বিশ্লেষণ: প্রবৃদ্ধির হিসাব
বছরে একবার নয়, জিডিপি গণনা চাই তিন মাস পরপর
করোনার সময়ে বিশ্বের সব অর্থনীতিবিদই একমত ছিলেন যে বিশ্বব্যাপীই এবার প্রবৃদ্ধি কমবে। কত হারে কমবে, সে ধারণাও দিয়েছিলেন অনেকে। আশ্চর্যজনকভাবে বিভিন্ন দেশে তা মিলেও গেছে। তবে বিশ্বের শীর্ষ ১০ জন অর্থনীতিবিদ এনে জড়ো করলেও বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাব যে বলতে পারতেন না, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। এমনকি, ধারেকাছে কোনো সংখ্যাই বলতে পারতেন না।
ভবিষ্যৎ বক্তা হিসেবে অর্থনীতিবিদদের সুনাম একেবারেই নেই। আর একজন বুদ্ধিমান অর্থনীতিবিদ কখনোই নিশ্চিত করে কিছু বলেন না। অর্থনীতিবিদেরা সব সময় আরেক হাতের ওপর ভরসা করেন। ‘অন দা আদার হ্যান্ড’ এবং ‘ইফ দা আদার থিংক রিমেইন কনস্টান্ট’ অর্থনীতিবিদদের সবচেয়ে প্রিয় কথা। পিটার লরেন্স নামের কানাডার একজন লেখক তো বলেছিলেন, ‘অর্থনীতিবিদ হচ্ছেন এমন একজন বিশেষজ্ঞ, যিনি আগামীকাল জানবেন গতকাল যে ভবিষ্যদ্বাণী তিনি করেছিলেন, আজ কেন তা ঘটেনি।’
তবে করোনার সময়ে বিশ্বের সব অর্থনীতিবিদই কিন্তু একমত ছিলেন যে বিশ্বব্যাপীই এবার প্রবৃদ্ধি কমবে। কত হারে কমবে, সে ধারণাও দিয়েছিলেন অনেকে। আশ্চর্যজনকভাবে বিভিন্ন দেশে তা মিলেও গেছে। এমনকি পাশের দেশ ভারতেও। তবে বিশ্বের শীর্ষ ১০ জন অর্থনীতিবিদ এনে জড়ো করলেও বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাব যে বলতে পারতেন না, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। এমনকি, ধারেকাছে কোনো সংখ্যাই বলতে পারতেন না।
ভারতের ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক্যাল অফিস জানিয়েছে, তাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার শূন্যের নিচে নেমে গেছে। গত ৪০ বছরের মধ্যে এই প্রথম জিডিপি শূন্যের নিচে নামল। অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকেরা আগে থেকে যে আশঙ্কা করেছিলেন, তা-ই হয়েছে।
আগে পাশের দেশ ভারতের কথা বলা যাক। দেশটির ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক্যাল অফিস জানিয়েছে, তাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার শূন্যের নিচে নেমে গেছে। গত ৪০ বছরের মধ্যে এই প্রথম জিডিপি শূন্যের নিচে নামল। অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকেরা আগে থেকে যে আশঙ্কা করেছিলেন, তা-ই হয়েছে। এমনকি সর্বোচ্চ কত শতাংশ পর্যন্ত জিডিপি কমতে পারে, সেই অনুমানও প্রায় নির্ভুল হয়েছে। ভারতের জিডিপি এবার আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ। এখানে বলে রাখা ভালো, ভারতে অর্থবছর শুরু হয় এপ্রিল থেকে পরের বছরের মার্চ পর্যন্ত। আর জিডিপি প্রবৃদ্ধির এই হিসাব অর্থবছরের প্রথম তিন মাসের (এপ্রিল-জুন)। আগের ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ভারতে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ১ শতাংশ।
খুব স্বাভাবিকভাবেই করোনা পরিস্থিতির কারণে ভারতের জিডিপির এই হাল। এ সময়ে লকডাউনের কারণে দেশটির অর্থনীতি কার্যত অচলই ছিল। সুতরাং, জিডিপি যে শূন্যের নিচে নেমে যাবে, তা অবধারিতই ছিল। জিডিপির এই তথ্য প্রকাশের দুই দিন আগে ভারতের অর্থনীতি নিয়ে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ, বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর একটি দীর্ঘ লেখা প্রকাশ করেছে স্থানীয় একটি পত্রিকা। সেখানে তিনি করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ভারত যে অত্যন্ত দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছে, সে কথা বলেছেন। বিশেষ করে তেমন কোনো প্রস্তুতি ও ভালো একটি ত্রাণ বিতরণ কর্মসূচি ছাড়াই দ্রুত লকডাউন নীতির সমালোচনা করেছেন তিনি। কৌশিক বসু আরও বলেছেন, এমন নয় যে কেবল করোনার সময় অর্থনীতি অচল ছিল বলে এই বিপত্তি। বরং করোনাভাইরাসের আগে থেকেই অর্থনীতি ছিল নিম্নমুখী। উৎপাদন খাত, গাড়ি নির্মাণ, সেবা—সব খাতেরই সূচক কমছিল। আর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনাভাইরাস।
ভারতে মাত্র তিন মাস বা প্রথম প্রান্তিকের জিডিপির হিসাব পাওয়া গেছে। আরও তিন প্রান্তিক বাকি আছে। তবে প্রথম তিন মাসই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এ সময়ে সারা বিশ্বই বলতে গেলে কার্যত অচল ছিল। তবে অর্থবছরের বাকি সময়ে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ আছে। আর তিন মাসের পরিসংখ্যান পাওয়ায় দেশটির পক্ষে সামনের জন্য পরিকল্পনা করাও হয়তো সহজ হবে। ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে জিডিপি গণনার এটাই বড় সুফল।
বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ। সাধারণত প্রথম ৮-৯ মাসের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে বিবিএস ওই অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির সাময়িক হিসাব দেয়। সেভাবেই জিডিপি প্রবৃদ্ধির একটি ধারণা দেওয়া হয় জাতীয় বাজেট পেশের সময়।
বিপত্তি দেখা দিয়েছে বাংলাদেশ নিয়ে। বাংলাদেশে জিডিপির পরিসংখ্যান তৈরি করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। তারা হিসাব দিয়ে বলেছে, বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ। সাধারণত প্রথম ৮-৯ মাসের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে বিবিএস ওই অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির সাময়িক হিসাব দেয়। সেভাবেই জিডিপি প্রবৃদ্ধির একটি ধারণা দেওয়া হয় জাতীয় বাজেট পেশের সময়। জুন মাসের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহের ক্ষেত্রে এই ধারা ঠিকই আছে। কিন্তু অর্থবছর শেষ হওয়ার প্রায় ২ মাস হওয়ার পরও যদি ৯ মাসের প্রবণতা দেখে জিডিপির হিসাব প্রকাশ করা হয়, তখন নানা প্রশ্ন উঠবেই। তা ছাড়া, করোনার আগেই যেখানে বেশির ভাগ সূচক আগের মতো তেজি ছিল না।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী প্রাক্কলন করে বলেছিলেন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপি ৫ দশমিক ২ শতাংশ হতে পারে। দেখে মনে হচ্ছে, যেহেতু অর্থমন্ত্রী বলেই দিয়েছেন, সুতরাং বিবিএসের দায়িত্ব হচ্ছে জিডিপি ৫ দশমিক ২ শতাংশ করা। প্রতিবারই অবশ্য এই কাজই করা হয়। তবে গোল বাধিয়েছে করোনাভাইরাস। বিবিএস পুরোনো সিলেবাসেই পরীক্ষা দিয়েছে, কিন্তু সিলেবাস যে বদলে গেছে, তা আর মনে রাখেনি। কেননা, বিবিএস যে তিন মাসকে আমলে নেয়নি, সেই তিন মাসে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিল স্থবির। ফলে জিডিপির এই হিসাব বিশ্বাসযোগ্য হয়নি।
করোনা মহামারির সময়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সব দেশই প্রণোদনা ও পরিকল্পনার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। এই পরিকল্পনার জন্য প্রয়োজন সঠিক তথ্য। করোনাভাইরাসে সারা বিশ্বের অর্থনীতি যেখানে পর্যুদস্ত, সেখানে ৫ শতাংশের বেশি জিডিপি অর্জন বড় সাফল্য। আর তাহলে তো প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনারও প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। প্রণোদনা ছাড়া অর্থনীতির পুনরুদ্ধার প্রায় অসম্ভব। তা ছাড়া, করোনার এই সময়ে জিডিপি কম হলেও কেউ সরকারকে দায়ী করত না। কিন্তু জিডিপি নিয়ে অতিরিক্ত স্পর্শকাতরতা একে রাজনীতিকরণের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
সারা বিশ্ব যেখানে অবাধ তথ্যপ্রবাহকে গুরুত্ব দিচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে দেখা যায় তথ্য লুকানোর প্রবণতা। একসময় তিন মাস পরপর শ্রম জরিপ প্রকাশ করা শুরু করেছিল বিবিএস। কিন্তু একবার বেকারত্বের হার বৃদ্ধির তথ্য পাওয়া যাওয়ার পর তাও বন্ধ করে দেওয়া হয়। ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে জিডিপি গণনা এবং তা প্রকাশ করার কথা উঠলেও অনুমোদন পাচ্ছে না। এর একটি প্রস্তাব পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে জমা আছে, কিন্তু সিদ্ধান্ত হয় না। অথচ এটাই প্রচলিত রীতি। অর্থনীতির সঠিক একটি চিত্র তিন মাস পরপর জানা গেলে পরিকল্পনা নেওয়াও সহজ হতো। এর পরিবর্তে এখন অনেক পরিকল্পনাই নিতে হয় ধারণার ওপর ভিত্তি করে।
জিডিপির হিসাব তিন মাস পরপর করতে হবে—এই দাবি মনে হয় এখন জোরালোভাবেই করা যায়। আর তাতে অর্থনীতির একটা মোটামুটি সঠিক চিত্র হয়তো পাওয়া যাবে, যদি তাতে হস্তক্ষেপ করা না হয়। তাতে লাভবান হবে অর্থনীতি ও অর্থনীতির সব মানুষ। করোনাভাইরাস দুনিয়ার অনেক কিছুই বদলে দিয়েছে। অনেক কিছুই নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। জিডিপি গণনার পদ্ধতিও না হয় এবার বদলে যাক। কমে যাক জিডিপির মোহ। ভালো থাকা ও ভালো রাখা হোক সব পরিকল্পনার মূল কথা।