সোনার ভরি লাখের কাছাকাছি, রাখবেন, বেচবেন, না কিনবেন

চলতি সপ্তাহের গোড়াতে দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ দামে পৌঁছে গিয়েছিল সোনা। শনিবার দেওয়া এক ঘোষণায় প্রতি ভরি সোনার দাম নির্ধারণ করা হয় ৯৮ হাজার ৭৯৪ টাকা। লাখ টাকার চেয়ে মাত্র ১ হাজার ২০৬ টাকা কম। তবে তিন দিন পর খানিকটা কমানো হয়েছে মূল্যবান এই ধাতুর দাম।

মঙ্গলবার বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রতি ভরি সোনার দাম কমবে ১ হাজার ১৬৬ টাকা। তাতে ভালো মান, অর্থাৎ ২২ ক্যারেটের এক ভরি সোনার দাম দাঁড়ায় ৯৭ হাজার ৬২৮ টাকায়। দর কমলেও এটি দেশের ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দাম। আজ বুধবার থেকে সারা দেশে নতুন দামে সোনার অলংকার বিক্রি হচ্ছে।

বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি সোনার দাম সাধারণত ভরিতে এক থেকে দেড় হাজার টাকা সমন্বয় অর্থাৎ বৃদ্ধি বা হ্রাস করে। করোনাকালে একবার ৫ হাজার ৮২৫ টাকা বৃদ্ধি করেছিল তারা। তবে শনিবার সোনার দাম ভরিতে একলাফে ৭ হাজার ৬৯৮ টাকা বাড়ানোর ঘোষণা দেয় সমিতি। একদফায় সোনার দাম এতটা আগে কখনোই বাড়েনি।

আরও পড়ুন

কেন এত দাম

বিশ্ববাজারে হঠাৎ সোনার দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণেই দেশেও তা লাখ টাকা ছুঁই ছুঁই অবস্থায় চলে যায়। বিশ্ববাজারে গত ৮ থেকে ১৭ মার্চ পর্যন্ত ১০ দিনে প্রতি আউন্স (৩১.১০৩৪৭৬৮ গ্রাম) সোনার দাম ১৭৩ ডলার বেড়ে ১ হাজার ৯৮৮ ডলারে ওঠে। যদিও বিশ্ববাজারের এই দাম ইতিহাসের সর্বোচ্চ নয়। ২০২০ সালের ৬ আগস্ট সোনার দাম ইতিহাসে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৭০ ডলারে উঠেছিল। তখন দেশে সোনার ভরি ছিল ৭৭ হাজার ২১৬ টাকা।

এবারে অবশ্য মূল কারণ কিছুটা ভিন্ন। সেই কারণ ডলারের বিপরীতের টাকার অবমূল্যায়ন। মূলত এ কারণেই এবার বিশ্ববাজারে প্রতি আউন্স সোনার দাম দুই হাজার ডলার না ছাড়ালেও দেশে প্রতি ভরির দাম লাখ টাকার কাছাকাছি পৌঁছে যায়। ভারতেও সোনার দাম রেকর্ড উচ্চতায় উঠেছে। সপ্তাহের শুরুতে সেখানে ১০ গ্রাম পাকা সোনার দাম ছিল ৫৮ হাজার ২২০ রুপি।

সোনাকে বলা হয় ‘সেফ হেভেন’। সোনায় বিনিয়োগ সব সময়ই নিরাপদ। যদিও দামি এই ধাতুটির সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। অনিশ্চয়তার সময়টাই আসলে সোনার স্বর্ণসময়। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় প্রতি আউন্স সোনার দাম ইতিহাসের সর্বোচ্চ দরে পৌঁছায়।

আরও পড়ুন

আবার এক বছর আগে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্ব অর্থনীতি নতুন করে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। দেশে দেশে মূল্যস্ফীতির রেকর্ড হতে থাকে। তখন সোনার দামও পাল্লা দিয়ে বাড়ে। গত বছরের ৮ মার্চ বিশ্ববাজারে প্রতি আউন্স সোনার দাম ২ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যায়। তারপর কমতে থাকে।

যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ও সিগনেচার ব্যাংক বন্ধ হওয়ার পর আমানতকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। গ্রাহকেরা ছোট ও মধ্যম সারির ব্যাংক থেকে আমানত তুলে বা সরিয়ে নিতে শুরু করেন। তাতে আরও কয়েকটি ব্যাংক ঝুঁকিতে পড়ে। জে পি মরগ্যান ও সিটি গ্রুপের নেতৃত্বে ১১টি ব্যাংক সান ফ্রান্সিসকোভিত্তিক ফার্স্ট রিপাবলিক ব্যাংকের পতন ঠেকাতে ৩০ বিলিয়ন বা ৩ হাজার কোটি ডলার আমানত দেয়।

যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকিং খাতের অস্থিরতার মধ্যেই সুইজারল্যান্ডের অন্যতম বড় ব্যাংক ক্রেডিট সুইস ব্যাংক তারল্যসংকটে পড়ে। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরামর্শ ও তত্ত্বাবধানে ক্রেডিট সুইসকে শেষ পর্যন্ত ইউবিএস কিনে নেয়। পশ্চিমা বিশ্বের আর্থিক খাতের এই বিশৃঙ্খলার মধ্যেই মূলত সোনার দাম তড়তড়িয়ে বাড়তে থাকে।

গত শনিবার প্রকাশিত রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের একজন ধাতু ব্যবসায়ীকে উদ্ধৃত করা হয়। তাই ওন নামের ওই ব্যবসায়ী বলেন, ব্যাংক খাতে আরও খারাপ সংবাদ আসতে পারে এবং ফেড সুদের হার বাড়াতে পারে, এই আশঙ্কায় সোনার দাম বাড়ছে।

কী করবেন

বিশ্ববাজারে সোনার দাম বাড়লে বাংলাদেশেও বাড়ে। আর কমলেও কমে। সোনার দাম একলাফে ভরিতে সাড়ে সাত হাজার টাকা বেড়ে যাওয়ায় সিন্দুকে থাকা পুরোনো অলংকারের দামও বেড়ে গেছে। ফলে বিক্রি করতে গেলেই এখন মিলবে ভালো মুনাফা। মুনাফা কত মিলবে, সেই হিসাবও আপনি ঘরে বসেই করতে পারবেন। যদি পুরোনো অলংকার কেনার রসিদ আপনার সংগ্রহে থাকে। সেই রসিদে অলংকার কত ক্যারেটের এবং ওজন কত, তা উল্লেখ থাকে।

সাধারণত পুরোনো অলংকার জুয়েলার্সে বিক্রি করতে গেলে প্রথমেই তারা সেটি কত ক্যারেটের, এ বিষয়ে নিশ্চিত হবে। তারপর অলংকারটির বর্তমান ওজন থেকে ২০ শতাংশ বাদ দিয়ে মূল্য নির্ধারণ করা হবে। ধরা যাক, ২০১৫ সালে ২২ ক্যারেটের এক ভরি ওজনের অলংকার কিনেছিলেন। তখন সোনার ভরি ছিল ৪৩ হাজার ১৪ টাকা। এখন সেটি বিক্রি করতে গেলে আপনি ৭৮ হাজার ১০২ টাকা পাবেন। তাতে ভরিতে আপনার মুনাফা হবে ৩৫ হাজার ৮৮ টাকা।

আরও পড়ুন

২০১৫ সালের আগে কেনা অলংকার বিক্রিতে মুনাফা আরও বেশি পাবেন। তবে যদি ২১ ও ১৮ ক্যারেট সোনার অলংকার হয়, তাহলে মুনাফার পরিমাণ ভিন্ন হবে।

বর্তমানে সোনার দাম যেখানে উঠেছে, তাতে সোনার পুরোনো অলংকার বিক্রি নিঃসন্দেহে লাভজনক। অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে, দাম যেহেতু বাড়ছে, তাই আরও কিছুদিন অপেক্ষা করা যাক।

এ বিষয়ে চলতি সপ্তাহে আমরা বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিলীপ কুমার আগারওয়ালের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলেছিলাম। তিনি বললেন, পশ্চিমা ব্যাংক খাত নিয়ে আতঙ্ক তৈরি হওয়ায় নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে সোনা কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা। তাতে সোনার সংকট দেখা দিয়েছে। সোনার উৎপাদন বাড়লেও তা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় না হওয়ার কারণেই এমনটি হয়েছে।

প্রথম আলোকে দিলীপ কুমার আগারওয়াল আরও বলেন, ‘আমাদের ধারণা, বিশ্ববাজারে প্রতি আউন্স সোনার দাম ২ হাজার ডলার ছাড়াবে। তারপর আবার দাম কমবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক খাতের অবস্থা যদি আরও খারাপ হয়, তাহলে ২ হাজার ২০০ ডলারে যেতে পারে সোনার দাম।’

নিজের দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে সোনার দাম বাড়লে ক্রেতাদের একটি অংশ বিক্রি করেন। আরেকটি অংশ মনে করেন, সোনার দাম আরও বাড়বে।’