সপ্তাহের শুরুতেই জেনে নিই অর্থনীতি কেমন করছে

বিদায়ী বছরের শেষের দিকে বলা হয়েছিল ২০২৩ সাল হবে বিশ্ব অর্থনীতির জন্য আরও খারাপ বছর। তবে এখন বলা হচ্ছে, মূল্যস্ফীতির চাপ কিছুটা কমতে পারে। যদিও অর্থনীতির সংকোচন ঠিকই থাকবে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের পরিস্থিতি কেমন হবে। তাহলে আসুন দেখে নিই, চলতি সপ্তাহে বাংলাদেশের অর্থনীতি কী অবস্থায় আছে। আর দেখাটা হোক সংখ্যায় সংখ্যায়।

আরও পড়ুন
৩২৩০ কোটি ডলার
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপে

হিসাবটি কোটি ডলারের। অর্থাৎ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুতের পরিমাণ এখন ৩ হাজার ২২৯ কোটি ৫২ লাখ ডলার। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মেনে এখান থেকে ৮১০ কোটি ডলার বাদ দিতে হবে। তাতে রিজার্ভ দাঁড়াচ্ছে ২ হাজার ৪১৯ কোটি ৫২ লাখ ডলার। অথচ ঠিক এক বছর আগে এই রিজার্ভ ছিল ৪ হাজার ৫১৫ কোটি ৯০ লাখ ডলার। এই অর্থ দিয়ে প্রায় চার মাসের সমান আমদানি ব্যয় নির্বাহ করতে পারবে বাংলাদেশ। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের ওপর একধরনের চাপ আছে।

১০৬.২৯৬৪ টাকা
ডলারের দাম এখনো বেশি

আন্তব্যাংক ডলারের বিনিময় হার এখন ১০৬ টাকার বেশি। ডলারের বিনিময় হার কিছুটা বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার কারণে ডলারের দর বেড়ে এটা হয়েছে। ঠিক এক বছর আগে এই ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৬ টাকা। সুতরাং দেখাই যাচ্ছে ডলারের সংকট তেমন কাটেনি। বরং ডলার সামনে আরও ভোগাবে।

৭%
কলমানি হার বাড়ছে

এখন কলমানি হার ৭ শতাংশ। সাধারণত দিনের চাহিদা মেটাতে গিয়ে কোনো ব্যাংক তারল্যসংকটে পড়লে অন্য ব্যাংক থেকে তাৎক্ষণিকভাবে ধার করে। এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকের টাকা ধার নেওয়ার এ ব্যবস্থা ‘কলমানি’ বাজার হিসেবে পরিচিত। কলমানি হার বৃদ্ধি মানেই কিছু ব্যাংক তারল্যসংকটে আছে, দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে তাদের অন্য ব্যাংক থেকে অর্থ ধার করতে হচ্ছে।

বলে রাখা ভালো, ঠিক আগের বছরের একই দিনে কলমানি হার ছিল ২ দশমিক ৩৮ শতাংশ।

আরও পড়ুন
২.৪৮%
প্রবাসী আয়ে কিছু প্রবৃদ্ধি

প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স বৃদ্ধির হার এখন ২.৪৮ শতাংশ। খালি চোখে দেখলে চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের এই প্রবৃদ্ধির হারকে খুবই কম বলা যায়। বিশেষ করে যেখানে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি এবারও কাজ নিয়ে বিদেশে গেছেন। তবে আগের বছরের একই সময়ের সঙ্গে তুলনা করলে কিছুটা স্বস্তি অবশ্য প্রকাশ করাই যায়। কেননা সে সময়ে কোনো প্রবৃদ্ধিই ছিল না, বরং আগের বছরের তুলনায় প্রবাসী আয় কমেছিল ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ।

বিশ্বব্যাপী যদি মন্দা দেখা দেয়, মধ্যপ্রাচ্যের তেলের দাম যদি কমে যায়, তাহলেও কি প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি বজায় থাকবে—সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।

৪.৪১%
আমদানি কমছে

আমদানি প্রবৃদ্ধির হার এটি। ডলার–সংকটের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক নানামুখী উদ্যোগ নিয়ে আমদানি ব্যয়ে লাগাম টেনেছে। তুলনা করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। কেননা, গত অর্থবছরের একই সময়ে (জুলাই-নভেম্বর) আমদানি ব্যয়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ।

আমদানি তো কমেছে, তবে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ডলার–সংকটে তাঁরা অনেক নিত্যপণ্যের ঋণপত্রও খুলতে পারছেন না। ফলে আসন্ন রোজার সময়ের পণ্যমূল্য নিয়ে আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে

১০.৫৮%
রপ্তানি আয়ে কিছু স্বস্তি

অনেক সংকটের মধ্যেও একটি ভালো সূচক। এক বছর আগের ঠিক একই সময়ে যা অবশ্য ছিল অনেক বেশি, ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ। প্রশ্ন হচ্ছে চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির ধারা কি থাকবে?

