পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা এখন কোন পথে হাঁটবেন

নিজের কারখানায় লেখক শেখ এইচ এম মোস্তাফিজ
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

করোনা–পরবর্তী পরিবর্তিত বিশ্বে আমাদের পোশাকশিল্প যখন একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল, তখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা। সারা বিশ্বের অর্থনীতির গতিপ্রকৃতিতে পরিবর্তনের ঢেউ লাগল। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম লাগামহীনভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় মূল্যস্ফীতির পারদ বাড়তে থাকল। জনজীবনে নেমে এল দুর্ভোগ। বিশ্বের সব দেশের মানুষ প্রাত্যহিক জীবনের ব্যয়ে লাগাম টেনে ধরতে বাধ্য হলেন। প্রথমেই পোশাক কেনার তালিকায় কাঁচি চালালেন ভোক্তারা। তারপর খাদ্যসহ অন্যান্য ব্যয়ও কমালেন। ফলে পোশাকের দোকানের বেচাবিক্রিতে ধস নামল। গুদামে জমতে থাকল পণ্যের পাহাড়। সেই জেরে পোশাক উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে আমাদের ক্রয়াদেশেও ভাটার টান।

পৃথিবীজুড়ে নিত্যপণ্য নয়, এমন জিনিসপত্রের চাহিদার এই উত্থান-পতন চলতেই থাকবে। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আমাদের টিকে থাকতে হলে কৌশলী হতে হবে। স্রোতে গা না ভাসিয়ে দিয়ে স্রোতের বিপরীতে হলেও একটু ভিন্নভাবে চিন্তাভাবনা করতে হবে আমাদের। তাহলেই আমরা আমাদের শিল্পকারখানা টেকসই করতে পারব। তবে সেই পথ কোনটা, সেটি বেছে নিতে হবে উদ্যোক্তাদের নিজেদেরই। সেই পথের সন্ধান করতেই কয়েকটি কথা বলতে চাই।

কারখানা মুনাফাভিত্তিক পরিচালনা কৌশলে আপনি লাভ কম করলেও ভর্তুকি দিয়ে লোকসানে ক্রয়াদেশ নেওয়ার চেয়ে ভালো থাকবে। আপনার দুশ্চিন্তাও কমবে। আপনার শ্রমিকের চাকরির নিশ্চয়তাও থাকবে। তবে সক্ষমতাভিত্তিক পরিচালন পদ্ধতিতে আপনি সব সময়ই বিপদে থাকবেন।

সক্ষমতা নাকি মুনাফাভিত্তিক পরিচালনা
বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পে দশকের পর দশক ধরে কারখানার উৎপাদন সক্ষমতার ভিত্তিতে ক্রয়াদেশ নিয়ে থাকেন উদ্যোক্তা। পরিষ্কার করে বলা যাক, আমার কারখানায় যদি এক মাসে ১০ লাখ পোশাক উৎপাদন করার সক্ষমতা থাকে, তাহলে সেটি পূরণ করার চিন্তাভাবনা থেকেই ক্রেতার সঙ্গে দেনদরবার করি। এতে যেটি হয়, অধিকাংশ সময় আমরা সক্ষমতার ৬০-৮০ শতাংশ ক্রয়াদেশ মুনাফা ভিত্তিতে নিই। আর বাকিটা লোকসান দিয়ে হলেও পূর্ণ করার চেষ্টা করি। এতে যেটা হয়, আমরা যেসব ক্রয়াদেশে মুনাফা করি, সেখান থেকে ভর্তুকি দিয়ে লোকসানে নেওয়া ক্রয়াদেশ শিপমেন্ট করি। এর পেছনে আমাদের চিরন্তন যুক্তি হচ্ছে, লোকসান কম হবে। এটা ভুল কৌশল। আমাদের উচিত হবে, লোকসানি ক্রয়াদেশ ছেড়ে দেওয়া। শুধু যেসব ক্রয়াদেশে সামান্য হলেও মুনাফা থাকবে, সেগুলোই নিতে হবে। এর পাশাপাশি কারখানার সক্ষমতা যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনা। কারণ, মেশিন বসে থাকলে আপনার কোনো খরচ নেই, তবে কর্মী বসে থাকলে কিন্তু বেতন দিতে হবে। তার মানে কারখানা মুনাফাভিত্তিক পরিচালনা কৌশলে আপনি লাভ কম করলেও ভর্তুকি দিয়ে লোকসানে ক্রয়াদেশ নেওয়ার চেয়ে ভালো থাকবে। আপনার দুশ্চিন্তাও কমবে। আপনার শ্রমিকের চাকরির নিশ্চয়তাও থাকবে। তবে সক্ষমতাভিত্তিক পরিচালন পদ্ধতিতে আপনি সব সময়ই বিপদে থাকবেন।

