এ বিষয়ে পিআরআই নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘করদাতাদের হয়রানি করে বাড়তি কর আদায় করা যাবে না। এখন কর কর্মকর্তারা করদাতাদের সঙ্গে আলাপ–আলোচনা করে পয়সা তোলায় ব্যস্ত। করদাতা ও কর কর্মকর্তাদের দেখাদেখি বন্ধ করতে হবে। এই কর প্রশাসন দিয়ে বাড়তি কর আদায় করা যাবে না।’

আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, এনবিআরকে পুরোপুরি অটোমেশনে যেতে হবে। করদাতার বাড়ি, গাড়ি, ছেলেমেয়ের পড়াশোনা, বিদেশ ভ্রমণ—এসব যাবতীয় তথ্যের ভান্ডার গড়ে তুলতে হবে। এসব তথ্য এনবিআরের হাতে থাকলে করদাতারা কর ফাঁকি দিতে পারবেন না।

এত টাকা আসবে কীভাবে

সাধারণভাবে রাজস্ব আদায়ে প্রতিবছর ১৪–১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে এনবিআর। আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী, এই নিয়মিত প্রবৃদ্ধির বাইরে আড়াই লাখ কোটি টাকা বাড়তি আদায় করতে হবে।

সে ক্ষেত্রে বাড়তি রাজস্ব আদায় করার সুযোগ কোথায় আছে? কিংবা এই বাড়তি শুল্ক–কর আসবে কীভাবে? এসব প্রশ্নের খুব সহজ কোনো উত্তর নেই।

বর্তমান বাস্তবতায় কাস্টমস বিভাগের কাছ থেকে বাড়তি শুল্ক আদায় প্রত্যাশা করা যায় না। কারণ, ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। তখন বর্তমানে দেওয়া শুল্ক সুরক্ষার হার আরও কমাতে হবে। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, এখন এই হার ২৯ শতাংশের মতো।

এলডিসি থেকে বের হওয়ার পর উঁচু হারে শুল্ক–কর রেখে বাণিজ্য প্রবাহকে বাধা দেওয়া যাবে না। আবার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করতে হবে। এমন অবস্থায় কাস্টমস বিভাগের বাড়তি শুল্ক আদায়ের চিন্তাভাবনা থেকে সরে আসা ছাড়া তেমন বিকল্প নেই।

ভ্যাট থেকে এই বাড়তি রাজস্ব আদায়ের চাপ মেটানো যাবে, এমনটাও খুব বেশি প্রত্যাশা করা যায় না। ২০১৯ সালে নতুন ভ্যাট আইন চালু করা হয়। কিন্তু ভ্যাট আদায়ের ক্ষেত্রে খুব বেশি অগ্রগতি নেই। গত তিন বছরে আশানুরূপ পরিমাণ ভ্যাট আদায় করা যায়নি।

২০১৯–২০ অর্থবছরে কোভিডের কারণে আগের বছরের চেয়ে ভ্যাট আদায় কমেছিল। পরের বছর মাত্র ৭ হাজার কোটি টাকা ভ্যাট আদায় বাড়ে। গত অর্থবছরে ১৬ হাজার কোটি টাকার মতো বাড়তি ভ্যাট আদায় হয়। নতুন ভ্যাট আইন চালুর সময় বলা হয়েছিল, প্রতিবছর গড়ে ১৫–২০ হাজার কোটি টাকা বাড়তি আদায় হবে। এখন দেখা যাচ্ছে, বাড়তি পরিমাণে ভ্যাট আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না।

অভ্যন্তরীণ ব্যবসা–বাণিজ্য গতিশীল থাকলে ভ্যাট আদায় বাড়ে। কিন্তু বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট এবং দেশের অভ্যন্তরে নানা চাপে ব্যবসা–বাণিজ্যে শ্লথগতি আছে। আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকের মতো সংস্থাগুলো বলছে, আগামী অর্থবছরে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমতে পারে।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষ ভোগ কমিয়ে দিতে পারেন। এ ছাড়া আগামী এক বছরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। দেখা গেছে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে নির্বাচনের বছরে নতুন বিনিয়োগ তেমন একটা আসে না। এমন অবস্থায় ভ্যাট থেকে বাড়তি অর্থ আদায় করা কঠিন হয়ে পড়তে পারে।

আয়কর খাতে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির সুযোগ আছে। তবে এ কাজ বেশ চ্যালেঞ্জের। করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধি করে বেশি রাজস্ব আহরণ করা যেতে পারে। গত সাড়ে চার বছরে কর শনাক্তকরণ নম্বরধারীর (টিআইএন) সংখ্যা ১০০ শতাংশের বেশি বাড়লেও রিটার্ন জমার হার ৫০ শতাংশও বাড়েনি।

সাড়ে চার বছর আগে কর শনাক্তকরণ নম্বরধারীর (টিআইএন) সংখ্যা ছিল ৪১ লাখ ১৯ হাজার। গত জানুয়ারি মাস পর্যন্ত এটা দ্বিগুণের বেশি বেড়ে প্রায় ৮৫ লাখ হয়েছে। তবে এ বছর মাত্র সাড়ে ২৮ লাখ রিটার্ন জমা পড়েছে।

দেশের বড় বড় কোম্পানি এবং ওই সব কোম্পানির পরিচালকেরা আয়কর দেন কর বিভাগের বৃহৎ করদাতা ইউনিটে (এলটিইউ)। গত অর্থবছরে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার আয়কর আদায় করেছে এলটিইউ, যা মোট আয়করের চার ভাগের এক ভাগ। মাত্র ২৮১টি কোম্পানি এবং ৯৮৭ জন পরিচালক এই কর দিয়েছেন। প্রায় পৌনে তিন লাখ কোম্পানি আছে, যাদের রিটার্ন দেওয়া বাধ্যতামূলক।

অন্যদিকে রয়েছে শুল্ক–করের অব্যাহতি–সুবিধা। এই সুবিধা বজায় থাকার কারণে সম্ভাব্য বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় করা যায় না। আইএমএফ ক্রমান্বয়ে কর অব্যাহতির সুবিধা কমানোর কথা বলেছে।

এনবিআর যা করছে

আইএমএফের শর্ত মেনে বাড়তি শুল্ক–কর আদায়ের জন্য এনবিআর এখনো কোনো পরিকল্পনা ঠিক করেনি বলে জানা গেছে। তবে বাড়তি শুল্ক–কর আদায় করা সম্ভব হবে বলে অর্থ বিভাগকে জানিয়েছে এনবিআর।

আগামী বাজেটে শুল্ক–কর বাড়াতে এনবিআরের পক্ষ থেকে বাড়তি উদ্যোগ থাকবে বলে জানা গেছে। বাড়তি কর আদায়ে পরিকল্পনা ঠিক করতে এবার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করবে এই সংস্থা। কাল বৃহস্পতিবার থেকে আগামী অর্থবছরেরর প্রাক্‌–বাজেট আলোচনা শুরু করবে এনবিআর।

এ বিষয়ে এনবিআরের দুজন সদস্য বলেন, এবারের প্রাক্‌–বাজেট বৈঠকে বাড়তি রাজস্ব আদায়ের কৌশল কী হবে—সে বিষয়টিই আলোচনায় বেশি প্রাধান্য পাবে।এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সহযোগিতা চাওয়া হবে।