১.৩১%
শেয়ার বাজার ভালো নেই

এটি হচ্ছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সূচক। তবে খারাপ খবর হচ্ছে এর সঙ্গে একটি বিয়োগ চিহ্ন বসাতে হবে। অর্থাৎ এ রকম: (-) ১.৩১ শতাংশ। এই সূচক গত জুনের পর থেকে। আর চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে এই সূচক (-) ০.৮১ শতাংশ। সুতরাং দেখা যাচ্ছে দেশের দুই শেয়ারবাজারের অবস্থা মোটেই ভালো নয়।

আরও পড়ুন
১৩.৮৮%
রাজস্ব আয়ে প্রবৃদ্ধি

নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে, অর্থাৎ পাঁচ মাসের রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধির হার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১৬.৪৬ শতাংশ। অর্থনৈতিক সংকটের সময় মানুষের আয় কমে যায়, ফলে আয়কর আদায়ও কম হয়। আর যাঁরা ফাঁকি দেন, তাঁরা সব সময়েই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন। বরং মূল্যস্ফীতি বাড়লে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে বাড়তি অর্থ চলে যায় নানাভাবে। যেমন শুল্ক বা মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) নির্ধারণ করা হয় পণ্যমূল্যের ওপর। সুতরাং কোনো পণ্যের দাম যদি ১০ টাকা হয়, তার ওপর কর বা শুল্ক দিতে হয়। আবার সেই পণ্যের দাম যদি বেড়ে ১৫ টাকা হয়, তাহলে কর বা শুল্ক দিতে হবে ১৫ টাকার ওপরেই। এতে জাতীয় রাজস্ব লাভ হয় ঠিকই, কিন্তু সীমিত আয়ের মানুষের কষ্ট বাড়ে।

(-) ৯৮৩.৩২ কোটি টাকা
সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে

এটা হচ্ছে গত নভেম্বর মাসের সঞ্চয়পত্র বিক্রির নিট হিসাব। অর্থাৎ এ সময়ে যত কেনা হয়েছে, তার চেয়ে বেশি ভাঙানো হয়েছে। আর যদি পুরো পাঁচ মাসের তথ্য নিই, তাহলে দেখা যাচ্ছে এ সময়ে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি করার পরিমাণ ১ হাজার ৬১৫ কোটি ৯২ লাখ টাকা। অথচ আগের অর্থ বছরের একই সময় বিক্রি ছিল ১০ হাজার ২৫ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। আর গত নভেম্বর মাসে বিক্রি ছিল ৭০১ কোটি ৯ লাখ টাকা।

সরকার অবশ্য সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে উৎসাহ দেওয়া কমিয়েছে। তবে বিক্রি এতটা কমার কারণ হচ্ছে মানুষের একটি অংশ সঞ্চয় ভেঙে জীবন চালাচ্ছেন। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধিই এর প্রধান কারণ।

আরও পড়ুন
৮.৭১%
মূল্যস্ফীতি এখনো বেশি

ডিসেম্বর মাসের মূল্যস্ফীতির হিসাব। গত সেপ্টেম্বর মাসেও এই মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ১০ শতাংশ। সেখান থেকে কমে হয়েছে ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ। কমেছে মাত্র দশমিক ৩৯ শতাংশীয় পয়েন্ট। তাতেই অবশ্য সরকার মনে করছে মূল্যস্ফীতির চাপ ভালোভাবেই সামাল দেওয়া হচ্ছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্র একই সময়ে মূল্যস্ফীতি প্রায় ৯ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে এনেও বলছে, সংকট কাটেনি।

সুতরাং মূল্যস্ফীতি নিয়ে ভালো কোনো পূর্বাভাস আপাতত নেই। আন্তর্জাতিক পূর্বাভাস হচ্ছে এবার বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির হার থাকবে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ।

৪৫০ কোটি ডলার
আইএমএফের ঋণ এ সপ্তাহেই

আইএমএফ থেকে ৪৫০ কোটি ডলারের যে ঋণ বাংলাদেশ চেয়েছে, তা চূড়ান্ত অনুমোদন পেতে পারে আগামীকাল সোমবার। আর অনুমোদন পেলে ফেব্রুয়ারির শুরুতেই বাংলাদেশ প্রথম কিস্তিতে পাবে ৪৪ কোটি ৭৮ লাখ ডলার। এর পর থেকে ৬৫ কোটি ৯১ লাখ ৮০ হাজার ডলার করে ছয় কিস্তিতে বাকি অর্থ দেওয়া হবে। কেননা তারা সব ঋণ একসঙ্গে ছাড় করে না। প্রতি কিস্তি দেওয়ার আগে আইএমএফ শর্ত বাস্তবায়ন পর্যালোচনা করে। সুতরাং শর্ত পূরণ না করলে কিস্তি আটকে যাবে।

প্রশ্ন হচ্ছে আইএমএফের শর্ত পূরণ হলে ৪৫০ কোটি ডলার বাংলাদেশ পাবে ঠিকই, তবে শর্ত পূরণের কারণে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ কতটা বাড়ে, সেটাই হবে বিবেচনার বিষয়। কেননা, আইএমএফের শর্ত মানেই কৃচ্ছ্রসাধন, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি।