণও করা সম্ভব। তাঁর প্রশ্ন, দেশের ৮ শতাংশ মানুষের জন্য এক-দেড় শতাংশ জিডিপি কি সরকার খরচ করবে না?

  • ২০২০-২১ সালের বাজেট: ৫,৬৮,০০০

  • মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি): ৩১,৭১,৮০০

  • ৪৯ লাখ প্রবীণকে বয়স্ক ভাতা দেওয়ার জন্য বরাদ্দ: ২,৯৪০ (বাজেটের ০.৫১%; জিডিপির ০.০৯%)

    * হিসাব কোটি টাকায়

শেষ কথা

বয়স যত বাড়ে, কাজের সুযোগ আর ক্ষমতা কমে। প্রতিবন্ধিতা আর অসুখ-বিসুখ বাড়ে। আশ্রিত বা সহায়হীন বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য তিন মাসে দেড় হাজার টাকাও অনেক।
শরীফা বলেন, ‘তাঁরা একটু ওষুধ কিনতে পারেন। ২০০টা টাকা নিজের নাতিদের জন্য খরচ করতে পারেন। তাঁর একটু সম্মান বাড়িতে বাড়ে।’ কিন্তু টাকাটা বাড়ানো দরকার।

করোনার কালে প্রবীণেরা রাষ্ট্রের একটু মমতা চান
ছবি: প্রতিবেদক

১৩ নভেম্বর এক প্রতিবেশীর মুঠোফোনে জমিরানের সঙ্গে কথা বলি। জ্বর-মাথা ঘুরানি নিয়ে তিনি বিছানায়। ডাক্তার-ওষুধ জোটেনি। তবে শুনলাম, তাঁর পরের কিস্তির টাকা আসছে।

আর ফুলমালা? তিনি এখনো বয়স্ক ভাতার আশায় আছেন।

৬০ পেরোনো আর বয়স হারানো এসব মানুষ করোনার এই কালে রাষ্ট্রের একটু মমতা তো চাইতেই পারেন?

ই-মেইল: [email protected]