আরও পড়ুন

কর্মসংস্থান নাকি শ্রমিকের জীবনমান
শুনতে কিছুটা খারাপ শোনালেও কথাটি কিন্তু বাস্তব। কথাটি হচ্ছে, আমরা শিল্পমালিকেরা প্রতিবছর কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য সরকারের কাছে চুক্তিবদ্ধ নই। তবে যেসব শ্রমিককে আমরা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছি, তাঁদের দেখভাল আমাদের করতেই হবে। এটি অবশ্য পালনীয় দায়িত্ব। তাঁদের সময়মতো বেতন, অধিকার নিশ্চিত, পারিবারিক ও আর্থসামাজিক খাতের নিরাপত্তা, সামাজিক ন্যায্যতা ও সুরক্ষা প্রদান ইত্যাদি শতভাগ নিশ্চিত না করে শুধু কর্মসংস্থানের সংখ্যা বৃদ্ধি করে বাহবা নেওয়ার দিন শেষ হয়ে গেছে। একসঙ্গে অনেক শ্রমিক কাজ করলে সেটির ব্যবস্থাপনা কঠিন। চুন থেকে পান খসার ঝুঁকিও রয়েছে। সে কারণে উদ্যোক্তাদের সব সময় একটা টেনশনে থাকতে হয়। মুনাফা ছাড়া ক্রয়াদেশ নিয়ে হলেও তাঁদের মজুরি সময়মতো দেওয়ার জন্য আমরা ব্যবসার ইকোসিস্টেম নষ্ট করে ফেলি। ফলে যেটি হয়, বিদেশি ক্রেতার কাছ থেকে আমরা পণ্যের ন্যায্যমূল্য আদায় করতে পারি না।

ক্রেতা নির্ভরশীলতা নাকি রপ্তানি বহুমুখিতা
আমাদের অনেক কারখানাই অল্প কিছুসংখ্যক ব্র্যান্ড ও ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানকে নিয়েই ব্যস্ত থাকি। মানে সারা বছর ঘুরে ফিরে তাদের জন্যই পোশাক বানাই। স্বাভাবিক সময়ে এতে বড় কোনো সমস্যা না থাকলেও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সমস্যা বা অন্য কোনো অস্থিরতা দেখা দিলেই সংকট তৈরি হয়। তখন সেই ব্র্যান্ড ও ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো পোশাকের উৎপাদন স্থগিত, শিপমেন্টের তারিখ পেছানো, নতুন ক্রয়াদেশ দেওয়া বন্ধ করাসহ বিভিন্ন নির্দেশ দেয়। এতে আমরা উৎপাদনকারীরা বিপাকে পড়ি। তাই ব্র্যান্ড ও ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়াতে হবে। সে জন্য প্রতিটি কারখানাকে বিপণনে জোর দিতে হবে। সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে, সেসব কারখানার নিজস্ব বিপণন বিভাগ নেই, তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মধ্যস্বত্বভোগী বায়িং হাউসের কাছ থেকে কাজ নিয়ে থাকে। সেখানে দর-কষাকষির সুযোগ খুবই সীমিত। বায়িং হাউসের কাজের পাশাপাশি নিজস্ব বিপণনবলয় গড়ে তুলে ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরাসরি ব্যবসা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে পণ্যের বহুমুখীকরণ ও রপ্তানি বাজার বহুমুখীকরণ। বহুমুখী ক্রেতা তৈরি করতে সুনির্দিষ্ট পণ্যের বাইরে নতুন পণ্য উৎপাদনের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। নতুন বাজারে প্রবেশের মাধ্যমে নির্দিষ্ট ক্রেতার ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে পারলেই আমরা আমাদের ব্যবসাকে টেকসই করতে পারব। পণ্য বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে কাপড়ে বৈচিত্র্যকরণ ও পণ্যের মূল্য সংযোজন বাড়াতে হবে। যেসব পোশাক তৈরি কিছুটা কঠিন, সেগুলো উৎপাদনে নিজেদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। পণ্যের বহুমুখীকরণ আপনার ক্রেতার সংখ্যা বাড়াতে সাহায্য করবে।

আরও পড়ুন

উৎপাদনে বিনিয়োগ নাকি সংযোগশিল্পে
শিল্প পরিচালনায় আমাদের একটি সাধারণ কৌশল হচ্ছে, উৎপাদনে বিনিয়োগ বাড়ানো। বিদেশি ক্রেতার মৌখিক আশ্বাসের ভিত্তিতে আমরা দিনের পর দিন শুধু পোশাক সেলাইয়ের সক্ষমতা বাড়িয়ে চলেছি। মোটা অঙ্কের ব্যাংকঋণ নিয়ে হলেও ক্রেতার চাহিদা মেটাতে কাজটি করেন অনেক উদ্যোক্তা। এতে কর্মীর সংখ্যাও বাড়ে। আজ যখন বিশ্ববাজারে পোশাকের চাহিদা কমে গেছে, তখন বিশাল কর্মী বাহিনী নিয়ে আমরা পড়েছি বিপদে। তাঁদের বেতন-ভাতা কীভাবে আসবে, সেই চিন্তায় অনেকেই চোখেমুখে অন্ধকার দেখছেন।

চার দশকের যাত্রায় তৈরি পোশাকশিল্প অনেক দূর এগিয়েছে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক বাংলাদেশ। তারপরও এখনো বাংলাদেশের ৬০ শতাংশ কাঁচামাল আমদানি চীন থেকেই হয়। কিন্তু আমদানিনির্ভরতা কমাতে আমাদের উদ্যোক্তাদের মধ্যে উদ্যোগ তুলনামূলক কম। আমরা পশ্চাৎমুখী শিল্পে বিনিয়োগ করে আত্মনির্ভরশীল না হয়ে নগদ আয়ের দিকে বিনিয়োগ করেছি অপরিকল্পিতভাবে। তার ফলাফলই কিন্তু আজকের হাহাকার। অনেকেই হয়তো তর্কের খাতিরে যদি বা কিন্তু দিয়ে কিছু যৌক্তিকতা তুলে ধরতে পারবেন, তবে দিন শেষে আমরা ব্যবসার কৌশলের কাছে মার খেয়েছি। এর সুবিধা তুলে নিয়েছে ভিয়েতনাম ও ভারত। কৃত্রিম তন্তুর কাপড় উৎপাদনের কিছু বস্ত্রকল থাকলে আমাদের ভয়টা তুলনামূলক কমই থাকত। বরং তখন আমরা টেকনিক্যাল টেক্সটাইল, হাই অ্যান্ড ফ্যাশন টেক্সটাইল ইত্যাদিতে বিনিয়োগ করতে পারতাম।

উৎপাদনশীলতা নাকি কাঁচামালের সরবরাহ আগে
আমাদের কারখানায় উৎপাদনশীলতা একটা বড় সমস্যা। বিষয়টি অনেক বছর ধরেই চিহ্নিত। আমরা সবাই বিষয়টি নিয়ে কমবেশি কাজও করি। তবে একটা বিষয় হচ্ছে, একটা ক্রয়াদেশ প্রাপ্তি থেকে শুরু করে পণ্য জাহাজীকরণের মাত্র ১০ শতাংশ সময় পণ্য উৎপাদনের জন্য পেয়ে থাকি। ধরা যাক, একটা ক্রয়াদেশ আমরা ৬০ দিনে জাহাজীকরণের জন্য নিলাম। এই দুই মাসের শেষ ৬ দিনে আমরা পণ্যটি উৎপাদন করি। বাকি ৫৪ দিন শুধু কাঁচামালের জোগান এবং ক্রেতার অনুমোদনপ্রক্রিয়ার জন্য আমরা ব্যয় করে থাকি। ফলাফল হচ্ছে, যেদিন আমরা উৎপাদনে যাই, সেদিন গিয়ে আবিষ্কার করি, আমাদের ওই কাজের অনুমোদন হয়নি অথবা ওই কাঁচামাল এখনো কারখানায় আসেনি। অর্থাৎ ৫৪ দিনের উৎপাদনশীলতার কোনো জবাবদিহি আমাদের ব্যবস্থাপনায় এখনো পরিশুদ্ধ করতে পারিনি। কিন্তু বাকি ৬ দিনের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে আমরা কোটি কোটি টাকা খরচ করছি। আমাদের এ কৌশলে পরিবর্তন আনতে হবে। আমার নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, সময়মতো সঠিক কাঁচামালের সরবরাহ এবং ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের অনুমোদন সম্পন্ন করতে পারলে আপনা–আপনি উৎপাদনশীলতা বেড়ে যায়। আমাদের মূল সমস্যা সরবরাহব্যবস্থায়, উৎপাদনশীলতায় নয়।

আরও পড়ুন

উৎপাদন পরিকল্পনা নাকি পরিকল্পিত উৎপাদনব্যবস্থা
আরেকটি কৌশলগত পরিবর্তন দরকার, সেটি হলো পরিকল্পিত উৎপাদনব্যবস্থা। আমরা এখন উৎপাদন পরিকল্পনার ভিত্তিতে উৎপাদন করে থাকি। তবে তার সিংহভাগই সঠিক সময়ে করতে পারি না। অর্থাৎ যেদিন যে ক্রয়াদেশের পণ্য উৎপাদন করার কথা, আমরা পরিকল্পনা অনুযায়ী করতে পারি না। আমাদের কৌশল হতে হবে পরিকল্পিত উৎপাদনব্যবস্থা। অর্থাৎ যেদিন যে অর্ডার পরিকল্পনা করা হবে, ওই দিন অবশ্যই তা উৎপাদন করতে হবে। আমরা যদি শুধু এটুকু করতে পারি, তাহলে কারখানায় নতুন করে সেলাই মেশিনের নতুন বিনিয়োগ করতে হবে না। আপনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ২০-৩০ শতাংশ নতুন সক্ষমতার অধিকারী হবেন।

রপ্তানি আয় বৃদ্ধি আগে নাকি নদীদূষণ রোধ
রপ্তানি আয় ক্রমাগত বাড়াতে হবে—এই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় পড়ে আমরা কী না করে থাকি। আমাদের ডায়িং কারখানায় বর্জ্য পরিশোধনের ব্যবস্থা (ইটিপি) থাকা সত্ত্বেও কারখানাগুলো পাশের নদীর পানি দূষিত ও অব্যবহারযোগ্য করে ফেলা হয়। তার মানে, খরচ বাঁচাতে গিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে আমরা বর্জ্য নদীতে ফেলছি। একদিন হয়তো আমাদের পকেটে বিলিয়ন ডলারের অর্থ থাকবে। তবে খাওয়ার জন্য একটা মাছবাজারে পাওয়া যাবে না। তাই রপ্তানি আয় বৃদ্ধির আগে আমাদের দায়িত্ববোধসম্পন্ন উৎপাদনকারী হতে হবে। মানুষ, পরিবেশ, প্রতিবেশ ইত্যাদি ধ্বংস করে আমাদের এই উৎপাদনব্যবস্থা টেকসই হবে না। সেটা তো সবাই মানেন যে টাকা দিয়ে পণ্য কিনে খাওয়া যায়; টাকা নয়। তাই আসুন, সময় থাকতে সচেতন হই। পরিবেশটা বাঁচাই।

লেখক: শেখ এইচ এম মোস্তাফিজ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, কিউট ড্রেস ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড
ইমেইল: [email protected]